Header Ads

Header ADS

ই-ইলশেগুঁড়ি ১





প্রকাশনার পাঁচ বছর

নি বে দ ন


ল ক ডা উ ন। 
মানব জীবনে এক নতুন শব্দবন্ধ।
মারণ ভাইরাস করোনার প্রকোপে বিপর্যস্ত 
মানবের একমাত্র আয়ুধ।
আত্মপ্রকাশ সংখ্যায় দ্বিমাসিক ‘‘ই-ইলশেগুঁড়ি’’ 
অনলাইন পত্রিকার বিষয় এটাই।
এই মুহূর্তের কবি-লেখকরা সব হতাশা কাটিয়ে 
কলম ধরেছেন এই বিষয়ে।
পাঠক বন্ধুদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, 
পড়ে জানান কেমন লাগল।
আর, বহু মানুষ এই বিপর্যয়ে প্রায় অনাহারে।
সরকারী ও বেসরকারি উদ্যোগে মানুষ 
ত্রাণ কার্যে এগিয়ে এসেছে। 
ইলশেগুঁড়ি সদস্যরাও সীমিত 
ক্ষমতায় পাঠিয়েছে ত্রাণ। 
প্রত্যেককে অনুরোধ, সাধ্যমত মানুষের পাশে দাঁড়ান। 
আমরা বিশ্বাসী, মানবজাতি এই 
সংকট কাটিয়ে উঠবে।
আর, বহু মানুষ অভূক্ত সারা বিশ্বে, 
এই সময়ে নানারকমের খাবারের ছবি 
পোস্ট না করলেই মনে হয় ভাল হয়।
শুভেচ্ছা সবাইকে।


শ্র দ্ধা ঞ্জ লি

কবিতা নয় - আর্যতীর্থ  
সমাপতন, চকোলেট হিরো - চিন্ময় মণ্ডল 

ক বি তা গু চ্ছ ১

মুখোশবাস - আর্যতীর্থ  
সৃজন পালের দুটি কবিতা 
ঝুলে থাকা গিনিপিগ জীবন- সুমন দিণ্ডা 
কফিহাউস - ফটিক চৌধুরী 
একলা খাতায় - সাত্যকি 
কোয়ারেন্টাইন - নীল আকাশ 
আতঙ্কিত ব্যালকনি - সুধাংশুরঞ্জন সাহা 
হাল ছেড়োনা বন্ধু - চিন্ময় মণ্ডল 
অজ্ঞাতবাস - চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী 
আজ কতজন - দেবব্রত ঘোষ মলয় 

গদ্য 

লকডাউনের দিনলিপি - তুহিন কান্তি বিশ্বাস 
হঠাৎ যে ঘটনা ঘটেছে - শমিত কর্মকার 
লাল ব্লাউজ - অশোক কুমার আচার্য্য
ঘুড়ি - ননীগোপাল সরকার 
নিজের জন্য - ডঃ রমলা মুখার্জী 
নীল নির্বাসন - হেমা পাল বর্ধন 

ক বি তা গু চ্ছ ২

করোনাশ - সৌভিক দাস 
লক ডাউনের মেল - সত্য সুন্দর (অনুপম) 
অশনি সংকেত - অজিত কুমার কর 
গৃহবন্দী - ইঞ্জামামুল হক, লকডাউনঃ জয়শ্রী কর 
ছোট্ট শিশুর লকডাউন - তাপসী প্রামাণিক 
আতঙ্ক - সুমিতা গাঙ্গুলী - 
লক - ঝিমলি ব্যানার্জী 
বৈশাখ - মুকুলিকা দাস, উপেক্ষা - জয়তী পাত্র প্রামাণিক 
জীবন্ত প্রকৃতি - সৌভিক দাস 
যাঁতাকলে - বিমান প্রামাণিক 
একফালি আকাশ - মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় রায় 
আমরা লড়ছি - অশোক কুমার আচার্য 
ভোরের সূর্য - পূর্ণিমা মণ্ডল 
মহামারি ও মন্বন্তর - প্রশান্ত কুমার শীল 
কোজাগরী চোখ - তাপসী শতপথী পাহাড়ী 
লকডাউনের দিনযাপন - মিতা ঘোষ 
দোরোখা লকডাউন - অর্ণব কুমার রায় 
লকডাউন - সবুজ সরকার 

ব ড়  গ ল্প  

লকডাউন - দীপক আঢ্য 

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স 

কর্কটক্রান্তি - অমিতাভ দাস 

কবিতা নয়

আর্যতীর্থ


রুগ্ন শীর্ণ শরীরটা একবারও আমাদের দিকে না তাকিয়ে অথই অন্ধকারে ঢুকে গেলো।
আমরা উদগ্রীব ছিলাম, ছায়ায় যাওয়ার ঠিক আগে তিনি ঘুরবেন, 
দেখবেন আমাদের দিকে সেই চেনা দৃষ্টিতে,
হয়তো বা হাতও নাড়বেন। 
তারপর, তারপরই ডিরেক্টর বলবেন ‘কাট’,
আর সেই গুডবাই ফ্রীজশট বুকে করে আমরা বাড়ি ফিরে আসবো।
চিত্রনাট্য ছিঁড়েকুটে ফেলে, 
রিচার্ড পার্কারের মতো একবারও না তাকিয়ে তিনি চলে গেলেন,
সব স্পটলাইট ম্লান করে দিয়ে,
ইরফান, প্রিয় ইরফান, এইবারে হলে যাবো কোন আশা নিয়ে?
এই প্রথম এবং শেষবার আমরা হাততালি দিতে পারছি না,
শুধু বারবার ফোনের স্ক্রীনের দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছি,
মনে অলীক আশা, এই আপনি ফিরে এসে বলবেন,
‘আপলোগ সাচ মান লিয়া থা ক্যায়া?’

মানবো না। মানছি না। 
আপনি জানেন শুধু আপনি আছেন বলে কত সিনেমা দেখতে গেছি?
টিভিতে ঠিক আপনার অংশটুকু হাঁ করে দেখে সিনেমা ছেড়ে উঠে গেছি কতবার,
একবারও নিরাশ করেননি আমাদের।
হলিউডে আপনি এলেই আমরা উদ্বেল হয়েছি আমাদের লোক বলে,
বলিউডে উৎকর্ণ হয়েছি নতুন কিছু পাবার আশায়।
ইরফান, প্রিয় ইরফান, অতই সহজে কি আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া যায়?

আজকে নিঝুম শোক, তাই বলে দিচ্ছে না এদেশ বিদায়।

সমাপতন 

চিন্ময় মণ্ডল


আকাশে তারকা পতন 
মাঝে চল্লিশ দিন
পিকে'র পরেই টিমে যোগ দিল 
বন্ধু চুনী এ-দিন।
ভারত হারালো প্রবাদ প্রতিম 
ফুটবল খেলোয়াড়
করোনা থাবা এড়িয়ে তবুও 
পেলনাতো নিস্তার।
ফুটবলে সেতো কিংবদন্তী 
ক্রিকেটেও চুনী দক্ষ
বাংলা দলের ক্রিকেটে স্তম্ভ 
কাঁপে যত প্রতিপক্ষ। 
রনজি দলের ডাক ফিরিয়ে 
ফুটবলে মজে থাকা,
ফুটবল সাথে বড় গাঢ় প্রেম 
ফুটবল নিয়ে মাতা।
যেই ময়দানে দাপিয়ে ছিলেন 
একদা পিকে-ও-চুনী,
সেই ময়দান ছেড়ে চলে গেল 
দিকপাল দুই গুণী। 
ময়দানকেই বিদায় জানিয়ে 
গেলেন অমৃতলোকে,
পিকে চুনী মিলে টিম গড়ে নেবে 
এবার স্বর্গলোকে।
চিরতরে তাঁর চলে যাওয়াকে 
মানতে চায়না মন,
অনতিকালেই চলে যাওয়া যেন 
বিরল সমাপতন।
বাংলার মাঠ ভুলবেনা কভু 
যতই যাওনা দূরে
চুনী পিকে আর শৈলেন অমল 
থাকবে হৃদয় জুড়ে। 

চকোলেট হিরো

চিন্ময় মণ্ডল 


আজকে আবার খসলো ‘তারা’ 
বড়ই দুঃসময়,
এবার ‘ঋষি’র যাত্রার শেষ 
নেমে এল অসময়।
পরাজিত হল জীবন-যুদ্ধ 
লিউকেমিয়ার হাতে,
চিরনিদ্রায় ‘চকোলেট-হিরো’ 
আচমকা এই প্রাতে।
সদা হাসিমুখ শায়িত নিথর 
দেহ ঘিরে যত মায়া,
সুদূরে হারালো রইলো পড়ে 
প্রাণহীন এক কায়া।
রুপালি জগতে ইন্দ্রপতন 
মনে ভরে ছিল আশ,
হৃদয় জুড়ে শূন্যতা ছায় 
বাড়ে মনে হা-হুতাশ।
কালের গর্ভে বিলীন 'তারা' 
কালের নিয়ম এই,
আমরা শুধুই নীরব সাক্ষী 
কিছুই করার নেই।
হারিয়ে ‘তারা’ গভীর শোকে 
চিত্ত পাষাণ কারা,
মগ্ন শোকের মাঝেও সে আজ 
উজ্জ্বল ধ্রুবতারা।
মৌনতা ঢাকে নীরব ভুবনে 
গোটা চরাচর জুড়ে
চিরবিদায়ের ঘণ্টার ধ্বনি 
বাজে সকরুণ সুরে।
‘করোনা’ জেরে মানুষ যখন 
বন্দী নিজের বাসে
‘তারকা’ পতন বিষ্ময়ে দেখি 
অসহায় গৃহ-বাসে।







ক বি তা গু চ্ছ ১


মুখোশবাস

আর্যতীর্থ


মুখোশ পরার অভ্যাস আজ নতুন কিছু নাকি?
কজনে আর সবার সামনে মুখোশ খুলে রাখি?
ছ আট আনার সত্যি আবেগ, বাদবাকি সব মেকি
নিজের কাছেও মুখোশ পরি, আয়না যখন দেখি।

মুখে যখন আঁকছি হাসি, মন জ্বলে হিংসাতে,
তারই পিঠে মারছি ছুরি, ঘর করি যার সাথে।
ষড় করে নিই এমন যেন কিচ্ছু বোঝে না সে,
মুখোশ পরা কি শেখাবে ওই খুদে ভাইরাসে?

চিনেছিলেন রাবণ বুঝি বিভীষণের মুখটি?
ধর্মমুখোশ কেমন হলো দেশ জ্বালানোর যুক্তি।
সেনাপতি মীরজাফরের বেইমানি রয় গুপ্ত
সেলাম করা মুখোশটাকেই সিরাজ ভাবেন মুখ তো।

আমরা সবাই জানি চিনি বন্ধু কোনো প্রাক্তন,
অনেক বেশি দাম চুকিয়ে বুঝেছি বিষ যার মন।
বাকি ছাড়ো, নিজেও কি আর দেখাই আসল মুখকে?
হিংসাগুলো মুছে টাঙাই মেকআপ করা সুখকে।

এখন নাহয় মুখের ওপর মুখোশ পরার নির্দেশ
আলমারিতে আগে থেকেই মুখোশগুলোর ভিড় বেশ।
সাথীর সাথে যেমন মুখোশ, আড্ডাতে হয় অন্য
সবারই মাস্ক তৈরী নানান পরিস্থিতির জন্য।

বরং জীবন তাড়িয়ে বেড়ায় মুখ দেখাবার ভয়
কেউ যাতে না বুঝে ফেলে কোনটা অভিনয়।
আজকে এমন মুখবাঁধাতে দুঃখ করে যাস কে?
ভাইরাসে আজ বৈধতা দেয় চেনা মুখোশবাস-কে।
সভ্য মানুষ হওয়ার মানেই মুখ ঢেকে যায় মাস্কে।

সৃজন পালের দুটি কবিতা

করোনা যুদ্ধ


বাঘে ও গরুতে এক ঘাটে জল খাচ্ছে।
শেয়াল কুকুরে একই শাল পাতা চাটছে।
সাপে ও নেউলে ভাব ভালোবাসা করছে।
ওরা যে সবাই করোনার সাথে লড়ছে।

গিন্নির কাজে কর্তা ভীষন ব্যস্ত
মহিয়সী আজ সামলান গোনা রেস্তো,
হাসি মুখে বলে এই আছি এই বেশ তো
করোনার সাথে চলছে হেস্তনেস্ত।

বাবু হেঁকে বলে শুয়ে থাক বাবা কেষ্টা,
আমিই না হয় তোর কাজ করি চেষ্টা।
জল দেব? পেয়েছে কি খুব তেষ্টা ?
দেখিস যেন না করোনাই জেতে শেষটা।

রাজা চুপচাপ, মন্ত্রী চমকে চিত্তির
কোটাল কন্ঠে মান্না, শ্যামল মিত্তির
মিথ্যে বাজারে খোঁজ নেই কোনো সত্যির
করোনা লড়াইয়ে জেগে থাকি দিন রাত্তির।

ঘরের মধ্যে বসে আছি সব শুদ্ধ
দেওয়াল বন্দী যীশু, ভগবান বুদ্ধ,
উল্টো নিয়মে নিয়ম যা কিছু রুদ্ধ,
চুপ চুপ, এখন লড়ছি করোনা যুদ্ধ। 

ইন্ডিয়া


ইন্ডিয়া সোফা সেটে স্কোর বোর্ড শুঁকছে।
আজ আবার কটা গেল, কতজন ধুঁকছে।
তারপর ব্রেকফাস্ট, বিস্কুট ও গ্রীন টি।
কপাল ছুঁয়েছে হাত ভালো যাক দিন টি।

এই ছবি মিলবে না ভারতের ক্ষেত্রে
তাহাদের মন নেই স্কোর বোর্ড গাত্রে।
খেলা তার চিরদিন ভাতে আর রুটিতে,
মন নেই, মন নেই বেলাগাম ছুটিতে।

ইন্ডিয়া ফুঁসে ওঠে, হতভাগা বেল্লিক,-
করোনার ভয় নেই ? হেঁটে কোথা চললি ?
আভি সব হঠ যাও ঘুষ যাও ঘর বে,
তোদের জন্য দেখি ইন্ডিয়া মরবে।

ভারত হাঁটছে তবু দিল্লি ও পাটনায়,
কলকাতা , মুম্বাই, শিলিগুড়ি, ছাতনায়।
রাত নামে, ইন্ডিয়া ঘুম যায় ডিভানে।
ধুলো শুধু, ধুলো ওড়ে কোথাকার কে জানে?

ঝুলে থাকা গিনিপিগ জীবন

সুমন দিন্ডা 


মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বৃষ্টিও পড়ছে
যথারীতি লোডশেডিং অন্ধকার করে ফেলেছে ঘর
শিল পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু ছিলো না 
কিছুটা রিলিফ বলতে পারো টেনশনের গরম থেকে।

এক মৃত্যুভয় থেকে আরেক মৃত্যুভয়ের সামনে আসা-
এ বিষাদ না অসহায়তার অবসান?
পথের মতো কিছু চলা যেখানে আটকায়
সাপের মতো কিছু ভয় যেখানে ঝড়কে ডাকে
সেখানে বন্দী গিনিপিগ কতখানি স্বাভাবিক 
সে প্রশ্ন উঠেই আসে।

পাতা উড়ে যায়, ডাল নেমে আসে মাঠে
বাতাসের বুক চিরে নামে জ্বলন্ত শিখা। 
চিরন্তন মৃত্যুর সাথে সঙ্গমে কেটে যায় রাত
ভারী হয়ে আসা জীবন ঝুলে থাকে কচুপাতায়,
পড়বো পড়বো করেও টিকে যায় 
যতক্ষণ না কোনো আগুন তাকে পুড়িয়ে দেয়।

জীবন আর অন্ধকার একত্রে বাড়ছে
স্নানে ঢুকে গেছে এলোচুল আকাশ,
একটু পরে সুগন্ধ ছড়িয়ে আয়নার সামনে বসবে।
কেটে যাওয়া লকডাউন উঁকি দিয়ে দেখবে
আলো নিয়ে এগিয়ে আসছে মৃত্যুর বয়স।

কফিহাউস

ফটিক চৌধুরী


এম.জি.রোড মেট্রো স্টেশন থেকে
কলেজ স্ট্রিট যে সময়টুকু লাগে
তা কেন এত দীর্ঘ মনে হয়!
ট্রামলাইন পেরোলেই সময় থমকে দাঁড়ায়
প্রতিটি মুহূর্ত তখন আমার নিজস্ব।
কফি হাউস, কয়েকটি পত্রিকা অফিসের 
ঠেক এবং কবিসঙ্গ তখন জীবনে জীবন।
সারা পৃথিবীর জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ে এখানে
সবকিছু ভুলে কালো কফিতে তুফান ওঠে।
‘করোনা’ চলে গেলে আড্ডাটা ফিরে আসবে জানি
প্রতি সেন্টিমিটার মেপে মেপে তা উশুল করে নেব।

একলা খাতায় 

সাত্যকি


মুখের থেকে সরে যাচ্ছে হাত 
নদীও দেখো কেমন একলা এখন 
রাতের পাশে শুয়ে আছে দুধার 
ওদের গায়ে ঘামের উত্তাপ 

কিন্তু দেখো হারিয়ে যাবে এই দিন 
যেমন গেছে আমাদের ছোটবেলা 
তখন নদীর এ-বুক পূর্ণ নগর বেলা 
দু ধার জুড়ে মিছিলের সহজ পাঠ  

কোয়ারেন্টাইন

নীল আকাশ


এই তো আছি বেশ নিজের খোলসে মাথা নত করে ...
কি অহংকারী ছিলাম আমি!
এখন চুপ করে বসে থাকি ঘরে
আর দরজার বাইরে 
নৃশংস ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আমারই বোকামি ....


সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে
এইভাবে 
নিজেকে বোঝাতে বোঝাতে
আজ নিজেই আছি নিজের পাহারায়


নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া
এখন আর  
অন্য কোনো পথ খোলা নেই
বাধ্যকতা ঘিরেছে আমাকে,
তোমাকে
এসো আজ বেঁধে বেঁধে নয় , দূরে দূরে থাকি
আজ নোয়ার নৌকো নেই 
এই যে দূরত্ব তোমার ও আমার এও এক পথ
পৌঁছে দেবে ঠিক আবার যে যার জীবন ঠিকানা    



আতঙ্কিত ব্যালকনি

সুধাংশুরঞ্জন সাহা


আমার সাতশো স্কোয়ারফিট ফ্ল্যাটের ব্যালকনি
সন্তোষ রায় রোডের দিকে চোখ মেলে তাকাইনি কতোদিন!
কতোদিন কথা বলা বন্ধ তার
সামনের কামরাঙা আর সজনে গাছের সঙ্গে!
ভোরের আলো, রাতের অন্ধকার
আর দুপুরের নিস্তব্ধতা
আগে কত রকম গল্প শোনাতো তাকে!
লকডাউনের একাকিত্ব আজ কুরে কুরে খায়...
দীর্ঘদিন পাশে থাকা নারকেল গাছ থেকে
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া কান্না
হৃদপিণ্ডে বুনে দেয় উৎকন্ঠার নতুন বীজ।

হাল ছেড়োনা বন্ধু

চিন্ময় মণ্ডল


বন্ধু আমার হাল ছেড়োনা ধীরতা রাখো ধরে
নতুন সূর্য উঠবে আবার নতুন দিনের ভোরে।
ফুটবে আলো মেঘ সরিয়ে আঁধার যাবে সরে
নতুন দিনের হাতছানিতে উঠবে জীবন ভরে।
কাটবে আঁধার ঘুচবে কালো আসবে সুপ্রভাত
লড়াই শেষে ফিরবো জিতে হাতে রেখেই হাত।
চলার পথও হবে মোলায়েম দূষণও যাবে কমে
প্রতিদিনের রোজনামচায় উঠবে জীবন জমে।
যদিও এখন বন্দী সকলে লড়াইটা নয় একার
বন্ধু আমরা শুধুই এখন পরিস্থিতির স্বীকার।
সকলে মিলেই চেষ্টা চালালে অসাধ্য কিছু নয়
বন্ধু তোমার আমার লড়াই আনবেই ঠিক জয়।
নীতির প্রয়োগ মন্দ-ভালো এ-সবই ক্ষণস্থায়ী
ফিরবে ছন্দ হাল ছেড়োনা কিছু-না চিরস্থায়ী।
এইতো কেমন পার করেছি দিনের গণ্ডি মাসে
আর কটা-দিন গেলে মুক্তি আসবেই গৃহ বাসে।
আঁধার কেটে ফুটবে আলো প্রতীক্ষা অবসান
দ্বিধা-দ্বন্দের পাহাড় ঠেলে ফিরবে ধরায় প্রাণ।
নব উত্থান ঘটবে আবার অনুভবে সবই পাই
বন্ধু আমরা একসাথে ফের হৃদয় মিলাতে চাই।
পথের কাঁটা সরিয়ে দু'হাতে আসবেই ঠিক জয়
তোমায় একথা জানাই বন্ধু হবে জয় নিশ্চয়। 

অজ্ঞাতবাস

চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী


এখন নামছে সন্ধ্যাকাল,
দিন কেটে গেছে না-হয় যা’হোক করে
সন্ত্রস্ত মানুষ সব গুটি গুটি পায়ে ফিরে
সেঁধিয়েছে ঘরের অজ্ঞাতবাসে;
এদিকে শহর ছেয়ে গেছে ভাইরাসে।
এরপর সন্ধের হাত ধরে রাত নেমে এলে
অবশিষ্ট প্রতিটি আলোকরশ্মি শুষে নিয়ে
অন্ধকার পরিব্যাপ্ত হয় আনাচেকানাচে,
দিশাহীন জনহীন রাজপথে।  

ঘরবন্দী মানুষ এই অন্ধকারকে ভয় পেয়েছে,  
অন্ধকার নামলে
যেন কী একটা তার ফুসফুসীয় পথ রোধ করে
সে ডুবে যেতে থাকে অতলে  
আরো অন্ধকার আরো বায়ুহীন কোনো প্রকোষ্ঠে।
নিমজ্জনের তীব্র কষ্ট ছড়িয়ে পড়ে
তার শরীরের প্রতিটি স্নায়ুর অভ্যন্তরে
যেভাবে ময়াল সাপ জীবন্ত গিলে নেয় শিকার 
তার প্রকাণ্ড শরীরে।

শহরে ছেয়ে গেছে ভাইরাস
ত্রস্ত মানুষ তার ফুসফুসীয় পথটিকে আগলে
নতুন করে ফিরে এসে বাঁচতে চেয়েছে।
অজ্ঞাতবাস শ্রেয় হয়েছে তার কাছে—
অতীত রণাঙ্গনে মানুষ যেভাবে লুকিয়েছে
বাঙ্কারে, সুড়ঙ্গে
আর শত্রু এসে ঘুরে গেছে চারপাশে।
আজকের মানুষের কাছে
এ এক নতুন যুদ্ধ এই শতকের বুকে।

আজ কতজন

দেবব্রত ঘোষ মলয়

জানলা খোলাই ছিল, মাথার কাছে
নতুন রোদের তির, চোখ বিঁধে বুকে
ঘুম ভেঙে গেল, আজ নতুন সকাল
তারপরই মনে পড়ে - আজ কতজন?

কতদিন একা আছো নন্দন চত্বর
পিছনের পুকুরের বড় মাছগুলো
বইপাড়া, কফি শপ আড্ডা চায়ের
এখনো দেখিনি গ্রাফ - আজ কতজন?

সকাল দুপুর রাত শনি থেকে সোম
সবজি কমেই যায়, শার্ট প্যান্ট কাঁদে
উঠোন বাগান ছাদ, ছাদ আর ঘর
গণ্ডির বাইরেই জুজু বাস করে - আজ কতজন?

কতদিন আগে শেষ ট্রেনে করে গেছি
ট্যাক্সি ও বাস ট্রাম আছে কি আজও
ধুলো ঢাকা জামা জুতো ঐতিহাসিক
রাস্তায় গুটিকয় মুখঢাকা ভয় - আজ কতজন?

দিন যায়, মাস যায় স্বপ্নেই দেখি
একদিন চোখ মেলে নতুন সকাল
মোবাইলে ই-পেপার জ্বলজ্বল করে
একজনও নেই আজ কোন তালিকায়।

তখন সূর্য ওঠে আগের মতোই ......

গদ্য 


লক্ ডাউনের দিনলিপি

তুহিন কান্তি বিশ্বাস


    লক্আপ আর লক্আউট-এর মত ভয় ভরানো শব্দগুলোর সাথে ছোটবেলা থেকেই পরিচিত ছিলাম, কিন্তু সত্যি কথা বলতে লক্ ডাউন কথাটার সাথে কখনোই অবগত ছিলাম না। এইটুকু জীবনে সবই যে জানতে হবে এমন মাথার দিব্যি বা কে দিয়েছে। প্রথম প্রথম তো ভুল করে কতবার লক্ ডাউনের জায়গায় ‘লক্ আপ’ বলে বাড়ির লোক আর  বন্ধুদের মধ্যে হাসির পাত্র হয়েছি তা আর কহতব্য নয়। কম্পিউটারে কাজ করার অভিজ্ঞতার সুবাদে অনেকবার তো মুখ থেকে ‘লগ আউট’ও বেরিয়ে গেছে। সে যাই হোক, ব্যাপারটা সম্পর্কে হোয়াটসঅ্যাপ, টিভি আর খবর কাগজের দৌলতে জেনে যখন বেশ একটু পন্ডিতের মতো হ ল য়েছি, এলো এক নতুন অভিজ্ঞতা। 
    পেশাগত কারণেই রয়েছে দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার, হাসপাতালে রোগীর দেখভাল। সুদুর কসবা, দমদম, জনাই অথবা সোদপুর থেকে পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে, লুকিয়ে লুকিয়ে বা পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে শ্যামবাজার পর্য্যন্ত আসতে দেখছি রোগীদের। মোটামুটি সব এলাকার প্রাইভেট ডাক্তারবাবুদের চেম্বার বন্ধ, করোনার আতঙ্কে বন্ধ বা চিকিৎসকের অভাব নার্সিং হোমে। অগত্যা ভরসা সরকারী হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র — করোনা বাদ দিয়েও তো রোগের তালিকা কম নয়। লক্ ডাউনে বন্ধ দিন মজুরের কাজ কিন্তু বন্ধ নয় অসুখ। প্রয়োজন ওষুধ, প্রয়োজন চিকিৎসা। লক্ ডাউন তো খুলবেই, করোনাও নিশ্চিত পিছু হটবে, কিন্তু ততদিনে যদি শরীর হয়ে যায় অকেজো কেমন করে পরের লড়াইটা করা যাবে? লক্ ডাউনকে উপেক্ষা নয়, লক্ ডাউন পদ্ধতিকে মান্যতা দিয়েই ওরা আসে — পরিবারের বাকি সকলের নিশ্চয়তা সুরক্ষিত রাখতে।
    


হঠাৎ যে ঘটনা ঘটেছে 

শমিত কর্মকার

    সেদিন ছিল শুক্রবার সঞ্জয় বউ আর মেয়েকে নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। মেয়ের পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় বায়না ধরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সঞ্জয় দেখলো তার অফিসে বেশি দিনের ছুটি পাওয়া যাবে না তার উপর বেড়াতেও যেতে হবে। তাই ঠিক করলো তার বন্ধু নীলের গ্রামের বাড়ি যাবে। শুক্রবার গিয়ে রবিবার বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু কাল হলো তার লক ডাউন হয়ে গিয়ে। সঞ্জয় ভাবতেও পারেনি এমন একটি বিপত্তির মধ্যে পড়বে।
    সবিস্তারে আলোচনা করে তখন নীলই বলে ছিল ওর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা। বেশি দূরে নয়, ৪/৫ ঘন্টার রাস্তা, ভালোই লাগবে। 
    রাতারাতি হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করায় ওরা বিপাকে পড়ে গেল। করোনা নামক এক ভাইরাস ঘটিত ব্যাধি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও তাদের গ্রামের প্রায় জায়গাই ঘোরা হয়ে গিয়েছিল। গ্রামটি ছিল ভীষণ সুন্দর সাজানো গোছানো। নীলের ঠাকুরদাকে সকলে ভীষণ মানতেন তাই ওখানকার কাজ কর্মই আলাদা। সঞ্জয় ভেবে ছিল সোমবার ভোরে বেরিয়ে সোজা ও অফিস চলে যাবে আর নীলের পরিবার ও তাঁর পরিবার বাড়ি চলে যাবে। রাত্রি থেকে ট্রেন বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। সমস্ত রাজ্যের লোকাল ও দূরপাল্লার সব ট্রেন। সব আশাই শেষ হয়ে গেল। থেকে যেতে হলো এক অনিশ্চয়তা ও ভয় নিয়ে। এবার তারা কি করবে। বিভিন্ন চ্যানেল এর খবর দেখে আরও ভয় বাড়তে লাগল। সাথে ওদের দুটোই ছোট ছেলে মেয়ে। সাথে তেমন টাকা পয়সাও নেই। ঘুরতে যাওয়ার জন্য যেমন দরকার সেইরকমই। কবে এই লক ডাউন উঠবে এবং কবেই বা নিজের বাড়িতে যাবে।



লাল ব্লাউজ

অশোক কুমার আচার্য্য

    প্রশান্তর বাড়ি ব্যারাকপুর। বাড়ি বলাটা ঠিক হবে না, একটা দু’কামরার ঘর। তার সঙ্গে একটা রান্নাঘর ও পায়খানা। বাড়িতে আর কোন জায়গা নেই। সেজন্য বাড়িতে কেউ এলে খুব সমস্যা। আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবদের আসতে না বলাও যায় না। চক্ষুলজ্জা বলে কথা আছে। প্রশান্তের দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা ছেলে মেয়ে নিয়ে এলে যা সমস্যা হয় সে আর বলার কথা নয়। বারান্দায় বিছানা করে মশারী টাঙিয়ে কোনরকম রাত কাটানো। প্রশান্ত রেলের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক। বেতন আহামরি তেমন কিছু নয়। তবুও কিছু কিছু করে টাকা জমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু রোগ আর তার ওষুধ খরচের জন্য বেশি জমাতে পারেনি। বেশকিছু দিন হল নিজের নার্ভের সমস্যা দেখা দিয়েছে। লিখতে গেলেই হাতটা কাঁপছে। নিউরো মেডিসিনের ডাঃ শ্যামল সেন কে দেখিয়েছে।
    প্রায় তিন বছর হল ডাঃ সেনের ওষুধ খেয়েও তেমন কোন উন্নতি হয়নি। একই ওষুধ চলছে। কেবল মাঝে মাঝে ওষুধের ডোজের মাত্রা কমবেশি করে চিকিৎসা চলছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা রাত্রে ওষুধ খেলেই ঘুমে চোখটা জড়িয়ে আসে। ভোর পর্যন্ত কোন হুঁশ থাকে না। তারপর একটু একটু করে চেতনা ফিরে আসতে থাকে। পুরবী মাঝে মাঝে অভিযোগ করে তুমি রাতের ওষুধটা খাওয়া বন্ধ করে দেখ।
 ডাক্তার আবার বলেছে ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। পুরবীর গঞ্জনা বাড়তে থাকে। শখ আহ্লাদ বলে আর কিছু থাকল না। খাওয়ার পর পরই ঘুম আর নাকডাকা। কার বাপের সাধ্য আছে পাশে শুতে পারে। জায়গাও নেই যে অন্য কোথাও বিছানা করবো। বাবা কি দেখে যে বিয়ে দিয়েছিল কে জানে। একে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক তার আবার বিয়ের সময় কত কথা। দাবির যেন শেষ নেই। এটা দাও ওটা দিতে হবে। নগদ কিছু টাকা না দিলে বউভাত করতে পারব না। শ্বশুর বাড়ির টাকায় লোকজন খাওয়াবে। নতুন চাকরির অজুহাত। সবই ভাগ্য। কি আর করা যাবে। কতবার বলা হচ্ছে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে বাড়িটা বাড়ানোর জন্য। কোলে একটা ফুটফুটে মেয়ে এসেছে। দেখতে দেখতে বড় হবে। তার নিজের একটা ঘর চাই। এখন থেকে ব্যবস্থা না করলে কোনদিন হবে না। চাকরির পর কতলোক টিউশন পড়িয়ে রোজগার করছে। ওনার সেদিকে ও কোন ইচ্ছা নেই। ঘরকুনো বলে কথা। অফিস থেকে ফিরে শুধু খুটখাট করছে।
রবিবার মেয়ে দীপ্তির বয়স দুই বছর পূর্ণ হবে। নতুন বছরে পা দেবে। প্রদীপ অফিসের কাউকে ডাকেনি। বোনদেরও না। ওর কলেজের বন্ধু প্রশান্তকে কথায় কথায় বলেছিল দীপ্তির জন্মদিনের কথা। তাও আবার ফোনে। প্রশান্ত রেলের ড্রাইভার। শিয়ালদহতে একটা মেসে থাকে। বাড়ি বাগনানের কাছে। কথাটা যখন একবার বলেছে তখন ডাকতেই হয়। একসময় ছোট বোনকে বিয়ের কথা উঠেছিল। বোনটা রাজি হল না। আগে থেকে প্রেম পর্ব চলছিল, তাকেই বিয়ে করলো। প্রশান্ত ছেলে হিসেবে ওর বরের তুলনায় অনেক ভালো। তখন প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে একবার আসত। সবাই ভেবেছিল ওদের জুটিটা পরিনতি পাবে। কতদিন রাত্রে এখানে থেকেছে। পূরবী ও বোনকে নিয়ে সিনেমা থিয়েটার দেখতে গেছে। হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখতো বাড়িতে আসলে। বোনটার বিয়ের পর বাড়িতে আসা একেবারে ছেড়েই দিল। এখনো বিয়ে করেনি। সেই জন্য বলেই ফেললাম প্রশান্ত পারলে চলে আয়। মেয়েটার জন্মদিন তুই এলে পূরবী খুব খুশি হবে। মেয়েটাও তোকে পেলে লাফালাফি করবে। তখন সেভাবে ওর দিক দিয়ে কোন উত্সাহের সাড়া পাওয়া যায়নি। ভেবেছিলাম আসবে না। হঠাৎ দেখি রবিবার দুপুরে এসে হাজির।
    পূরবী বাবা মা ও মেয়ে ওকে পেয়ে খুব খুশি। দূপুরে সবার খুব হৈচৈ করে কাটল। সন্ধ্যায় কেক কেটে বেলুন উড়িয়ে মেয়ের কি আনন্দ। প্রশান্তকে একদম ছাড়তে চায় না। পূরবী কে দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ খুশি খুশি হয়েছে। রাত্রে খাওয়ার পর ও চলে যেতে চেয়েছিল। প্রদীপ বলল কতদিন পর এলি আজ যখন ডিউটি নেই তখন রাত্রে থেকে যা। কাল সকালে এখান থেকে সোজা ডিউটি চলে যাবি। মা টিফিন বানিয়ে দেবে। ডিউটি করে মেসে গিয়ে দূপুরে খাবি। প্রশান্ত একটু কিন্তু কিন্তু করেও শেষ পর্যন্ত থেকে গেল। পূরবীকে বললাম তুমি আর মেয়ে খাটে শুয়ে পড়। আমি আর প্রশান্ত নীচে বিছানা করে দাও শুয়ে পড়ি। সেই মতো আমার আর প্রশান্তর জন্য নীচে বিছানা হল। মশার দৌরাত্ম্যের জন্য মশারি না টাঙিয়ে উপায় নেই। দীপ্তি সারাদিন ছোটাছুটির পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রশান্ত আর পূরবী খাটে বসে গল্প করছে। প্রদীপ ওষুধ খেয়ে একটু বসে গল্প শুনছিল। বেশি সময় বসতে পারল না। ঘুমে ঢলে পড়ছে। শেষে বিছানায় শুয়ে নাক ডাকতে লাগল। ভোরে যখন প্রদীপের ঘুম ভাঙলো তখন প্রশান্ত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পূরবী আর মেয়েও জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। প্রদীপ বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে আবার শুয়ে পড়ল। আর ঘুম এলো না। এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় উঠে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। অফিস যেতে হবে। বাজারের ব্যাগটা নিয়ে মাকে বলে বেরিয়ে গেল।
    বাজার থেকে ফিরে দেখে প্রশান্ত উঠে পড়েছে। পেপারে চোখ বোলাতে বোলাতে চা খাচ্ছে। পূরবী বাথরুমে। মা রুটি তরকারি আর একটা ডিমের ওমলেট টিফিন বাক্সে পুরে প্রদীপের হাতে দিল। এটা ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে দে। একটু বেশি করে দিয়েছি। সময় করে খেয়ে নেবে। মায়ের কাছ থেকে টিফিন বাক্সটা নিয়ে প্রশান্তর ব্যাগে ঢোকানোর জন্য চেনটা খুলে প্রদীপ অবাক হয়ে গেল। ব্যাগের মধ্যে পূরবীর গতকালের পরা লাল ব্লাউজটা ভাঁজ করে রাখা আছে।


ঘুড়ি 

ননীগোপাল সরকার 


    ঘরের দোরে  দু’জোড়া প্রাপ্তবয়স্ক চোখ, দীর্ঘ পথের আগমনে দৃষ্টি পেতে বসে থাকে অপলক। প্রতিদিন সকালে উঠোনের সুপারি গাছের ছায়াটা ছোট হতে দেখে, বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া ঠোঁট দু’টো যখনি মৃদু হাসিতে কেঁপে ওঠে, হঠাৎ পুব দিকে বড় হতে হতে মিলিয়ে যায়। এভাবেই বৃদ্ধ স্বপন বাবু ও তার স্ত্রীর দিনের শুরু ও শেষ। 
    তাদের একমাত্র ছেলে কর্মসূত্রে তামিলনাড়ুতে থাকে। গত মার্চের শেষে বাড়ি ফেরার কথা ছিল কিন্তু করোনার আবহে ট্রেন বন্ধ হওয়াতে আর ফিরতে পারেনি। কবে ফিরবে সেটাও সঠিকভাবে বলতে পারছে না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাদেরকে দেখে যাই এবং মোবাইলে ছেলের সাথে কথা বলিয়ে দেই। আজও গিয়েছিলাম। ফেরার সময় তাদেরকে বলি প্রতিদিন তো ছেলের সাথে কথা হয় আর ট্রেন না চললে তো সজল বাড়িও ফিরতে পারবে না। তাহলে কেন সকাল থেকে সন্ধ্যা তার পথ চেয়ে বসে থেকে চিন্তা করেন? স্বপন বাবু তার উত্তরে যা বললেন — তুমিও আমার ছেলের মত তাই তোমার কাছে  বলতে আর দ্বিধা কিসের, বাপ-মা ও ছেলে মেয়ের  সম্পর্ক হল ঘুড়ির মত, মায়ার সুতোর টানে মন আকাশে উড়তে থাকে। যদি প্রতিদিন ভালবাসার লাটাই ঘুরিয়ে একটু একটু করে গুছিয়ে না রাখি, মাঝ আকাশে কেটে গেছে পারব কী এই বয়সে আর খুঁজে আনতে! পারব কী ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছনে হাওয়ার বেগে ছুটতে! তাইতো মমতার ছাদে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে বুকের কাছে টানি। যতদিন বেঁচে থাকব এভাবেই গুছিয়ে যাব মায়ার সুতো। কথাগুলো যেন আমার গুরুমস্তিষ্কে ছেয়ে গেল । আমি নির্বাক হয়ে কথার গভীরতা মাপতে মাপতে ফিরে আসি বাড়িতে।



নিজের জন্য 

ডঃ রমলা মুখার্জী


     সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত থাকতো মিতা তার স্বামী রবিন ও ছেলে অমিতকে নিয়ে। মেয়ে তৃণার বিয়ে হয়েছে মাস চারেক আগে। অমিত ওর বাবাকে ভেলোরে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গিয়ে লকডাউনে আটকে পড়েছে। মিতার এখন যেন সময় কাটতেই চাইছে না। গল্পের বইগুলোর মধ্যে ডুবে একাকীত্ব ভোলার চেষ্টা করে। কিন্তু বইগুলো প্রায় পড়া শেষ হয়ে আসছে। আবার লক ডাউনের সময়ও তো বেড়ে গেল। হঠাৎ কি মনে করে খুঁজে বের করে কিশোরীবেলার কবিতার খাতাটা। কত কথাই মনে পড়ছে। স্কুলের ম্যাগাজিনে তার কবিতার কত প্রশংসাই শিক্ষিকারা করতেন। রবিনকে প্রেমপত্র নিজের কবিতা থেকেই উদ্ধৃতি দিয়ে লিখত। কলেজে পড়তে পড়তেই দুবছরের সিনিয়র ব্যবসাদারের ছেলে রবিনের সঙ্গে এক বছর প্রেম করেই পালিয়ে বিয়ে করে ফেললো মিতা। অসবর্ণ বিয়ে মিতার পুরোহিত বাবা মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এসে সব মোহ ভঙ্গ হয়ে গেল মিতার। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সেবা, সংসারের কাজেই সময় কেটে যায়। রবিন বাবার কাপড়ের দোকানে ব্যস্ত থাকত। মিতার পড়া, কবিতা সব মাথায় উঠল। এভাবেই সংসারের যাঁতাকলে মিতার পাক খেতে খেতে পঁচিশটা বছর কেটে গেল। রবিন তো কবিতাগুলো যে মিতার লেখা বিশ্বাসই করতো না। তাই মিতার মা-বাবা যখন বিয়েটা নাতনি হওয়ার পর মেনে নিলেন তখন কবিতার খাতাটা বাপের বাড়ি থেকে রবিনকে এনে দেখিয়েছিল মিতা। শ্বশুর-শাশুড়ি আজ গত হয়েছেন, কিন্তু ওনারা তাকে কম অত্যাচার করেন নি। গরীব বাবা-মাকে উল্লেখ করে দিন-রাত খোঁটা দিতেন ওনারা। সারাদিন সেবা করেও তাঁদের কখনও সন্তুষ্ট করতে পারেনি মিতা।
    খাতাটার বেশ ক’টা পাতা ফাঁকাই রয়ে গেছে। আবার শুরু করল মিতা লিখতে। কবিতা, গল্প কতকিছু লিখেই চলল। অভিজ্ঞতার আলোয় অনেক পরিণত সে লেখা। হোয়াটসঅ্যাপ, ই-ম্যাগাজিনে পাঠিয়েও দিল কিছু লেখা। কাপড়ের দোকানের বিজ্ঞাপন দেওয়ার কল্যাণে মিতা স্মার্ট ফোনের ব্যবহার ভালোই শিখেছে।
বেশ ক’টা গল্প-কবিতা প্রতিযোগিতায় সেরার সেরাও হয়ে গেল। কি সুন্দর ডিজিটাল শংসাপত্র পাঠিয়েছে বেশ ক’টা সাহিত্য পত্রিকা। এতো সম্মান তো কেউ কখনও দেয় নি তাকে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে মিতা। লকডাউন তাকে নতুন একটা জগতের আলো এনে দিল। সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল নিজের জন্যে কিছুটা সময় সে লক ডাউন উঠে গেলেও রাখবে।



নীল নির্বাসন

হেমা পাল বর্ধন


    মন উচাটন সব সময়, কি যেন হারিয়ে ফেলছি, কাছের মানুষ গুলো দূরে সরে যাচ্ছে, সবসময় এমন একটা অনুভুতি। আসলে নিঃস্ব হাওয়ার ভয়, তাড়া করে বেড়াচ্ছে। হাতের মুঠোয় বালি! তবুও তো ধরে থাকি। অথচ জোর করে কোনোকিছুই আটকে রাখা অসম্ভব। বন্ধুদের কথা নেহাত বাদই দিলাম, পরম শত্রুকেও প্রাণ খুলে বলতে ইচ্ছে করছে ভালো হোক, তারও তো মনে প্রিয়জন জন হারাবার ভয়!
    সন্ধ্যেবেলা বাচ্চাদের সাথে কিছুটা সময় কাটাই, তখন পড়াই না, শুধু ওদের মনের ভিতরটা দেখি, এখনও দেখতে পাই, হয়তো সারাজীবন দেখতে পাবো, মা যে। আমার ছবি তুলে বড়টা ফেসঅ্যাপে দিয়ে কিসব কারুকার্য করলো, ছোটটা দেখে বলল মা পই হয়ে গেছে, জাদুতাটি, আলস্টাল দলকাল। বড় বুঝতে শিখেছে, ওর মনেও দানা বাঁধছে ভয়। তাই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে মাকে পরী বলবি না, বল রানীর মত লাগছে। ছোটো জন আলতুসী, ধমকানিতেই কেঁদে ফ্যালে, আমি দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরি। ওই ছবিটা দেখে ছেলেবেলার বন্ধু মন্তব্য করে নীল নির্বাসন। ভীষণ সত্যি! জানি না প্রকৃতি কি চাইছে, কেনো এই শাস্তি? আমি পরী হতে চাই না, দেবী রানী কিচ্ছু না, আমি প্রিয় মানুষটার গৃহিণী হতে চাই, ফিরে পেতে চাই আমার রান্নাঘর, আমার হুলুস্থুল সংসার। বাঁচতে চাই আগের মতো, প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চাই, স্বাধীন ভাবে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে চাই নরম ঘাসে, জোরে জোরে আওড়াতে চাই জীবনানন্দ ।


ক বি তা গু চ্ছ ২

করোনাশ

সৌভিক দাস


এই সুদূর মৃত্যু মিছিলের যাত্রাপথে,
দেবনা আমরা আর সাড়া;
ঘরেতে বসে লকডাউনকে মেনে,
করোনাকে করব এবার তাড়া।
বিদ্রোহ-প্রতিবাদ-আন্দোলন-ধর্নার মঞ্চ, 
শুধুই কি রাজপথে করা যায়?
একান্তই যদি তা করতে হয়,
ঘরের কোণেতে বসেও করা যায়।
এই মৃত্যুপুরীর রাক্ষসকে হত্যা করার জন্য, 
আমাদের যুদ্ধের পটভূমিতে নামতে হবে;
সামাজিক দূরত্বের রঙ্গমঞ্চে অধিষ্ঠিত হয়ে,
ঠিক মেঘনাদের মতো মেঘের আড়াল থেকে।
এখন আমরা একজোটে সবাই ক্ষত্রিয়,
এখন আমরা একজোটে সবাই যোদ্ধা;
আমাদের এই যুদ্ধের সেনাপতি হলেন,
স্বাস্থ্য কর্মীরা-পুলিশ কর্মীরা-সাফাই কর্মীরা।
এই যুদ্ধে জয়ী হতে লাগবে না আমাদের,
কবজ-ঢাল-তরোয়াল বা জ্যাকেট-গুলি-বোমা;
লাগবে শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা,
কথা বলার সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা।
ঘরেতে বসে যুদ্ধ আমাদের করতেই হবে,  
নরখাদক করোনাকে করতেই হবে বিনাশ;  
তারপর আমরা সবাই আবার একজোট হয়ে,
আমাদের স্বর্গের মতো পৃথিবীতে করব বাস। 

লক ডাউনের মেল

সত্য সুন্দর (অনুপম)


বন্ধুদের খবরাখবরের জন্য
অপেক্ষায় থাকতে হয়না এখন আর
গতি বেড়েছে, সঙ্গতিরাও।
ঝড়ের বেগে ভেসে আসে
যাপনের খুঁটিনাটি হাল-হকিকত।
এলোমেলো ঝড়াপাতা গুলো
বসন্তের দিনে নিয়ে যায়
কখনো দমকা বাস্তবে।
পরিপাটি করে সাজাই
না ঘটে যাওয়া স্বপ্ন গুলো।
রয়েছি অখন্ড অবসরের আসরে
সঙ্গে সম্ভাবনার সাদা কালো সাঙ্গপাঙ্গ।

একটানা জ্ঞানদা চ্যানেলের সর্তকতা
ও হরেক অনুষ্ঠানের যাতায়াত।
মাঝে মাঝে গীতি শুধারসের মৌতাত
সাথে গদ্য পদ্যের অনুপান।
প্রায়শই গৃহকর্মনিপুনার অভিমান ভোলাতে
পিজ্জা পাস্তার  পিন্ডি চটকানো
আর রিসোতোর বদলে ডাল ভাতে হাত পাকাই।
হঠাৎ স্টেটস থেকে বন্ধুর দুশ্চিন্তা বিনিময়
ছাপিয়ে যায় চিন থেকে শুভমের  বরাভয়।
চারিদিকে নিশব্দ হাহাকার শুনেও
উদাসিনতাকে বিচক্ষণতা ভাবি।
নিজেকে বিলিয়ে দিই
অলস সময়ের হাতে
জানি প্রকৃতি নিজেকে ঠিক গুছিয়ে নেবেই।।

অশনি সংকেত

        অজিত কুমার কর       

   

স্বেচ্ছা নির্বাসন বিশ্বমানবের কেন বাধ্যতামূলক? 
নিরুপায়, তাই এটাই উপায় প্রতিষেধক কোথায়!
সর্বগ্রাসী বিভীষিকা মৃত্যুভয়, সত্য, নয় অমূলক 
পূর্ণ প্রকৃতির ওষধি-ভান্ডার কখন হদিস পায়।

অসহ্য যন্ত্রণা পৃথিবীর বুকে অবিরাম অত্যাচার 
কলুষিত জল স্থল অন্তরীক্ষ, তাই প্রকৃতি বিরূপ 
মায়ের কোমল অঙ্গে মুষ্ট্যাঘাত কেন, কেন এ বিকার 
অসার গর্জন সার, দাম্ভিকতা তার কী কদর্য রূপ!

সভ্যতা ধ্বংসের মুখে আর কবে হবে চৈতন্য উদয় 
এ ধরায় কে সুজনকে দুর্জন শুধু বেহুঁশ মানুষ
কালিমায় ভরা জননীর মুখ বিশ্ব অন্ধকারময় 
কোরিয়া-ইতালি-চীন-আমেরিকা পাকিস্তান-ফ্রান্স-রুশ।

মানুষের মনুষ্যত্ব তলানিতে শিক্ষাদীক্ষার অভাব
চিন্তনে সর্বদা ধ্বংস সমরাস্ত্র সব পারমাণবিক!
ছোটো বড় সব দেশে নেতাদের মনে বিলুপ্ত সদ্ভাব
আশা কি দুরাশা রবে না কি হবে ধরা ফের স্বাভাবিক।

গৃহবন্দি

ইঞ্জামামুল হক


বন্ধ করেছি সব, আমরা সব কিছু বন্ধ করেছি
‘করোনা’ ছোবল মেরেছে দেশে বিদেশে
তার সাম্রাজ্য করেছে বিস্তার!
রাস্তার দোকান, হাটবাজার
পথঘাটে একটিও মানুষ পাবেন না খুঁজে
শপিং মল কিংবা থিয়েটারও বন্ধ
বোবা রেলগাড়ি নিস্তব্ধ কারশেডে
নিশ্চুপ রয়েছে ট্রামলাইন
বন্ধ করেছি পেট্রোল ডিজেলের যানবাহন
শুনসান পরে আছে কংক্রিটের পথ
কর্দমাক্ত রাস্তা, লাল মৃত্তিকার রাস্তায়
এখন হয়ত মুক্ত বাতাস স্বাধীনভাবে
আনমনে উড়ে যাচ্ছে আপন খেয়ালে
এদিক সেদিক, পূব হতে পশ্চিম!
বন্ধ করেছি সব, বন্ধ করে দিয়েছি বাড়ির দরজা
জানালার ফাঁকফোঁকরও বন্ধ করেছি
নিজেকে আলাদা করেছি ‘আইসোলেশনে’
বন্দি করেছি ‘কুয়ারান্টইন’-এ
এখন হয়ত খেলা করছে পাখির দল
দলে দলে উড়ে চলেছে মুক্ত আকাশে
আপনমনে গান গেয়ে চলেছে
মুগ্ধ করছে প্রকৃতিকে,
যেমনটা ছিল কয়েক শতাব্দীর আগে
শিল্প বিপ্লবেরও আগে,
কোন বাধা নেই,কোন বিষবাষ্প নেই
হাওয়াই জাহাজের জ্বালানির কিংবা কারখানার 
ওরা আজ স্বাধীন!
ওদের আজ উড়ে যেতে নেই কোন মানা।

লকডাউন

জয়শ্রী কর


লক ডাউনে বন্দি জীবন 
কাটবে কবে তাকিয়ে থাকি 
বাইরে যাওয়া বন্ধ এখন 
নিজেকে তাই ব্যস্ত রাখি। 

যে সব মানুষ প্রাণ বাঁচাতে 
সদয় হয়ে এগিয়ে আসে 
ভালোবাসার দিচ্ছি না দাম 
রাখছি দূরে ভয়ে ত্রাসে। 

সকাল হলে বেরিয়ে পড়ে 
ঘুরছে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে 
পেটের জ্বালা বড় জ্বালা 
গুমরে মরে রয় তাকিয়ে। 

ওদের মনেও ভীতি আছে 
বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না 
আঁধার নামে দুচোখ জুড়ে 
হয়তো ওদের রোজ জোটে না। 

বিষিয়ে গেছে মানবহৃদয় 
মরণ নাকি দিচ্ছে হানা
তাইতো সবাই বন্দি ঘরে 
বাইরে যেতে করছে মানা।

ছোট্ট শিশুর লকডাউন
তাপসী প্রামাণিক

লকডাউনে ছোট্ট শিশুর
ঘরের বাইরে যাওয়া মানা
কোত্থেকে যদি সুস্থ শরীরে
দুষ্টু করোনা দেয় হানা!

মা তাই কেবল সারাটা দিন
বাড়ির গেটে মেরে তালা
সহ্য করেন ছোট্ট সোনার
যত বায়না-আবদার-জ্বালা।

চেঁচামেচি শুনে তাই একদিন
পাড়া থেকে গল্পদাদু আসে
বলে, গল্প শুনতে বলতো ভাই
কারা ভীষণ ভালোবাসে?

গল্প দাদুর কথা শুনে কিন্তু
খোকাবাবু হল না রাজী,
আগে হবে যুদ্ধযুদ্ধ-খেলা
বললো পুচকে বিচ্ছু-পাজি।

এমন খেলা খেলব যাতে
ভাইরাসও পাবে খুব ভয়
তখন আমরা সহজে করব
এই ভয়ানক যুদ্ধ-জয়!

শত্রু যখন চোখের আড়ালে
এভাবে তাই তাড়াতে হয়
বারবার সাবানে হাত-পা ধুলে
যমরাজও যে পাবে ভয়।

শত্রু যখন চোখের সামনে
নিয়ে সর্দি-কাশি-হাঁচি,
গল্পদাদুর মুখে দরজা বন্ধ
পালিয়ে গেলেই বাঁচি।

এভাবে খোকা বড় সচেতন
টিভিতে দেখে আর শুনে
লকডাউন কাটায় মহানন্দে
বাড়ি বসে দিন গুনে।

আতঙ্ক

সুমিতা গাঙ্গুলি


করোনা করোনা করে বাড়ছে আতঙ্ক
এই ভয়ে ভীত হয়ে করেছে লকডাউন,
সেই উপায়কে সার্থক করতে চাই মনোবল
তাই সবাই মিলে করো সহযোগিতা
এটাই হল যে বাঁচার একমাত্র উপায়।
এই ভয়ে ভীত হয়ে মন্দির, মসজিদ, র্গীজার
ভগবান ও করেছে যে দুয়ার আজ বন্ধ।
সেই ভগবানকে দেখছি হাসপাতালে
আমাদের সেবায় তারা আজ নিযুক্ত।
সেই ভগবানদের সন্মান জানাতে
বাজাছি কাঁসর-ঘন্টা, থালাবাটি, আর হাততালি
পরের দিনই সংক্রমনের ভয়ে,
ঘর থেকে বার করে দিচ্ছে তাদেরই।
তবে এটাই কি তাদের প্রাপ্য? 
এটা অপমানিত না সন্মান জানানো?
মানুষ যে এখনো বুঝছে না —
কোনটা করা উচিৎ ,আর কোনটা করবে না,
সব সর্তকতা অবলম্বন করলেই,
বাঁচবে তোমার সঙ্গে সবার যে জীবন।
একটু ত্রুটি হলেই ডাক্তারকে করি গালমন্দ
আজ সেই ডাক্তার এগিয়ে এসেছে,
করে নিজেদের জীবন বিপন্ন।
আমি ভালো থাকলেই আজ হলো না
সবাইকে ভালো থাকতে যে হবে!
তাই সবাই মিলে চলো করি যে পণ
ভালো থাকলে তবেই বাঁচবে সবার জীবন।
তবেই হবে আমাদের ভারতবর্ষ করোনা মুক্ত।

লক

ঝিমলি ব্যানার্জী 


আমরা হয়েছি নিজের ঘরে নিজেরা লক!
অগত্যা চার দেওয়ালের মধ্যেই করছি বকবক ..
কাশির শব্দ শুনলেই মনটা করছে কোরোনার ভয়ে ধক ধক ..
অভাবের সংসারে আজ রেশন করছে ঢকঢক।
রাস্তা, রেলপথ সব ফাঁকা ...
হারিয়ে গেছে কোথায় যেন হকারের হাঁকা। 
বাজারে চলছে রব নেই নেই! 
দোকান রয়েছে খোলা ...
কিন্তু দোকানি বলছে, মাল নেই তোলা।
ভাবিনি কোনোদিন আসবে এমন দিন! 
বন্ধ হবে আমাদের হাঁটাচলা ..
দেখতে হবে কোরোনার ছলাকলা! 
করেছে আমাদের জব্দ ...
শুনতে পাচ্ছি প্রতিক্ষনে মানুষের মনে করোনা আতঙ্কের শব্দ। 
রাস্তার সারমেয়রা খাবারের জায়গাগুলোতে লোকের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাঁচতো! 
আজ তারা একটু খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক ..
পাই যদি একটু খাবার ..
বাঁচার ইচ্ছে জাগবে আবার। 
বাড়িতে কারোর আসতে মানা ..
চলবে এই নিয়ম একুশ দিন টানা।
মানুষের সাথে প্রকৃতিও যেন হয়েছে চুপ!
শুনতে পাচ্ছি না ওদেরও কোলাহল!
ওরাও যেন আমাদের আছে পাশে ...
সংকট কাটিয়ে সব্বাই যেন করোনা মুক্ত হাসি হাসে। 

উপেক্ষা 

জয়তী পাত্র প্রামাণিক 


বুকে হেঁটে চেরা জিভে
রাত নামে ছোবলে, 
প্রদীপ চোখের রেড়ি
মরে পুড়ে রাত নীলে!     

সাথীহারা রাতপাখি
বুনে চলে খড়কুটো,
রাতভোর পথ চেয়ে
নিভু নিভু চোখ দুটো! 

যন্ত্রণা মাথা কোটে 
ঘোর রোগ শয্যায়-
টেথিসের মনে জমে
অবহেলা লজ্জায় ! 

নকশিকাঁথার  ব্যথা
সুঁই বেঁধা আঙুলে
উপেক্ষা সে মহাদামী,
কেমনে তা যাই ভুলে?

বৈশাখ

মুকুলিকা দাস 


বৈশাখ, পৃথিবী আজ জরাগ্রস্ত!
তার শ্রেষ্ঠতম জীবেরা আজ পরাক্রান্ত।
এক অদেখা বিষ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব —
শাসিয়ে বেড়াচ্ছে তার আতঙ্কিত ছোঁয়ায়।
আজ আমরা ঘরবন্দী, আমাদের মন খাঁচাবন্দী পাখি।

বৈশাখ, তুমি কি মনে মনে খুশি?
তোমার কালের চক্রে অজস্রবার —
যে ধরিত্রীকে ধুঁকতে দেখেছো সভ্যতার যাঁতাকলে —
যার পায়ের নিচে পিষেছে চারপেয়ে প্রাণীরা,
তার ক্ষমতার দর্পে গলেছে হিমালয় —
শুকিয়েছে জলের ধারা, হারিয়েছে প্রাণসঞ্চার —
তারা, আজ স্বস্তিতে মাথা রাখে বসুধায়।

তোমার দাপটও হয়তো কমবে তাদের খুশিতে।
তোমার রুক্ষতায় হবে না খরা আর
সবুজে ঢাকা বন ভরে উঠবে আমের মৌ-ঘ্রাণে।
তোমার কর্কশতা ভেদ করেও কোকিল ডাকবে,
কালবৈশাখীর দাপট হয়তো কম হবে খানিক।

কিন্তু, আমার চারিদিকে যে মৃত্যুমিছিল, যন্ত্রণা, আতঙ্ক!
আমরা চোখ বুজে সুখবরের স্বপ্ন হাতড়াই।
তুমি কি আনবে না সে বারতা?
দূর করো ভয়, মুক্ত করো আমাদের শৃঙ্খল —
আমরা শ্রাবণের ধারার সাথে ঝরতে চাই!

কথা দিচ্ছি,আর ভুল হবেনা।
ধর্ম নিয়ে খেলা, রাজনৈতিক চুলোচুলি, মাটি, আকাশ, 
সমুদ্দুর নিয়ে দখলদারি-আর হবে না, দেখো। 
আমরা প্রকৃতির মান ভাঙাবোই,তারপর আসছে বছর —
তোমায় সাদা-লালে সাজাবো, কবিগুরুর সুরে গাইবো —
‘‘..বৎসরের আবর্জনা, দূর হয়ে যাক, যাক, যাক —
এসো, এসো...এসো হে বৈশাখ...এসো এসো।’’

জীবন্ত প্রকৃতি

সৌভিক দাস


বিশ্বজুড়ে করোনা ত্রাসে, মানুষ এখন জব্দ;
বর্তমানে মানুষ শুধু, ঘরেতেই আবদ্ধ।
প্রকৃতির সাথে ছেলেখেলা, করে চলেছি সর্বক্ষন; 
তাই তো এখন সময় কাটচ্ছি, ঘরেতেই বসে সারাক্ষন।
লকডাউনের এই খেলাঘরে, সব কিছুই কেমন অচেনা;
প্রকৃতির যে এমন রূপ, আগে যে ছিল অজানা।
এখন চোখ খুলে দেখতে পাবে, নীলাময় আকাশ;
এখন শ্বাস নিলে অক্সিজেন পাবে, দূষণহীন বাতাস।
এখন চারিপাশে শুধু নিস্তব্ধতা, হাইরোড সুনসান; 
এখন কান পাতলে শুনতে পাবে, পাখিদের কুহুতান।
এখন আনন্দে মেতেছে পতঙ্গেরা, নদী-পুকুরে মাছেদের খেলা;
এখন হাওয়ায় দুলছে কচি পাতারা, গাছে গাছে ফুলেদের মেলা।
বসন্তের এই প্রেমের ছোঁয়ায়, হয়েছি আমরা আশ্চর্য;
চারিপাশে ফুটে উঠেছে, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য।
প্রকৃতিকে নিয়ে ছিনিবিনি খেলা, করেছি আমরা সবাই;
চলো সবাই একজোট হয়ে, প্রকৃতিকে বাঁচাই।
প্রকৃতির সাথে জীবনকে মেলাবার, এই তো সুযোগ;
শুরু করি যোগের খেলা, ফেলে দিই বিয়োগ।
প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে আছে, জীবনের সমাধান;
চলো সবাই একসাথে গেয়ে উঠি, প্রকৃতির জয়গান।

যাঁতাকলে

বিমান প্রামানিক

বসে আছি সারাদিন
এখন যেন কর্মহীন 
সবাই এখন দীন
অবস্থা বড়োই কঠিন। 

                  দিনের শেষে চিন্তা 
                  সবার একই অবস্থা
                  কোথাও নেই আস্থা
                  কে কাকে সহযোগিতা?    

গ্রামের তাঁতি সমাজ 
ভীষণ চিন্তায় আজ 
কাজে যেন সাঁজ 
সবার কপালে ভাঁজ। 

                    গৃহশিক্ষক আছেন যত
                     সারাজীবন দানে রত
                     তাঁরা এখন চিন্তিত
                    আমিও তাদের মতো।
চালাই যারা গাড়ি
কাজ নেই জারি
এখন সবাই বাড়ি
ভয়ংকর এই মহামারি।

চাষীভাই জমি ছেড়ে 
বন্দি এখন ঘরে
নিজেই বিনা খাবারে
সবার পাশে সারাবছরে। 

রাজমিস্ত্রী শ্রমিক যত 
কর্মহীন শত শত 
বাড়িতেই এখন আবদ্ধ 
‘করোনা’য় সব শঙ্কিত। 

মুদিওয়ালা এখন পাশে
দুধওয়ালা সাথে আছে
সব্জীওয়ালাও তাদের মাঝে
আমাদের জীবন বাঁচে। 

এখন ডাক্তারবাবু যত
ঈশ্বর-আল্লাহর মতো
সারাক্ষণ সেবায় ব্যস্ত  
কখনও নয় বিরত। 

যত পুলিশ প্রশাসন 
সর্বদা করেন সচেতন
শহর-গ্রামে যান
সকলকে ঘরে ফেরান।

এক ফালি আকাশ

মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় রায়


প্রথমেই ছুটে যাবো তোমার কাছে
আমার হাঁটু তে যদিও অস্টিও অর্থরাইটিস
সব ব্যথা উবে যাবে সন্ধ্যার স্নিগ্ধতায়।

ব্লু জিন্সে পার করে দেবো কাজল মাখা পথ
কালবৈশাখীর দাপটে স্ট্রিট লাইট নিভে গেলেও
তোমার চোখের তারায় পরে নেবো সব বন্দিদশা।

নিয়ম যখন চাউর হয় তখন মুখে মুখে ফেরে শব্দের বাহার।
বছরে কটা দিন জুতো জোড়া ব্যবহার হতো মা জানতো।
অথচ মা জানতো না লকডাউন কী?
 
গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতো আইসোলেশন।
এক ভর্তি পরিবারে দিন গুজরানের সাথেও যে আইসোলেশন হওয়া যায় 
সেটা বুঝতে কোনো লকডাউন লাগে না।

জানলার খড়খড়ি পৌঁছে দিতো এক ফালি আকাশে
সেখানে নিত্য নুতন উপন্যাস লেখা হতো।
 শ্রাবণের ধারায় দেবদারু গাছের চুপচুপে ভিজে যাওয়া 
পাতাগুলো যেন  পিঠের উপর ছড়িয়ে থাকতো।
গাছ ও মা জীবনের খেলাচলে বুক ভরা শ্বাস নিতো।

এক ফালি আকাশ আমার ও সব নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে দেয়।
আমি অনায়াসে সারা দিনরাত ওই নীল পালিশে 
রঙিন হয়ে থাকতে পারি।

আমরা লড়ছি

অশোক কুমার আচার্য্য


বাঁচার লড়াই কেমন তা বুঝিয়ে দিল করোনা
যারা আক্রান্ত হলো তারাই কেবল জানল না,
যারা কোয়ারেনটাইনে আছে তারাও জানল
সবাই জানতে পারল, কেবল স্রষ্টা জানে না।

একবার যদি কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়
বাঁচার আশা থাকলে ও থাকতে পারে,
সবাই যে মরে যাবে তা হয়তো নয়-কিন্তু;
লড়াইটা লড়তে হবে একাকে বাঁচার জন্য।

উহান দেখিয়ে দিয়েছে মৃত্যু মিছিল কাকে বলে
আমেরিকা লড়ছে মৃত্যু মিছিল কমানোর লক্ষ্যে,
আমরা লড়াইয়ে আছি কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে
মৃত্যু মিছিলে শামিল না হওয়ার ভয়ে।

ভোরের সূর্য

পূর্ণিমা মণ্ডল


এখন আর রাতে ঘুম আসেনা 
রাত জাগা পাখিরা ডানা ঝাপটায় 
আর আমি খোলা জানলায় তাকিয়ে থাকি
ভোরের প্রতীক্ষায় নতুন সূর্য ঠিক উঠবে। 
আমার চোখে আজ সাদা কালো আগমনীর স্বপ্ন 
কোন রূপকথার দেশ, যেখানে আমার অভিমানরা
সবুজ হয়ে বেঁচে থাকে মৃত্যুখাদের পাশে, 
আমার ইচ্ছাগুলো ঝটফট করে সোনার খাঁচায়, 
আমার খুশিরা নোনাজলে ভেসে যায় মৃত্যুপুরীতে। 
খুব যন্ত্রনা হয়, চিৎকার করি, এ কোন রূপকথার দেশ? 
হয়তো সূর্য এখনো ওঠেনি, এখনো ঘোর অন্ধকার। 
আমি জানি অন্ধকার কেটে নতুন ভোর আসবে 
সেই ছোট্ট ছেলেটা আবার কাঁদতে কাঁদতে স্কুল যাবে, 
সকালে কোন মা উনান জ্বালিয়ে ভাত রাঁধবে, 
হয়তো মাছের বাজারে আবার চিৎকার হবে, 
চায়ের দোকানে রাজনীতি নিয়ে তর্ক উঠবে, 
আবার হয়তো অফিস টাইমে বাসে ট্রেনে সব ঝুলবে, 
ক্যালেন্ডারের প্রতি শুক্রবার সাহিত্য আড্ডা হবে, 
হয়তো সেই ছেলেটা আবার মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করবে, 
মিথ্যে পড়ার নাম করে মেয়েটা পালিয়ে যাবে সিনেমা, 
হঠাৎ স্বপ্নটা কাঁচের জানলার মত ঝনঝন করে ভেঙে যায়..... 
খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পূবে নতুন সূর্য
রাঙিয়ে নিয়ে ভোর আসছে..... নতুন প্রভাত...... 

মহামারি ও মন্বন্তর 

প্রশান্ত কুমার শীল 


মহামারির করাল রূপ 
আমি চোখে দেখিনি কখনও। 
দেখিনি মন্বন্তরের ভয়াবহতা।
দেখিনি ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার।
ইতিহাসে পড়েছি শৈশবে।
অর্থ বুঝিনি এর।
পরীক্ষায় পাশ করার তাগিদে 
মুখস্থ করেছি মনোযোগ দিয়ে।
আজ বোধহয় সময় এসেছে বোঝার।
আমরা বোধহয় পৌঁছে গেছি যুগসন্ধিক্ষণে।
তাই, জীবকুলের শ্রেষ্ঠ মানবজাতি 
আজ পরাজিত এক ক্ষুদ্র অনুজীবের কাছে।
চারিদিকে শুনি হাহাকার রব।
রাস্তার দুপাশে পড়ে থাকে মৃতের স্তূপ।
লোক নেই শবদেহ দাহ কিম্বা কবর দেবার।
একেই কি বলে মহামারি ?
মহামারির অন্তিম রূপ কি মন্বন্তর? 
তবু বেঁচে আছি আজও।
প্রত্যক্ষ সাক্ষী রইলাম আমি 
এই ভয়াবহ ধ্বংসলীলার।

কোজাগরী চোখ

তাপসী শতপথী পাহাড়ী



সবাই  যখন চুপটি করে এগিয়ে এলে তুমি,
পড়লো ঝাঁপি মন্দিরেতে মন্ত্র না আর শুনি।
বিজ্ঞ এবার প্রমাণ দিল জ্ঞান, নয় ধর্ম!
প্রাণ বাঁচাতে তারাই পারে দিয়ে তাদের কর্ম।
রোগীও আজ বেঘোরে ঘোরে খুঁজছে তাদের হাত,
তারাও জানে ঐশীবাদে কাটবে না এ রাত।
ভরসা শুধু রাত জাগা চোখ, ঐ হসপিটালের ঘরে
লড়ছে যারা মরণপণ জীবন তুচ্ছ করে।
ভাবছে না তো নিজের বাঁচা,  নিজের পরিবার,
শুধুই জানে সেবার সাথে পরের উপকার।
চোখগুলো তাই ত্রস্ত হয়ে হসপিটালের ঘরে,
ঘুরে বেড়ায় অহর্নিশি  জীবন দানের তরে।
অবতারের রূপ নিয়ে আজ দাঁড়ায় শুধুই তারা।
হয় তো শপথ, লড়াই করে হবে সর্বহারা!
হয়তো অনেক মার খেয়েছো, অনেক তিরস্কার,
আজ কিন্তু সবাই নত জানায় নমস্কার।

লকডাউনের দিনযাপন

মিতা ঘোষ


ছোট্ট মাটির বাড়ি, উঠোন ভরা হরেক ফুলের গাছ,
অভাবের সংসারে দিনমজুর স্বামীর হাঁড় ভাঙা খাঁটুনির কাজ।
সুখের অভাব তবু শান্তির নেই কমতি,
সন্তানদুটি আনন্দে করে সারাদিন মাতামাতি।
ফুলের যত্ন করত উমা,ঠিক যেন ওর আপনজন,
এক নিমেষে মিলিয়ে যেত শত অভাব অনটন।
হঠাৎ ধেয়ে এল শত শত রক্তবীজের বাণ,
এক থেকে শুরু করে গিলে নিল হাজার হাজার প্রান।
দরজা বন্ধ করো,রক্তবীজকে ঘেষতে দিও না কাছে,
কদিন চলবে সংসার,ঘরে তো অল্প খাবারই আছে।
ঘরেতে বন্দী,আয় নেই,বাইরে যে মৃত্যু ভয়,
এভাবেই হবে ধীরে ধীরে রক্তবীজের পরাজয়।
সন্তানসম ফুলগুলোর মালা গেঁথে উমা রাস্তায় যায়,
ছেলেমেয়ের মুখে অন্ন জোগাবে সামান্য পয়সায়।
জানে না উমা উঠবে কবে এ ভয়ের লকডাউন,
আবার উঠবে নতুন সূর্য,আসবে নিস্কলুষ ফাগুন।

দোরোখা লকডাউন 

অর্ণব কুমার রায়


দিবারাত্র ঘূর্ণাবর্তে সকলেই ঘুরছে,
ঘুরছে জল, ঘুরছে স্থল আর অন্তরীক্ষ।

কোটি কোটি ঘূর্ণির পরিধিতে হঠাৎই ব্যারিকেড বসিয়ে,
লাট্টুর পাকে আজ নিজেই ঘুরছে আগন্তুক করোনা।
অপ্রতিরোধ্য! এক দেহ থেকে ছুটছে সে দেহান্তরে।
অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ভৌগোলিক সীমারেখা —
সবই তার পদতলে লুটিয়ে পড়েছে-মিনতি করছে!
তারই কষাঘাতে দুর্বল হয়েছে অর্থ, নাম, যশ, প্রতিপত্তি।
রোজই তার চক্রব্যূহে নিধন হচ্ছে হাজারে হাজারে প্রাণ।

কে দেবে বল?কে বাঁচাবে এই রণাঙ্গনে?
কে আছে?কে রুখবে এই প্রাণের লুন্ঠন?
ধর্মের দ্বার যে আজ রুদ্ধ, জ্ঞানের আলোও ক্ষীণ!
এখন প্রতিকার একটাই — সেই রক্ষণাত্মক লকডাউন!

ধরণী আজ উৎফুল্লিত, ঘুরছে সে আপন গতিতে!
প্রকৃতি ভরপুর অকৃত্রিম সুরের মূর্ছনায়।
নদ-নদীগুলো বন্ধনহীন, স্ফটিক জলে পরিপূর্ণ।
বাতাসও বিষমুক্ত-সুরভিত, পরিশ্রুত পুষ্প ঘ্রাণে।

অন্দরে-অন্দরে রচিত এক একটি পৃথিবী।
সংকুচিত ঘেরাটোপেও সেথায় চলছে ঘূর্ণাবর্ত।
নাগপাশে আবদ্ধ-সন্ত্রস্ত, দমবন্ধ এ জীবন!
তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো চেয়ে আছে আকাশ পানে।

লকডাউন

সবুজ সরকার


পাখিদের  ঝগড়ার মাঝে নাক গলাতে নেই 
বরং দূরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে হয়।
পাখিদের ভালোবাসার মাঝে নাক গলাতে নেই
বরং দূরে দাঁড়িয়ে মেপে নিতে হয় জিয়ন কাঠি
বুঝে নিতে হয় নিজের পাল্লা কতটা ভারী
আপনার আকাশ কেন আজ অহেতুক গোলাপি।

পাখিরা স্নান করলে নিজেকে ভেজাতে নেই
বরং দেখে নিতে হয় কেমন করে আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে হীরক কুচি,
ঝরে পড়ছে প্রাণ, ঝরে পড়ছে বাতাস।

পাখিরা ছবি আঁকলে হাতে মাখতে নেই রং 
বরং ভ্যানগগ কে পাশে বসিয়ে এঁকে নিতে হয় তারায় ভরা আকাশ আর হলুদ গম ক্ষেত।

আসলে আমরা সবাই পাখিদের মতোই বাঁচি,
সতর্ক, একটু অসতর্ক; হিসেবী আর অনেকটা বেহিসেবী।
আসলে বাঁচাটা একটা মস্ত বড় খেলা
একটা মস্ত বড় গোল্লাছুট 
ততক্ষণ,
যতক্ষণ আপনার দাম আছে।

ব ড়  গ ল্প  

লকডাউন

দীপক আঢ্য


    
অসীম সতুর বয়সী। এখনও পঁচিশ ছাড়ায় নি। যেমন রোগা তেমন লম্বা। ঠিক যেন সতুর বিপরীত। সতু তার প্রতিবেশী বন্ধুও।
    ওই তো, আসছে। ছ’জনের মধ্যে থেকে কথাটা যে কে বলল, তা বোঝা গেল না। দেখা গেল ছ’টা মাথা একই সঙ্গে ইটভাটার গেটমুখো নজর। আধলা ছড়ানো এটেল মাটির এবড়োখেবড়ো লাল পথের উপর দিয়ে ঝনঝন শব্দ ক’রে এগিয়ে আসছে সতু আর অসীমের ভ্যান। দূর থেকে ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে ছ’জনের বারোটা হাত থমকে যায় মুহূর্তে। এই চৈতি রোদে ইটভাটায় রাভিস ওড়ে ঠিকই। মাঝেমধ্যে দম নেওয়া দায় হয়ে পড়ে। তাই বলে মুখে এরকম মাস্ক বেঁধে আসতে দেখেনি কেউ কাউকে। সময় বিশেষ দু-একজন রুমাল জড়ায় বড়োজোর। তাই বলে মাস্ক! অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে দুজনের মুখে হালকা সবুজ রঙের মাস্ক বাঁধা। নাকের উপরের অংশ কেবল দৃশ্যমান। চোখ দুটো যেন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে অন্যের নজর। 
    সতু আর অসীমের ভ্যান এসে কাঁচা ইটের স্টকের কাছে এসে দাঁড়াতেই রহিমচাচা বলে, কী রে, মুখে ঠুসি লাগায়ে এলি কেন? কার ক্ষেতে মুখ দিতে গেছিলি?
    ছ’জনের বারোপাটী দাঁত বিকশিত হল সঙ্গে সঙ্গে। দমকা বাতাসের মতো হাসির রোল উঠল কাঁচা ইটের চাতালে। 
    নিজের ভ্যানটাকে পিছন দিক ক’রে কাঁচা ইটগাদার সঙ্গে লাগাতে লাগাতে সতু বলে, তোমরা কোন দেশের লোক গো? দেশ-বিদেশের খোঁজ খবর রাখো কিছু? দেশে মহামারী আসছে। খোঁজ রাখো সে সব সম্পর্কে? 
    একটু আগে দাঁত বের করা রহিমচাচা ভ্যানে ইট তুলতে তুলতে যেন একটু শ্লথ হলো। শ্লথ হলো হারান, দুলে, জামাই আরও সকলে। রহিমচাচা বিস্ময়ের স্বরে বলল, ম-হা-মা-রী? 
    তবে আর বলছি কি? ডানহাতের নখ দিয়ে আলতো ক’রে মুখের ‘পরে আটকানো মাস্কটাকে আলতো ক’রে নামিয়ে যেন প্রাণ ভ’রে শ্বাস নিল সে। তারপরে সংযত হয়ে বলল, তা নয় তো আর বলছি কী। হাতের কাজ থামিয়ে শোনো, খুব খারাপ সময় আসছে। খুব খারাপ। মানুষের শরীরের মধ্যি দিয়ে বিষ আসছে। ভাইরাস-বিষ। যার শরীরে এই ভাইরাস আছে সে যদি তোমাকে ছুঁয়ে দেয় বা তার হাঁচি-কাশি তোমার গায়ে এসে পড়ে, তাহলে আর দেখতে হবে না। মাত্র চোদ্দ দিনের মধ্যে সব শেষ। এর মধ্যে চীনে এই রোগে কতজন মরেছে তোমরা জানো? তিন হাজারেরও বেশি। ইতালি শেষ। জার্মান, ফ্রান্স সব জায়গায় মড়ক লেগেছে। আর এই মড়ক রোগের কোনও ওষুধও নেই। কেবল দূরে দূরে থাকা।আর কাউকে না ছোঁয়া। ব্যাস! রোগ খতম। আমাদের দেশেও এসে গেছে এই রোগ। দেখো না, সরকার এই নিয়ে সোরগোল করল বলে। সমস্বরে যেন একটাই কথা বের হলো, সে কী? তাই! জানিনে তো! 
    জানবা কী ক’রে? সিরিয়াল ছাড়া বাড়ির টিভিতে দেখো আর কিছু? খবরের কাগজে চোখ রেখেছো কোনোও কালে? এ তো আমি আর বানায়ে বানায়ে বলতিছি না। কালকের আনন্দবাজারে সব দিছলো। রাত্রে টিভিতে একঘণ্টার অনুষ্ঠান হয়েছে এই নিয়ে। তোমরা যদি খাও আর হাগো আর যদি কোনোও     খোঁজখবর না রাখো, তাহলে আর কী হবে বলো?
    হারান কিছুটা ভড়কে গিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে, তাই যদি সত্যি হবে , তাহলে তো সব্বনাশ। সব্বনাশ হবে কিনা জানিনে, তবে সর্বনাশের খুব বেশি আর বাকি নেই। তবে বাঁচতে যদি চাও, যা বললাম তাই কোরো।

*****

    আজ সতু আর অসীম সকলের আগেই এসে পৌঁছে গেছে। বাঁ দিকের পাড়নে পাতাইদারদের সকলের মুখ ঢাকা। কারোর রুমাল দিয়ে, কারোর বা মাস্ক দিয়ে। সেদিকে তাকিয়ে অসীম ঈশারা ক’রে বলে, দেখছিস, মরার ভয় সকলের আছে।
    তা থাকবে না কেন? তবে রোগে মরবে না না খেয়ে তা কে জানে।
    কেন? 
    সরকার সব বন্ধ ক’রে দিতে পারে। বড় ছোঁয়াচে এই রোগ। সেই জন্যে। 
    আমাদের ভাটাও? 
    কেন? আমাদের ভাটা কি পৃথিবীর বাইরে? নাকি আমাদের এখানে ওই ভাইরাস আসতে পারবে না? 
    কী জানি! তবে ভয় হচ্ছে। 
    কি মরার?
    তার থেকে বেশি যদি ভাটা বন্ধ হ’য়ে যায়? দাদনের টাকা শোধ হয়নি এখনও। বাজারে প্রায় পনেরো হাজার টাকা দেনা। ঘরে চাল ডাল বিশেষ কিছুই নেই। সবই কেনার লাগবে। 
সে ভয় কি আমার নেই? আমারও তো... তুই তো জানিস সবই। সতুর দীর্ঘশ্বাস যেন আরও দীর্ঘ হ’য়ে ওঠে। 
    সকালের কাজের ঝুল শেষ হ’লে, আজ আর কাউকেই বলে দিতে হলো না, সরে সরে থাকার জন্যে। একটু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে সকলের মুখ থেকে খসে পড়েছে মাস্ক আর রুমাল। পান্তার কৌটোর দিকে হাত বাড়ানোর আগে সকলেরই নাইলনের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পড়ল সাবানের টুকরো। ভাটার পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আজ যেন অনেকটা বেশি সময় লাগছে সকলের নিজেকে পরিষ্কার ক’রে নিতে। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সতু ভাবে, সে নিজেও কতো বার ওদেরকে এইভাবে হাতে সাবান দেওয়ার কথা বলেছে। কথা শোনেনি কেউই। জন্মগত অভ্যাসের বাইরে একটুও ফিরে তাকায় নি কেউ। শালারা নিশ্চয় কাল টিভি দেখে শিখেছে। এখন টিভিতে তো এই একটাই দেখানোর জিনিস। নিজেকে পরিষ্কার রাখো – নিজেকে দূরে রাখো। মনে মনে খুশি হয় সে।
    তোমাদের সকলের সঙ্গে কথা বলবো না কি কেউ একজন আসবে?  অফিস ঘরে আসতে হবে। বাবু ডেকেছে। হঠাৎ মুহুরিমশাইয়ের গলার শব্দে সতুর সঙ্গে ঘাড় ঘোরায় হারান, দুলে, জামাই, রহিমচাচা,অসীম আরও সকলে। সতু কিছু বলার আগেই ওরা সকলেই বুঝতে পারে কী হতে যাচ্ছে। ইটভাটা যে সরকারি আদেশে বন্ধ হতে যাচ্ছে সে কথা ইতিমধ্যে ভাসছে বাতাসে। সারাক্ষণ উৎকণ্ঠার ছাপ দেখা গিয়েছে কাঁচা-বেলদার, পাতাইদার, বাঁকিদার সকলের চোখেমুখে। সতু মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই অসীম বলে ওঠে সকলে গিয়ে ভিড় বাড়িয়ে কী হবে? সতু যাবে আমাদের সকলের হয়ে। মৃদু গুণগুণ শব্দে অন্যদের থেকেও সে সম্মতি পাওয়া গেল তৎক্ষণাৎ। 

*****

    খাঁ খাঁ  রোদ্দুর ছেড়ে  সেটঘরের পাশ বরাবর পথ ধরে ইটভাটার অফিস ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই যেন প্রাণ ফিরে পেল সতু। বড়-পাতার মেহগনি গাছ কচি-সবুজ পাতায় পূর্ণ। অফিস ঘর ছায়া ক’রে রেখেছে সেই কিশলয়। অন্যদিন এই সময়ে অফিস ঘরের দরজা প্রায় বন্ধই থাকে। বাবুরা ছাতা মাথায় ঘুরে বেড়ায় পাড়নের এমাথা ওমাথা। এখান থেকে ঝোঁকাই মিস্ত্রির ঘরের কাছে যেন আগুনের হলকা উঠছে। একঝলক সে দিক থেকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সতু। ঘরের ভিতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সেখানে আজ বাবুরা অনেকেই। তপুদা, তপনবাবু, ম্যানেজার আরও দু-চার জন। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে ফুল স্পীডে। ঘরে টিউবলাইটের সাদা আলো দূর করে দিয়েছে আনাচকানাচের অন্ধকারও। তবুও সতুর মনে হয়, সকল মুখগুলোই যেন বিষাদ-মাখা হয়ে আছে। দুশ্চিন্তার ভাঁজ সকলের চোখেমুখে। সতুকে দরজার সামনে দেখে অনেকগুলো মুখ একসঙ্গে তাকালো তার দিকে। মুহুরিমশাই যেন পরিচয় করানোর ভঙ্গিতে বলল, এ হলো সতু। কাঁচামাল টানার ভ্যানের হয়ে এসেছে।
    তপনবাবু মুহুরিমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এদের হিসেব কমপ্লিট?
    হ্যাঁ, আমি সব করে রেখেছি। এরা সংখ্যায় আছে মোট আটজন। আটজনের দাদন দেওয়া আছে তিন-হাজার টাকা করে মোট চব্বিশ হাজার টাকা। এর মধ্যে কাটা হয়ে গিয়েছে একহাজার টাকা করে। অর্থাৎ আমরা পাবো ষোলো হাজার। আর এই হপ্তায় কাজ করেছে গড়ে হাজার-টাকা। তারমানে আমরা এখনো আটহাজার তাকা পাবো। 
    তাহলে তো এদের কিছু দিতে হচ্ছে না।
    সেই রকমই তো আমরা ঠিক করেছি, বলল মুহুরিমশাই।
    তাহলে তুমি কিছু বুঝলে সতু? একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল তপনবাবু। নিশ্চয় শুনেছো, করোনা ভাইরাসের কারণে ইটভাটা বন্ধ ক’রে দিতে হচ্ছে। দেখছই তো, এখনও পাড়নে আটখানা স্টক আছে। কিন্তু সরকারি আদেশ, কাজ বন্ধ করতেই হবে। আবার যখন খুলবে, তখন তোমাদের এই হিসেব থেকেই কাজে নেওয়া হবে। এবারের মতো...
    একটা কথা বলি?
    হ্যাঁ, নিশ্চয়।
    ইটভাটা যে বন্ধ হবে তা যেমন শুনেছি, এটাও শুনেছি যে অসংগঠিত শ্রমিকদেরকেও মালিক-পক্ষ সহানুভূতির সঙ্গে দেখবে। সেটাও সরকারি কথা। মুখ্যমন্ত্রীর কথা। তা আপনারা আমাদের কী সহানুভূতির সঙ্গে দেখলেন তা বুঝলাম না। আমাদের প্রাপ্যও দিচ্ছেন না। দাদনের টাকা কাটার সময়সীমা তো জ্যৈষ্ঠমাস। চৈত্র মাস না। তাহলে?
    তপুবাবুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উদ্গীরণ। হঠাৎ যেন তপনবাবুও বাকরহিত। অফিস টেবিলের তিন ধারে চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলোর সকল চোখ কেবল সতুর মুখের উপর নিবিষ্ট। কয়েক মুহূর্ত ঘরের ভিতরে নৈঃশব্দ্যের স্থিরতা। কেবল ইলেকট্রিক ফ্যানের ফরফর সচলতার শব্দ। দরজার ওপাশে আরও কিছু মানুষের চাপা কণ্ঠস্বর। আনত মুখ নিয়ে সামনের চেয়ারে সতু একমনে কাচ-টেবিলের কভারের তলায় ফুটে ওঠা বিভিন্ন লরির নম্বর আর মালিকের নামের দিকে বুলিয়ে চলেছে তার চোখ। 
    নৈঃশব্দ্যের কাঠিন্য ভেঙে তপনবাবু বলল, খুব ভালো গুছিয়ে কথা বলো তো তুমি।
    আনতমুখ সামান্য উঁচু করল সতু। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি জল ফড়িঙের দাগের মতো সামান্য ঢেউ তুলেই হারিয়ে গেল সমগ্র মুখাবয়বে। 
    তাহলে সতু, আরও সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি বলো, তোমাদের জন্যে আমাদের ভাটা আর কী-বা করতে পারে?
    মুখটা এবার সম্পূর্ণ উঁচু করল সতু। তপনবাবুর চোখে চোখ রেখে বলল, চাওয়ার বিশেষ কিছু নেই। একতাই কথা। নতুন ক’রে কোনোও দাদনের টাকা কাটা যাবে না। আর কাজের বকেয়া যা আছে তা মিটিয়ে দিতে হবে আজই। এরপরে যদি কোম্পানি আমাদের জন্যে বিশেষ কিছু ভাবে তা আমরা সাগ্রহে গ্রহণ করবো। 
    তাহলে...কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তপুবাবু। তাকে থামিয়ে দিয়ে তপনবাবু বলল, থাক। সতুর কথার যুক্তি আছে। তাছাড়া আমাদের ভাটা আজ পর্যন্ত কোনোও লেবার কে অখুশি ক’রে ছাড়েনি। তা আজই বা এই দুঃসময়ে করব কেন? সতুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যাও। বিকেলে তোমরা মুহুরিমশাইয়ের কাছ থেকে সই-সাবুদ ক’রে টাকা নিয়ে যেও।
    আচ্ছা। উঠলাম তাহলে। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো তপনবাবু, তপুবাবু। চেয়ার ছেড়ে বাইরে মুখ রাখতেই সতু দেখে বারান্দার নিচে গাছতলায় হাসি হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে হারান, দুলে, জামাই, রহিমচাচা,অসীম আরও সকলে। ওদের দিকে তাকিয়ে একটু অবাকই হলো সতু। যেন ওদের চোখে সত্যি সত্যিই লিডার বনে গিয়েছে সে। আসন্ন বিপদের তেমন কোনোও চিহ্ন যেন এই মুহূর্তে নেই। আজ বাদে কাল থেকে যখন লকডাউন শুরু হবে আর ওদের কোনোও কাজ থাকবে না, সামনের হপ্তা থেকেই যখন উনুনে হাঁড়িতে চড়ানোর মতো থাকবে না কিছুই, তখন কী করবে এই সহজসরল মানুষগুলো, একথা ভাবতে ভাবতে ঝাপসা হয়ে আসে তার চোখ।

ধা রা বা হি ক  উ প ন্যা স 

কর্কটক্রান্তি

অমিতাভ দাস


উৎসর্গ:-যারা লড়েছিল,যারা লড়ছে আর যারা লড়বে তাঁদের সকলকে

 ১

"শরীর জুড়ে বিষের ছোবল 
রুদ্র রোষে মৃত্যু নাচে
তবুও স্বপ্নে জীবন কেবল
হারতে হারতে জিতেই বাঁচে।"
  
       জয়িতার হাতে ধরা সি.এ. ১২৫ রিপোর্টটা এখনো থরথর করে কাঁপছে। যেখানে সাধারনতঃ ০ থেকে ৩৫ পর্যন্ত রেঞ্জ হওয়া উচিত সেখানে জয়িতার রিপোর্টে এসেছে ১১৫। সকাল থেকে লাইন দিয়ে রিপোর্ট নেওয়ার পর ‘১১৫’ সংখ্যাটা দেখে কেমন যেন মাথা ঘুরে গেছিল জয়িতার। হাতের কাছে থাকা দেওয়াল ধরে সামলে নেয়, হাসপাতালের যে কর্মচারী রিপোর্ট দিচ্ছিল সে বলে, কি হল দিদি, শরীর খারাপ লাগছে নাকি? সঙ্গে কেউ নেই? জয়িতা না সূচক মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে যায় স্ত্রী রোগ ও প্রসূতি বিভাগের দিকে। দু মিনিটের পথ যেন অনন্ত মনে হয় জয়িতার কাছে। সেখানে গিয়ে প্রেসক্রিপসান জমা দিয়ে চোখ বোজে সে। গত দেড় মাসের ঘটনাবলী চলতে থাকে চোখের সামনে।
    ঋতুস্রাবের ক্ষেত্রে সময়ের বা ব্লিডিং এর কোনো তারতম্য নারীত্ব প্রাপ্তির দিন থেকে এত দিন পর্যন্ত কোনোদিন টের পায়নি জয়িতা। আগের মাসে স্রাব শেষ হওয়ার ঠিক পাঁচ দিন পরে আবার ব্লিডিং শুরু হয়ে যায় জয়িতার। ঘাবড়ে যায় সে, ষাটোর্ধ্ব বাবা আর প্রায় ষাটোর্ধ্ব মায়ের এমনিতেই দুঃশ্চিন্তার কারন বত্রিশের অবিবাহিতা জয়িতা আর তার নীচের দুই বোন। তাই আর মাকে জানিয়ে চিন্তা বাড়ায়নি সে। একা একাই চলে গিয়েছিল বাড়ির কাছাকাছি এক স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। তারপর থেকে দ্রুত ঘটে গেল অনেক কিছুই। আলট্রা সোনোগ্রাফি, নানান রক্ত পরীক্ষা এবং নিঃশব্দে জড়ায়ুতে বেড়ে ওঠা প্রায় কমলালেবুর সাইজের টিউমারটার অস্তিত্বর ঘোষনা। আর প্রথমেই মনে হয়েছিল তার মাসিক ছ’হাজার টাকা বেতনের বেসরকারী চাকরীটা বোধহয় আর থাকবে না। তাঁর অফিসের বস খুব কড়া এমনিতেই ডাক্তার দেখাতে একদিন কামাই হয়েছে তারপর এর চিকিৎসা। জয়িতা সরকার.... একটা কর্কশ গলার ডাকে চটক ভাঙে জয়িতার।
    হ্যাঁরে সি.এ.এর পুরো কথাটা কিরে তোর স্মার্ট ফোনে দেখে একবার বলে দিতে পারবি শর্মি? জয়িতা ফোন করে জানতে চায় শর্মিষ্ঠার থেকে, শর্মিষ্ঠা জয়িতার স্কুলের বন্ধু আর ওই এ চাকরীটা করে দিয়েছে জয়িতাকে। শর্মিষ্ঠার বাড়ির অবস্থা জয়িতার থেকে কিছুটা ভালো আর কিছুদিন আগেই ও একটা কমদামী স্মার্ট ফোনও কিনেছে। জয়িতাকে এখনও আনস্মার্ট ফোনেই অর্থাৎ বোতাম টেপা ফোনেই কাজ চালাতে হয়। শর্মি বলে, সি.এ. মানে চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, নারে তা নয় জরায়ুর টিউমারের ক্ষেত্রে সি.এ. মানে কি? আসলে তুই তো জানিস আমার ইউ.এস.জি রিপোর্টে টিউমার ধরা পড়েছে আর আজ হাসপাতালে দেখাতে গিয়েছিলাম ওখানে থেকে বেশ কিছু ব্লাড টেস্ট দিয়েছে তার মধ্যে একটা দেখলাম লেখা আছে সি.এ.। আগে তো এই ধরনের ব্লাড টেস্টের নাম কোনোদিন শুনিনি তাই জানতে চাইছি আরকি। পাঁচ মিনিট বাদে শর্মি আবার ফোন করে জয়িতাকে, বলে জয়ী কবে রিপোর্ট দেবে এই রক্ত পরীক্ষা গুলোর? কেন বলতো? জয়ী সি.এ. কথার অর্থ ‘ক্যান্সার অ্যান্টিজেন’। জরায়ুর টিউমারের ক্ষেত্রে এই টেস্ট দেওয়া হয়। তুই যেদিন রিপোর্ট আনতে যাবি আমি যাব তোর সাথে।
    ওয়েট আর প্রেসার মাপা হলে জয়ী বসে ডাক্তার দেখাবার লাইনে। ইতিমধ্যে শর্মিষ্ঠাও এসে গেছে জয়ীর কাছে। তুই সেই অফিস কামাই করলি শর্মি! জয়িতা কপট রাগ দেখায় শর্মিষ্ঠাকে। শর্মিষ্ঠাও একটা চড় দেখায় তার অন্যতম প্রিয় বন্ধুকে। কর্কশ স্বরে হাসপাতালের একজন চতুর্থ শ্রেণির মহিলাকর্মী শর্মিকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনি বাইরে পেশেন্ট পার্টির মধ্যে গিয়ে বসুন ভেতরে শুধু পেশেন্ট থাকবে, প্রয়োজনে ডেকে নেওয়া হবে আপনাকে। শর্মি একটা ভরসার হাত জয়ীর কাঁধে রেখে বলে, বাইরে বসছি, প্রয়োজন হলেই ডাকিস! প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কতসময়েই না শর্মিকে ডেকেছে জয়ী। বড় বাজারের এক মাড়োয়ারীর অফিস যেদিন ষাট বছর বয়স্ক বাবাটাকে ‘শালা বুড়া বেওকুফ আদমি’ বলে প্রবল অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হল আর বাবা বাড়ি এসে অপমানের যন্ত্রনায় হাউহাউ করে কাঁদছিল সেদিনও বাবাকে সামলাতে জয়ী ডেকেছিল শর্মিকে। তারপর এই চাকরিটাতো শর্মিরই বদানত্যায়। মাস গেলে ছ’হাজার টাকা জয়ীর কাছে অনেক কিছু অনেক অনেক....।
জুনিয়ার ডাক্তারবাবু সমস্ত রিপোর্ট দেখে, জয়ীকে জিজ্ঞাসা করল সঙ্গে কেউ আছে? শর্মির সাথে জয়ী ঢুকলো সিনিয়র ডাক্তারের ঘরে। সমস্ত রিপোর্ট দেখতে লাগলেন তিনি আর জয়ী দেখতে লাগল তার ভ্রু যুগলের ওঠা নামা।
    তারপর প্রশ্ন ছুটে এল কত তাড়াতাড়ি ভর্তি হতে পারবেন অপারেশনের জন্য?

                                                          ক্রমশঃ....





ইলশেগুঁড়ি প্রকাশনের একগুচ্ছ বই




মহালয়ার আগেই প্রকাশিত হবে শারদ ইলশেগুঁড়ি-১৪


 স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশিত হবে ছোটদের পত্রিকা কুঁড়ি



   ইলশেগুঁড়ি প্রকাশনের সুস্থতা বিষয়ক পত্রিকা সুস্থ সমাজ


প্রিয় পাঠক,
পত্রিকাটি পড়ে আপনার মতামত জানান কমেন্ট বক্সে। পত্রিকাটি নিজে পড়ার সাথে সাথে বন্ধুদের সঙ্গেও শেয়ার করুন। পত্রিকাটি পড়ার জন্য ইলশেগুঁড়ি প্রকাশনের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।





1 comment:

  1. 'ইলশেগুড়ি' বেশ টাটকা, ঝকঝকে এবং স্মার্ট।

    ReplyDelete

Theme images by luoman. Powered by Blogger.