Header Ads

Header ADS

ই-ইলশেগুঁড়ি - ২




 স ম্পা দ কী য় 


    প্রকাশিত হল ই-ইলশেগুঁড়ির দ্বিতীয় সংখ্যা। মুদ্রিত চর্তুমাসিক ইলশেগুঁড়ি পত্রিকার পাশাপাশি প্রকাশিত হচ্ছে অনলাইন পত্রিকা ই-ইলশেগুঁড়ি। দ্বিতীয় সংখ্যায় সকলকে স্বাগত। 
    সারা দুনিয়ায় আজ ঘোর অমানিশা। করোনাকালের এই অভূতপূর্ব সংকটে আমরা মানবজাতি খাদের কিনারে। কিন্তু প্রতিনিয়তই যুদ্ধ চলছে এই অসুরের সঙ্গে। আমরা যারা অক্ষরকর্মী তাদেরও প্রতিনিয়তই লড়াই চালাতে হচ্ছে এই অসুরের সঙ্গে। 
    বর্তমান সংখ্যাটি ই-ইলশেগুঁড়ির শারদ সংখ্যা। প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, একটাই দাবী রইল ভালবেসে, পত্রিকাটি পড়ুন এবং আমাদের জানান কমেন্ট বক্সে কেমন লাগল আপনাদের এই প্রচেষ্টা। সবাইকে শারদীয়ার আন্তরিক শুভেচ্ছা।

 সূ চী প ত্র 









অ ণু ক বি তা 

 তিনটি অণুকবিতা - ফটিক চৌধুরী

 গ ল্প গু চ্ছ 

 খেলাঘর - গৌরব রায়   
ভাবিনি এমন হবে - শমিত কর্মকার   
অন্যরকম পুজো - সুদীপ সরকার

 ক বি তা  গু চ্ছ 

ক্ষুধার্ত সময় - সুধাংশুরঞ্জন সাহা
বিশ্বমারী অথচ - ব্যাসদেব গায়েন
ইমাজিন - সৌরভ ঘোষ
আর একটা ভোর - প্রদীপ কুমার পাল
অন্য পুজো - গোবিন্দ মোদক
নতুন শুরু - সৈকত সরদার
ভার্চুয়াল পুজো - মিঠু দত্ত
যেখানে দাঁড়িয়ে - ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
নিভৃত মনের পুজো - ড. রমলা মুখার্জী
হোক অন্য পুজো - মীরা রায়
করোনাসুর - আশিস হালদার
মনগড়া কবিতা ১ - অনির্বাণ ঘোষ
কুয়াশামানবী - সুমনা ভট্টাচার্য
গন্ধ - সোহিনী রায়
মেঘ জলে রোদের স্নান - সাত্যকি
দেবীপক্ষ - ড. শুভায়ু দে
আমার দুর্গেশনন্দিনী - পার্থপ্রতিম পাল
স্বপ্ন - মুকুল হোসেন, ডানা - পুনম বোস 
অন্য পুজো - উৎস ভট্টাচার্য
অন্য পুজো - চিন্ময় মণ্ডল 
অন্য পুজো - হামিদুল ইসলাম

পত্রপত্রিকার আলোচনা 

দ্বিমাসিক ই-ইলশেগুঁড়ি-১ - দীপক আঢ্য 
ছোটদের পত্রিকা কুঁড়ি - নির্মলেন্দু কুণ্ডু

ধারাবাহিক উপন্যাস

কর্কটক্রান্তি - অমিতাভ দাস



মন করে আজ বেরিয়ে যাবো, 
মুখোশ মানা এড়িয়ে যাবো
রাস্তা ধরে ছুটিয়ে দেবো ইচ্ছে ঘোড়া,
জানলা দিয়ে বাইরে দেখি,
 ভেঙিয়ে শুনি বলছে পাখি
এমন মজার দিনগুলোতে ঘরেই তোরা?

বৃষ্টি হলো কাল যে রাতে,
 দৌড়েছিলাম অমনি ছাতে,
দুহাত দিয়ে আঁজলা নিয়ে বৃষ্টি মাখি
পাখিকে তা বলতে গিয়ে ,
 উল্টো বলে ঠোঁট বেঁকিয়ে,
ওটা তো তোর বন্দীদশায় মনের ফাঁকি।

ব্যস্ত দিনে বর্ষা হলে, 
 তোর মতো লোক ছাতা খোলে,
বিরক্তিতে ঘড়ি দেখে দশ বারোবার,
ভেজা টেজা নেই রুটিনে, 
দিব্যি থাকিস বৃষ্টি বিনে
হাতের ফোনেই দৃষ্টি গোঁজা তোদের সবার।

আমি বলি ইয়ে মানে, 
ওসব করি পেটের টানে,
 নেচার লাভার ভীষণরকম কিন্তু আমি 
পাখি বলে ক্ষ্যামা দে বাপ, 
মিছেকথা আজও যে পাপ
তোরা শুধু খুঁজিস এখন গেজেট দামী।
এই যে কদিন আছিস ঘরে ,
 প্রকৃতিপ্রেম মাথায় ঘোরে,
বাইরে গেলেই দূষণসাথী তোদের জাতি
যা বোস এখন ঘরে গিয়ে, 
হাত ধুয়ে চল সাবান দিয়ে,
আমি আবার পাতার ভেতর খেলায় মাতি।

জবাব দিতে গেলাম জোরে,
 অ্যালার্ম বাজে তারস্বরে,
ধড়মড়িয়ে গেলাম উঠে ঘুমের থেকে,
হাসতে থাকি নিজে নিজে 
 স্বপ্নে দেখায় কত কি যে,
স্ক্রিপ্টগুলো তার কোন পাগলে লেখে!
হঠাৎ দেখি জানলা দিয়ে, 
আমার দিকেই ঠিক তাকিয়ে
একটা পাখি উঠছে কেন ডেকে?


মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই উৎকর্ণ হলো মোকসেদ। বিকেল থেকে সে চার বার ঘুরে গিয়েছে কাশীদার ট্রান্সপোর্ট অফিস থেকে। যতবারই জিজ্ঞাসা করেছে কোনও খবর আছে? ততবারই কাশীদার উত্তর পেয়েছে, উহু। কেউ খোঁজ পর্যন্ত করেনি। হতাশ মোকসেদ দু-পাঁচ মিনিট সময় কাটিয়ে চলে গিয়েছে এদিক ওদিক। কেবল এবারই তার সামনে ফোনটা বেজে উঠতেই তার মনে আশার সূক্ষ্ম আলো যেন জ্বলে উঠল। কাশীদা ফোনে কীসব বলে রিসিভারটা ক্রাডেলের উপর রাখতে রাখতে বলল, যা মোকসেদ। তোর কপালটা ভালো। দমদমের ট্রিপ। বিপাশা ভাটাত্তে লোড হবে। সিদ্ধার্থর মাল। গাড়ি তাড়াতাড়ি গাদায় লাগা। তা না হলে...
    কাশীদার কথা শেষ না হতেই মোকসেদ বলে, কী মাল?
    আড়াই আড়াই এক আর দুই।
    মোকসেদ কথা বাড়ায় না আর। চোখের কোণে চিকচিকে দৃষ্টি নিয়ে ট্রান্সপোর্ট অফিসের উলটো দিকে লাগানো লরির কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে। ভোঁ ভোঁ ক’রে একরাশ কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে লরি নিয়ে এগিয়ে যায় বিপাশা ভাটার দিকে। 
    বছর চব্বিশের মোকসেদ তন্ময় সরকারের লরির খালাসী। কমপক্ষে এ গাড়ি ও গাড়ি ক’রে এই লাইনে সে পড়ে আছে প্রায় ছ’বছর। যদিও এই মোড়ে লরির ভালো ড্রাইভারের আকাল চিরকালই, তবুও খালাসী থেকে ড্রাইভারে উত্তরণ আজো হয়নি তার। লরির খালাসী হওয়ার জ্বালা অনেক। এক সঙ্গে খুশি রাখতে হয় অনেক লোককে। প্রত্যেকদিন সকালে বা দুপুরে গাড়ি ট্রিপ-ক’রে ফিরে এলে জল-ধোয়া যেমন করতে হয়, মাঝে মধ্যে আবার গ্যারেজে নিয়ে গিয়েও ছোটখাটো মেরামতি করে নিয়ে আসতে হয়। মালিকের সামনে ছ-চাকা ধুয়ে না রাখলে তার মন তোলা দায়। ওদিকে ড্রাইভার সে তো রাজার মতো ঠাঁট নিয়ে চলে। মোড়ের মাথার থেকে লোড্‌ গাড়ি নিয়ে যাওয়া আর ফিরে আসা। ফিরতি মালের সংবাদ থাকলে তার পায়া যেমন ভারি হয়, খিস্তির রকমসকমও তেমন বাড়তে থাকে। ভাবখানা এমন ফিরতি মাল এনে মালিকেরই সে কেবল বড়লোক ক’রে যাচ্ছে। অথচ ফিরতি মাল ধরলে তার দিনের রোজ যে এক লাফে দুশো টাকা বাড়ে সে খেয়াল তার হয়না কখনো।  এরপরেও তো আছে বাড়তি! চার-ছ জন সবজী ব্যাপারী পাওয়া তো নিত্য দিনের ব্যাপার। 
    মোকসেদের সেসব দিকে কোনও নজর নেই। তার ধ্যান-জ্ঞান কী করে কাজটাকে টিঁকিয়ে রাখা যায়। এই যে ইটভাটায় মাল লোড্‌ করার জন্যে খোঁজ খবর ক’রে বেড়ানো – মাল লোড্‌ করতে খালাসি হওয়া সত্তেও লরি নিয়ে ইটভাটায় পৌঁছে যাওয়া এসব ক’রে তন্ময় সরকারকে সে খুশি করতে পেরেছে বলে তার বিশ্বাস। তার কেবল বিশ্বাস নেই ড্রাইভার নারানের উপর। লোকটা হাজারো বদ-গুণে পূর্ণ। মুখের ভাষা লাগাম ছাড়া। ড্রাইভার ইউনিয়নের সঙ্গে দহরম মহরমও বেশ। তাছাড়া মানুষটার এমন একটা ভাব, যেন সে দয়া দেখিয়ে চলেছে এই মহাজগতের সকলের উপরে। লোকটা আসলে গভীর জলের মাছ। ওর মনের তল পাওয়া কঠিন। অথচ এই নারানদা-ই যদি একটু তাকে সাহায্য করত, এতদিনে ছ-চাকার লাইসেন্স পেতে তার অসুবিধা হওয়ার কথা না। আরটিও অফিসের নিয়ম কানুন সে লোক ভালো ভাবেই জানে। তাকে সামান্য সাহায্য ক’রে তার সঙ্গে এক-দু দিন অফিসে গেলেই তো মিটে যেত তার জীবনের অর্ধেক ঝামেলা। টেস্ট ড্রাইভে যে সে ভালোভাবে উতরে যাবে সে ব্যাপারে তার সন্দেহ নেই এতটুকু। নিশ্চয় নারানদা চায় না যে আরও একটা ড্রাইভার বাড়ুক মোড়ে। প্রশ্বাস আরও দীর্ঘ হয়ে ঝরে মোকসেদের। সে যে নারান ড্রাইভারের সুনজরে কোনও কালেই নেই তা সে বোঝে। অথচ সে যদি মুখ খোলে, মাল টেনে লরি চালানো, ফিরতি ট্রিপের বখরা নেয়া, মিথ্যে ক’রে পুলিশ খরচ লেখানো – এসব কথা যদি সে বলে, তাহলে কবেই তন্ময় সরকার তার গাড়িত্তে তাকে যে লাথি মেরে নামিয়ে দূর ক’রে দিত তা ভাবলে ওর নিজেরই করুণা হয় নারান ড্রাইভারের উপর। 
    বিপাশা ভাটায় লরি নিয়ে ঢুকতেই মুহুরিমশাই পথ আটকায়। জিজ্ঞাসা ক’রে, কার মাল?
    সিদ্ধার্থর।
    কই? আমার কাছে কোনও খবর নেই তো! তুই গাড়ি সাইডে লাগা। মালের ধারে যাস নে।
    আমারে ট্রান্সপোর্ট থেকে ব’লে দিল যে। আচ্ছা আমি মালিকের ফোনে লাগাচ্ছি। আপনি দাঁড়ান। 
    তন্ময় সরকারকে ফোনে ধরে কথা বলে মোকসেদ। মুহুরিমশাইয়ের আপত্তির কথা শুনে মোবাইল এগিয়ে দেয় তার দিকে। একটু পরেই মুহুরিমশাই বলে, গোলাইয়ের পিছনে গাড়ি লাগা। আমি যাচ্ছি।     মোকসেদ আবারও কালো ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
রোড চালান নিয়ে মাল লোড ক’রে যখন মোড়ের মাথায় লরি লাগালো মোকসেদ তখন রাত প্রায় ন’টা। ট্রান্সপোর্ট থেকেও মাল খালাস করার ঠিকানা চালান নিয়ে এসেছে মোকসেদ। রঘুর চায়ের দোকানে একটাও কাস্টমর নেই। সে শেষ বেলার মতো ক্যাশ গুছিয়ে নিচ্ছে বোঝা গেল। মোকসেদ লরির ভিতরে ড্রাইভারের সিট থেকে দেখতে পেল, নারান ড্রাইভার তেঁতুলতলার পাশ কাটিয়ে ঢুকে গেল তার বাড়ির গলি পথে। মোকসেদ মনে মনে ব্যস্ত হ’ইয়ে উঠল। এই বেলা তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে এক ঘুম দিয়ে উঠে রাত বারোটা বাজলেই যেতে হবে তাকেও। নারান ড্রাইভার ঠিক বারোটার ঘণ্টা পড়লেই হাজির হবে তার বাড়ির সামনে। হাঁক দেবে। উঠিছি-ই-ই-স। বেশিরভাগ দিন মোকসেদ তৈরিই থাকে, কেবল ওই হাঁকের অপেক্ষায়। 
    হঠাৎ ধড়ফড় ক’রে বিছানায় উঠে বসে মোকসেদ। আঁধার ঘরে রাত ক’টা ঠিক ঠাওর পায় না সে। বালিশের পাশে রাখা মোবাইলের সুইচে হাত দিয়ে দেখে রাত একটা পনেরো। তবে কি নারান ড্রাইভার আজ তাকে ডাকেনি, নাকি সাড়া না পেয়ে চলে গেছে? মুহূর্তে মাথাটা যেন তালগোল পাকিয়ে ওঠে। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা সে। প্রতিদিনের মতো আজও রাত্রে মোড়ের মাথায় গাড়ি লাগিয়ে কেবিনের লক মেরে এসেছে। বালিশের পাশে হাত দিয়ে গাড়ির চাবি আর কেবিনের চাবি দুটোই মুঠোর মধ্যে আনে সে। মনে মনে স্থির করে কাকে জানাবে আগে? মোবাইলের সুইচে চাপ দিয়ে নারান ড্রাইভারকে কল করে সে। রিং হয় না। সুইচড অফ। বিরক্তি অপেক্ষা ত্রাস লাগে মোকসেদের মনে। মাল না নিয়ে যেতে পারলে তন্ময় সরকার তাকে জ্যান্ত রাখবে না। গুষ্টি উদ্ধার ক’রে ছাড়বে। সকালে সিদ্ধার্থ এসে গায়ে হাত তোলা ছাড়া যা যা করা যায় সবই করবে। আর নারান ড্রাইভার থাকবে যথারীতি উদাসীন। লরির মালিকগুলো কী বোঝে তাকে জানে? কেন যে ড্রাইভারগুলোকে এত তেল মেরে চলে কিছুতেই তা মাথায় ঢোকেনা মোকসেদের। যত সমস্যাই হোক না কেন, কেউই ড্রাইভারকে সহজে ঘাঁটাতে চায় না। ভাবনার তল পায় না মোকসেদ। একটু ইতস্তত করে অবশেষে ফোন করে তন্ময় সরকারকে। ফোনের রিং দুবার হতে না হতেই তন্ময় সরকারের গলার আওয়াজ। মোকসেদ রাতের গাড়ি না ছাড়ার সংবাদ দিলে যেন আকাশ থেকে পড়ে তন্ময় সরকার। সিদ্ধার্থকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। একবার কথার খেলাপ হলে আর কখনো তার গাড়ি নেবে কিনা সন্দেহ। কেবল অস্ফুট স্বরে বলে, নারানদা তো একবার জানাতে পারতো। সন্ধে বেলাও তো দেখা হলো। কই, কিছু বলল না তো! একটু হতাশার সুরে বলল, এখন কী করা যায় বলতো? এত রাতে অন্য কোনও ড্রাইভারকেও তো পাওয়া যাবে না।
    মোকসেদ বুকে সাহস এনে বলে, আপনি বললে পাঁচ হাজার মাল আমি হামেশাই আনলোড্‌ ক’রে দিয়ে আসতে পারি। দমদম তো আর কলকাতা না! খালাসী কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবোখন্‌। 
একটু ইতস্তত ক’রে তন্ময় সরকার বলে, দ্যেখ্‌, কী করলে ভালো হয়।
    মোটর সাইকেলের হর্নে কাকভোর না হতেই ঘুম ভাঙে তন্ময় সরকারের। চোখ কচলাতে কচলাতে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। একটু অবাকই হয় তন্ময় সরকার। লরি ইউনিয়নের সেক্রেটারি মঙ্গল যে নিজেই তার বাড়ি পর্যন্ত এত সকালে ধেয়ে আসবে তা বুঝে উঠতে পারেনি সে। মোটর বাইকের স্টার্ট বন্ধ না করেই মঙ্গল বলে, কাল রাতে আপনার লরি কে নিয়ে গেল দাদা?
    কেন? আমার ড্রাইভার নারানদা।
    সে তো ওই যে। একটু দূরে হাতের ইংগিতে নারান ড্রাইভারকে দেখাল মঙ্গল। বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে সে বলল, আমাদের একটা ইউনিয়ন আছে, ঠিক যেমন আপনাদের আছে। আমি সেক্রেটারি থাকতে ইউনিয়নটা তো আর তুলে দিতে পারিনে। কাল থেকে আপনার গাড়িতে যদি কোনও ড্রাইভার না উঠতে চায়, তাহলে কিন্তু আমাদেরও কিছু করার থাকবে না। 
    কিন্তু নারাদারই তো ট্রিপ ছিল। তাহলে... কিছু না জানার ভান ক’রে আমতা আমতা করতে থাকে তন্ময় সরকার। ঠিক তখনই তার কথায় কান না দিয়ে মোটর বাইকের অ্যাক্সেলেরেটরে মোড়া দিয়ে সাঁই করে গাড়ি ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল মঙ্গল।
    কয়েক মিনিট মটকা মেরে দাঁড়িয়ে রইল তন্ময় সরকার। মঙ্গলের কথাগুলো যে স্পষ্টত হুমকি, তা বুঝতে দেরি হয় না তার। একটু দূরে নারান ড্রাইভার এখনও কার সঙ্গে দাঁতকপাটি মেলে কথা বলে চলেছে। তাকে দেখে সর্বাঙ্গ জলে উঠল তন্ময় সরকারের। মনে মনে বিড়বিড় ক’রে উঠল, শালা হারামি! একটা ভালো ড্রাইভার পেলে তোর মুখ-ই দেখতাম না ইহকালে। মোকসেদকে লরি দিয়ে পাঠানোটা বড্ড ভুল হয়ে গেছে। না হয়... মাথার ভিতর ভাবনারা জটলা করতে থাকে তন্ময় সরকারের।    সকাল আটটা না বাজতেই মোড়ের কাছে সচকিত হয়ে পড়ে কয়েক জোড়া কান। দূর থেকে তারা বেশ বুঝতে পারে তন্ময় সরকারের লরি এগিয়ে আসছে। উদ্দেশ্যহীন হর্ন বেজে চলেছে ক্রমাগত। তার কর্কশ শব্দ ক্রমশ তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠছে। দূর থেকে লরির ড্রাইভারের সিটে বসে স্টিয়ারিং হাতে  অন্য দুচার জন  লরির ড্রাইভারের সঙ্গে তন্ময় সরকারকেও দেখতে পেল মোকসেদ। হর্নে আরও কয়েকবার চাপ দিয়ে লরি এনে দাঁড় করালো সে মোড়ের মাথায় রঘুর চায়ের দোকানের সামনে। কেবিনের দরজা খুলে একগাল হাসি মুখ নিয়ে নামতেই সামনে তন্ময় সরকার। তার পাশে মঙ্গল ও আরও কয়েকজন। মোকসেদ লরি ছেড়ে মাটিতে পা রাখতেই তার ডান গালে বিরাশি সিক্কার চড়। রক্ত চোখ তন্ময় সরকারের। বাজখাঁই গলায় সে চিৎকার ক’রে উঠল, শালা, শুয়োরের বাচ্চা! গাড়ি নিয়ে রাস্তায় উঠেছিস! লাইসেন্স আছে তোর? পুলিশ ধরলে ফাইন তোর কোন বাপে দিতো শুনি।
    তন্ময় সরকারকে থামিয়ে দিয়ে মঙ্গল ধীর গলায় বলল, তোর জন্যে আমরা আমাদের ইউনিয়নটা এবার তুলে দেব নাকি রে?
    ডান গালে হাত বোলাতে বোলাতে মোকসেদ দেখতে পেল, রঘুর চায়ের দোকানের ভিতরে বসে দিব্যি মৌজ ক’রে চা খাচ্ছে নারান ড্রাইভার। তার সামনের পথ যে খুব মসৃণ না, তা সে বুঝতে পারে ভালো মতোই।                                 







একটা মাঠ। আগাছা আর ঘাস লতায় পরিপূর্ণ। তাকেই সাফ সুতরো করে ম্যারাপ বাধা হয়েছে। তার ভিতরে কয়েক সারি কাঠের টেবিল, টানা লম্বা আর সঙ্গে হলুদ রঙের কাঠের ভাঁজ করা চেয়ার। পাড়ার ছেলেরা রেডি কোমরে গামছা বেঁধে। কেউ নুন লেবু তো কেউ টেবিলে লম্বা সাদা কাগজ পেতে কলাপাতা দেবার জন্য প্রস্তুত, প্রথমেই লম্বা ডাঁটিওলা বেগুন ভাজা .... মাইকে হেমন্ত বা সন্ধ্যার গান ..... রজনীর সুবাস .... 
সচেতন পাঠক ঠিকই ধরেছেন, এ দৃশ্য বিয়েবাড়ির। তবে আজকের নয়, কয়েক দশক আগের দৃশ্য। এ দৃশ্যের অনেক কিছুই আজ আর দেখা যায় না, সে প্রসঙ্গ অন্যদিন। আজ বলব সেকালের বিয়ের আরো এক অনুষঙ্গের কথা, যা আজ বিলুপ্ত।



বিয়ের পদ্য। বাঙালি আর কবিতা বা পদ্য, এ যেন একে অপরের ভূষণ। সে সময় বাঙালি বিয়েবাড়িতে অতিথি প্রবেশ করার পরই, তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হত বিয়ের পদ্য। তুলে দিতে সাধারণত বাড়ির বালক বালিকারা। পাতলা কাগজে ছাপা হত এই পদ্যগুলি। এগুলির বিষয় হত একদম হালকা, বর বা বধূকে শুভেচ্ছা যেমন জানানো হত এর মাধ্যমে, ঠিক তেমনই রঙ্গ রসিকতাও থাকত পুরোদমে। এগুলির শেষে লেখক বা লেখিকা হিসেবে নাম থাকত বৌদি, ভাই-বোন, কখনো কখনো মা বা অন্য কোন আত্মীয়রা। আজ আমরা বরং দেখে নিই এইরকম একটি বিয়ের ছাপা পদ্য।
এই লিফলেটটি চার পাতার। কাগজের রং হলুদ। লেখাগুলি ছাপা হয়েছে লাল কালিতে। একদম উপরে একটি প্রজাপতির ছবি, তার মাঝে কথা প্রজাপতয়ে নম:। তারপর একটু নীচে বড় হরফে পাত্র ও পাত্রীর নাম। তারও একটু নীচে মোটা ও বড় হরফে "মিলন-গাথা"। এরপর একটি আঁকা ছবি, নববধূ ও বর হোমাগ্নিতে বিয়ের আচার পালন করছেন। তারও নীচে দুপাশে দুটি মঙ্গল ঘটের উপর আমপল্লব ও ডাব। এ দুটির মাঝখানে লেখা "খড়গপুর হইতে, ১৩ই শ্রাবণ, বৃহস্পতিবার, ১৩৬৬ সাল।" পাতার একদম নীচে "মাধবী প্রেস, মেদিনীপুর"। পুরো পাতাটির চারপাশে নকশাকাটা বর্ডার দেওয়া। এটিই হল মলাট।
এরপর পাতা ওল্টানো যাক। দ্বিতীয় পাতায় একটি কবিতা -  বধূ আবাহন। প্রথম দুটি লাইন:-
এস  বরষার মত করুণায় গলি, বন্যার মত ছুটে,
এস। গঙ্গার মত স্নেহেতে উছলি, পদ্মের মত ফুটে।
দীর্ঘ এই কবিতার নীচে লেখা - ইতি, আশীর্বাদিকা মা।



এরপর তৃতীয় পাতা। এখানে কবিতার শিরোনাম - "বড়দার বিয়েতে কিছুমিছু।"
দাদার বিয়ে। দাদার বিয়ে
             বেজায় ধুমধাম।
লোক জনেতে।   বাড়ি গরম
             তিলটুকু নেই স্থান।
এটিও দীর্ঘ কবিতা। একদম শেষে "ইতি বুলু - মঞ্জু।" বোঝাই যাচ্ছে বরের বোন এরা।
এইসব মধুর পারিবারিক সম্পর্কগুলোই তাদের অকৃত্রিম ভালবাসা নিয়ে কাব্য ফুটিয়ে তুলত এই বিয়ের ছাপা কবিতাগুলিতে। এগুলির বেশির ভাগের লেখকই হত অন্য কেউ, পাড়ার কোন উঠতি কবি বা পরিবারের কোন লিখিয়ে আত্মীয়। হয়ত এইসব লেখকদের কেউ কেউ পরবর্তী কালে কবি বা লেখক হয়েছেন। জানি না এইরকম অমূল্য সম্পদগুলি সবই বিনষ্ট, নাকি বহু পরিবারে প্রাচীন কাগজপত্রের মধ্যে আজও টিকে আছে। 
পরের সংখ্যায় বলব এরকমই আর একটি বিষয়ে - সিনেমার বুকলেট।

 

    বৈশাখ মাসের সঙ্গে বাঙ্গালীদের নাড়ির সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে। পয়লা বৈশাখ যেমন বাঙ্গালীদের কাছে এক অতি প্রিয় লোক উৎসব, তেমনি ২৫ বৈশাখ হলো বাঙালির কাছে অত্যন্ত আনন্দের।১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ মঙ্গলবার কলকাতার জোড়াসাঁকোতে বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সারদা দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিলেন রবি ঠাকুর। পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভোরের আকাশে পূব দিকে সূর্য যেমন ওঠে হেসে হেসে, ঠিক তেমনই আমাদের হৃদয়ের আকাশে ছেয়ে আছে তোমার স্মৃতি পট।বর্তমানে করোনা আতঙ্কে আমরা সবাই অনিচ্ছাকৃত গৃহবন্দি। কিন্তু ছোট্ট রবির শৈশবকাল ছিল গৃহবন্দী। ঠাকুর পরিবার তৎকালীন জমিদার বংশধর হওয়াতে ছোট্ট রবির শৈশব কেটেছে প্রাচুর্য, বিলাস বৈভবের মধ্যে দিয়ে। ঘর বন্দী ছোট্ট রবির শৈশব জীবনকাল খুব অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে কেটেছে। এই সময় তার সঙ্গী ছিল বইপত্র ও ঘরের চাকর বাকর। এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সে পড়াশোনা করতে ভালোবাসতো না, কিন্তু উপায় ছিল না। গৃহবন্দী সবার প্রিয় সেই ছোট্ট রবি শ্রেষ্ঠ উপাধির শিরোপায় হয়েছেন বিশ্বকবি। সমাজের বাস্তব আঙিনায় এমন কোন স্থান নেই যে তার কলম আঁচড় কাটেনি। তাইতো ভারতবর্ষের তিনি লক্ষণরেখা সীমান্ত অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বে তার নামের জয়গান গাওয়া হয়। তিনি ছিলেন বিনি সুতোর গাঁথা মন্ত্র মালা। তিনি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির সেতু তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। আজও মায়েদের ঘুমপাড়ানি গানে তাঁর গানের সুরের ছোঁয়া পাই আমরা। বাঙ্গালীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা বা অন্যান্য পূজার পরশেও দূর থেকে বহু দূর হতে ভেসে আসে গীতবিতানের সুর। তাই ২৫ শে বৈশাখ আমাদের হৃদয়ের বাণী ভারতের এক শিল্পকলা। বিশ্বকবি নিজেই ছিলেন একক অস্তিত্ব। তাইতো এক রবি আলো দিয়ে সমস্ত অন্ধকার ঘুচা য়, অন্যদিকে রবি বিশ্বমাঝে তার জ্ঞানের আলো জ্বেলে ঘুচায় মনের অন্ধকার। তাই ২৫ শে বৈশাখের শুভ ক্ষণে লক্ষ্য লক্ষ্য শঙ্খ বাজে, গানে গানে মুখরিত হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস।
    ছোট্ট রবির বাড়ির পরিবেশ ছিল সাহিত্যের আঙ্গিনায় প রি মন্ডিত। তার বোন স্বর্ণকুমারী তিনিও খুব ভালো কবিতা পাঠ করতে পারতেন, তিনি সাহিত্য কে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর ঠাকুর দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের সুসম্পর্ক ছিল।নামকরা কবি সাহিত্যিকরা ঠাকুরবাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন আবার কখনো-সখনো ঠাকুরবাড়িতে সাহিত্যের সভা আসর বসতো। ছোট্ট রবি লুকিয়ে লুকিয়ে সাহিত্য রস আস্বাদন করতেন। রবির সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর জীবনের মূল কান্ডারী। রবির পরিবার চাইতেন সে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা শিখুক। কিন্তু তার সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে মাতৃভাষা র প্রতি ভালোবাসা শেখালেন। কবির যখন মাত্র আট বছর বয়স তখন তার বাংলার মাস্টারমশাই তাকে চার লাইন কবিতা লিখে দিয়েছিলেন,"_মিন গণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে /এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে"। ছোট্ট রবি পরের চার লাইনে লিখেছিলেন_"আমসত্ত্ব দুধে ফেলি/তাহাতে কদলি দলি/সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে/হাপুস হুপুস শব্দ/চারদিক নিস্তব্ধ/পিঁপিঁড়া কান্দিয়া যায় পাতে"। এভাবেই কবিতা লেখা শুরু হয় ছোট্ট রবির। রবি ঠাকুরের প্রথম ছড়া কবিতা "জল পড়ে পাতা নড়ে"আজও হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান এর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহজ পাঠ লিখেছিলেন। সহজ সরল উপায়ের মধ্যে দিয়ে শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা তিনি করে যান।তবে সেই সময়ে যদি ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় এর প্রচলন ছিল সেকথাও কিন্তু ভোলার নয়।বঙ্গসন্তান ভারত সন্তান সর্বোপরি বিশ্ব জননী সন্তান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে যুগের পর যুগ গবেষণা চলছে। আগামী দিনেও চলবে। তিনি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।১৩১৭ সালের ৩১ শ্রাবণ "গীতাঞ্জলি" ছাপা হয়েছিল।এই গীতাঞ্জলি ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়ার পর বিশ্বের লেখক কবিদের মধ্যে সাহিত্যে নবজাগরণের সূচনা করেছিল। এই "গীতাঞ্জলি" এনে দিয়েছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল পুরস্কার। সর্বপ্রথম এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ভারতের গৌরব বাঙালি কবি রবি ঠাকুর। বিশ্বের দরবারে বাঙালি সত্তাকে তিনি প্রথম উন্মোচন করেছিলেন। সেই থেকে বাঙ্গালীদের আর ফিরে তাকাতে হয়নি। 
    তবে সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো ২০০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল চুরি ঘটনাটা হল এদেশের সর্বশেষ্ঠ কলঙ্ক। তিনটি দেশের জাতীয় সংগীত যাঁর অবদান, নোবেল চুরি করে সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হৃদয় থেকে মুছে ফেলে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ তিনি আমাদের হৃদয়ের যুগে যুগে বিরাজমান। রাজনীতি প্রসঙ্গ বিশ্বকবির অবদান কম নয়। তিনি বরাবরই স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন লেখনীর মাধ্যমে।যেমন"আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির হুকুম হইয়া গেলে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত দুই হাতে লোহার বেরি বাজাইতে বাজাইতে রবীন্দ্রনাথের গান ধরেন। তিনি গেয়ে ওঠেন_"সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে/সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে"।একদিন ভূপেন্দ্র কুমার বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত কে জিজ্ঞাসা করেন_"আচ্ছা দিনেশ তুমি তো ভীষণ চঞ্চল ছেলে, তুমি কি পড়ার সময় শান্ত হয়ে যাও? বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত বলে কবিতা। ভূপেন্দ্র কুমার জিজ্ঞেস করেন কার কবিতা? বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত উত্তর দেন রবীন্দ্রনাথের। 
    ১৯১৯ সালে কুখ্যাত জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের কথা আজও কারো ভুলে যাবার কথা নয়। সেই নৃশংস ও জঘন্য হত্যাকান্ডের বিরোধিতা করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের দেওয়া "নাইট" উপাধি প্রত্যাখান করেন। এসবের মধ্যে দিয়ে তিনি দেশপ্রেমের নমুনা দিয়ে গেছে ন। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার প্রচন্ড আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল।১৩৪৮ সালের ২২ শে শ্রাবণ ভারতবর্ষের বুকে নেমে আসে মহা বিপর্যয়। বঙ্গ জননী চিরতরে হারিয়ে ফেলেন তার কোলের অমূল্য রতন কে। ওই দিনে মহাপুরুষ রবীন্দ্রনাথ চিরতরে বিদায় নিলেন। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এক মহাসন্ধিক্ষণের অবসান ঘটে গেল। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম আকাশবাণীর ভাষ্যকার হিসেবে বলেছিলেন" অস্তমিত রবি, নেই রবি",আজও আমরা শিঁউরে উঠি সেদিনের কথা কানে বাজলে। এমন মহান পুরুষের জন্মদিনে শতকোটি নতমস্তকে প্রণাম জানাই।


চুপি চুপি দেখে গেছি আকাশের গায়ে
কতশত তারা আছে ডাঁয়ে আর বাঁয়ে,
কেউ কেউ নামজাদা, কেউ আনকোরা
সবাই এসেছে জুটে একটাই দায়ে ৷

আকাশের গায়ে লাগা জমাট আঁধার,
রাতেতে যখন তার ফুরোয় বাহার 
তারাই তরল করে নিকষ সে কালো
একা চাঁদ কতখানি আলো দেবে আর !

কখনো যদি গো তারা একজোট হয়
( ভেবো না, এ জোট কোন ভোট-হেতু নয় )
পাল্টায় তারা কত আকার-প্রকার
কেউ চায় যুদ্ধ, কেউ প্রশ্ন শুধোয় ৷

তাদেরই মাঝেতে কেউ টং-এ চড়ে বসে
দিক ঠিক করে দেয় সে তো অনায়াসে,
কেউ কেউ থাকে নিয়ে শান্ত সে জ্যোতি
কেউ বা বিষম ফোঁসে একরোখা রোষে ৷

তাদেরও জীবন চলে চাকার মতন,
সবশেষে ঠিকই আসে তাদেরও মরণ,
কালো সেই গর্ততে ঢুকে যায় তারা
কেউ নেই করবে যে তাদের স্মরণ ৷

সব্বার প্রশংসা পায় একা চাঁদ
সে-ই যেন একমেব, বাকি সব বাদ !
মনে রেখো, সূর্যও একখানা তারা
তার আলো না পেলে সব বরবাদ...



        সমসাময়িক চিত্রকলার ভাষ্যে নবীন প্রজন্মের শিল্পীদের আনাগোনা চলে অবিরাম। অনেকেই এর মধ্যে উজ্জ্বল। তাদের মধ্যে এক প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিবাণ নবীন শিল্পী আশীষ মণ্ডল।

শিল্পী আশীষ মণ্ডল

আশীষ মণ্ডলের শৈশব কেটেছে পূর্ব বঙ্গে, পিতা  মাতার সুমধুর স্নেহের সান্নিধ্যে। পিতা শ্রী অধীর মণ্ডল ছিলেন সেখানকার নাম করা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। এতটাই নামডাক ছিল যে, দেশ বিদেশের বিভিন্ন সেমিনারে ডাক পড়ত। কলকাতার সেমিনারে ডাক পড়লে, এখান থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন "দেশ" পত্রিকা। সেই সময় থেকেই দুদেশের শিল্প সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু কিছু পরিচয় ঘটে। 
    সবই ঠিক ছিল, কিন্তু গৃহ শিক্ষকের কড়া শাসনে বাঁধা পড়াশোনার যে প্রক্রিয়া তাতে হৃদয়ের ছন্দ গেল কেটে। চলে এলেন কলকাতায়।শুরু হল "দেনা পাওনা" চলচিত্রের উত্তমকুমার অভিনীত গায়ক চরিত্রটির মতো স্ট্রাগলের  অধ্যায়। আর্থিক অনটন,দৈন্যতার চূড়ান্ত একেবারে। কিন্তু ওই যে হার না মানা, জেদ বজায় রাখা এবং তার জন্য অপরিসীম লড়াই করার মানসিকতা, ওটাই তাঁকে টিকিয়ে রাখল।






    ছবির প্রতি প্রথম ভালবাসা ও আগ্রহ জন্মেছিল তাঁর মা মঞ্জুশ্রী দেবীর কাছ থেকে। তিনি বাড়ির ঠাকুর দালানে ফুটিয়ে তুলতেন একের পর এক আল্পনা। ডাক পড়ত পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বিয়ের পিঁড়ি আঁকবার জন্য। অত্যন্ত সুললিত ভাবে তৈরি করতেন নকশীকাঁথা।মায়ের সৃজন শিল্প  সুষমার রেণু  ছড়িয়ে পড়ত তাঁর ছোট্টবেলাকার মননের আঙিনায়।ছড়িয়ে পড়ে বিভোর করে দিত তাঁকে। চোখ বুঝলে এখনও ভেসে ওঠে মায়ের মমতাময়ী মুখখানি।এখনও ছবির ক্রাইসিসের সময়ে দেখতে পান শিল্পপ্রাণ সম্পন্না সেই মাকেই।উদ্দিপিত হন পুনরায়। এছাড়াও ছবি আঁকার চর্চা ছিল বড়দা প্রণব মণ্ডলের। যিনি ওই সময়ে খুলনা আর্টকলেজে পড়তেন। বাড়ির এই সাংস্কৃতিক আবহই হয়তো তাঁকে আগামী দিনের শিল্পের পরিসরের দিকে টেনে এনেছিল।
    তারপর এদেশে প্রথম গুরু বেলঘরিয়ার শিল্প শিক্ষক শ্রী চন্দন দে'র সংস্পর্শে আসা। গভীর স্নেহ  ভালবাসার ময়ান মিশিয়ে তিনি শেখাতেন। আন্তরিক উৎসাহে চিনিয়েছেন আর্ট কলেজ। তারই শিল্প উসকানিতে ভর্তি হয়েছেন "ইণ্ডিয়ান কলেজ অফ আর্ট এ্যাণ্ড ড্রাফট ম্যানশিপে (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়)। ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে, পাশ করে বেরোলেন ২০০১ সালে।কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়েছেন অসীম স্নেহ এবং মূল্যবান শিক্ষা।
    আর্ট কলেজ থেকে সদ্য বেরিয়েই ইউরোপ থেকে কপি পেইন্টিংয়ের কাজ পেয়েছিলেন। যে পেন্টিংগুলো কপি হবার পর আবার চলে যেত সেই ইউরোপেই। এই সূত্রে আলাপ হয় উড়িষ্যার এক অসাধারণ শিল্পী নীহার দাসের সঙ্গে। মূলত তার কাছ থেকে শিখেছেন অয়েল পেইন্টিং চাপানো এবং ফিনিশিংয়ের ধরন।নীহারবাবুর সঙ্গ তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। 
    কলেজ থেকে বেরিয়ে কিছুদিন ছিল মানসিক  অস্থিরতা। অবশ্য অতি দ্রুত সে সব কাটিয়েও ফেলেন। এরপর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে "ফোক আর্ট" বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি চলাকালীন হঠাৎ করে  অ্যানিমেশন শেখার অফার এবং সেইসঙ্গে সেখানেই চাকরি পাবার নিশ্চয়তার টানে ডিগ্রি অসমাপ্ত রেখে চলে গেলেন হায়দ্রাবাদের একটি অ্যানিমেশন ফিল্ম মেকিং কোম্পানিতে। সেখানে এক বড় হৃদয়ের মানুষ, স্যার প্রিন্স পাইকাট্টু তাঁকে জীবনের একটা নতুন দিশা দেখালেন। অ্যানিমেশন ডিরেক্টর হিসেবে সারা ভারতে যার নাম আছে, সেই খ্যাতিমান মানুষটির অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব সুলভ ব্যবহারে উপকৃত ও সমৃদ্ধ হয়েছেন এই ছাত্রটি। তাঁর প্র‍্যাকটিক্যাল অ্যাডভাইসে, সলজ্জ অন্তর্মুখী স্বভাব সহ বহু জড়তা কেটে গিয়েছে এই শিল্পীর। কর্পোরেট জগতে চলাফেরার  আদবকায়দা তো শিখিয়েছেনই সেইসঙ্গে একজন প্রকৃত শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে সঠিক পথ দেখিয়েছেন এই প্রিন্স পাইকাট্টু স্যারই।









    হায়দ্রাবাদে কিছুদিন থাকার পর যোগ দিলেন কলকাতায় সদ্য লঞ্চ করা " তারা চ্যানেলে "। সেখানে কিছুদিন কাজ করে সরাসরি জি বাংলার "ঠাকুরমার ঝুলিতে।" ভালই কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোথাও একটা ছবি নিয়ে উথাল-পাথাল চলছিলই। তাই শেষমেশ বেছে নিলেন এই রঙ তুলির জীবন। ঝাঁপিয়ে পড়লেন ছবি নিয়ে কিছু করার জন্য। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে গ্রুপে থেকে, কখনও বা একক ছবির প্রদর্শনী করেছেন দেশ বিদেশের বহু আর্ট গ্যালারিতে। এখন ছবি আঁকাটাই তাঁর পেশা। নিজে যেমন একসময়  পেয়েছেন অন্যের সহযোগিতা, সহানুভূতি তেমনি অন্যকেও অকাতরে তা দেবার জন্য অন্তর আধারটিকেও তৈরি করে রেখেছেন। 
    ছবির মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন সময়ে  ব্যবহার করেছেন চারকোল,প্যাস্টেল, পেন্সিল, জল রঙ। তবে তেল রঙ ও এ্যাক্রিলিক কালারেই মূলত কাজ করতে ভালবাসেন। প্রিয় রঙের প্রসঙ্গে বললেন, "প্রথম জীবনে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার জন্য সবুজ রঙ  খুব  ভাল লাগতো। তারপর কমলা। বেশ কিছুদিন লাল। ইদানীং আবার ইয়েলো অকার আর সাদা দারুণ লাগছে। রঙের বিষয় মনে হয় সময়ের সাথে সাথে পাল্টায়। রঙ যেভাবে আমাকে গভীর নান্দনিক ইশারা করে আমি তাতে সাড়া না দিয়ে পারি না।"
    তাঁর ছবির বিষয়ের আলোচনার প্রসঙ্গে উঠে এলো অনন্য উচ্চারণ। তাঁর কথায় — "মূলত আমার ছবির বিষয় আমি নিজে। আমি সব সময় আমাকে খুঁজি। যে আমি আমাকে ধরা দিতে চায় না, তাকে হাতড়ে বেড়াই। লালন ফকিরের গান আমাকে আবিষ্ট করে রাখে। ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর সেথায় এক পড়শি  বসত করে, আমি একদিনও, না দেখিলাম তারে।’ এই বাড়ি হচ্ছে আমার শরীর। আরশি আমার চোখ।আমি আমার এই চোখ দিয়ে ভেতর বাড়িকেই দেখার চেষ্টা করি অনুক্ষণ। যে আমি সর্বক্ষণ পার্থিব জগৎ নিয়ে ব্যস্ত থাকে সেটা কালো আমি। তার অনেক অন্ধকার। সেই কালো আমি আমার সাদা আমিকে খুঁজে চলার চেষ্টা চালায় সতত। যখন তাকে খুঁজে পাই তখন তার চেয়ে বেশি  আনন্দের আর কিছু  নেই। এবং তাকে যত্ন করে ধরে রাখার চেষ্টা করি। আমি চাই,আমার সেই আমি আমাকে সব সময় নিয়ন্ত্রণ করুক! তাই সেই কাঙ্ক্ষিত অথচ বিরল মুহূর্তটি পাবার বাসনা এবং চেষ্টা চলতেই থাকে ভেতর ভেতর।" তবে এর পাশাপাশি আধ্যাত্মিক ছবি যেমন এঁকেছেন  তেমনি স্যাটায়ার ধর্মী ছবিও।





    ছবি করতে গিয়ে আরেকটি শাশ্বত অথচ অনস্বীকার্য সত্যের কথা উঠে আসে তাঁর চিন্তা চেতনায়। "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।" বেঁচে না থাকতে পারলে যেমন কবি লিখতে পারেন না তাঁর কবিতা, তেমনি শিল্পচর্চাও হতে পারে না কোনও শিল্পীর।প্রবলভাবেই তাই দরকার ক্ষুন্নিবৃত্তি। তার সাথে শিল্প চর্চায় ব্যবহৃত রঙ তুলি ক্যানভাস ইত্যাদির ব্যয় ভার বহনের ভূমিকাটি এসে পড়ে অনিবার্যভাবে। ছবি আঁকার সময় সেকথা মাথায় থাকে তাঁর। 
    ছবির জগতে অনেক প্রতিভাবান প্রতিশ্রুতিবান শিল্পীদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। কিন্তু কখনও তাঁকে কাবু করতে পারে  না প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা নিন্দার মতো তুচ্ছ জিনিস। যার যেমন কর্মফল তার তেমন সাফল্যের ভাগ। অন্য কেউ তা কাড়তে পারে না।পুরস্কার পাবার বাহ্যিক লোভ থেকে শত হস্ত দূরে থাকাকেই শ্রেয় মনে করেন। পছন্দ করেন না আত্মপ্রচার। অন্তরের আনন্দময় ফল্গুধারার টানেই ছবি এঁকে চলেছেন তিনি। 
ছবি আঁকতে গিয়ে বিশেষ অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের কাছ থেকে। তখন তিনি আর্টকলেজের ছাত্র। কলকাতার এক আর্ট গ্যালারির কর্ত্রীর মারফত হুসেন সাহেবের কাছে কাজ দেখাতে যান। বেশ কিছুক্ষণ ছিলেন সেই জ্ঞান বৃক্ষের ছায়ায়। পেয়েছেন মূল্যবান পরামর্শ,যা আজও দস্তুর মতো মেনে চলেন। যে পড়াশোনার কড়াকড়ির জন্য শিল্প জীবন বেছে নিয়েছিলেন, হুসেন সাহেবের পরামর্শে শিল্পচর্চার পাশাপাশি আজও চালিয়ে  যাচ্ছেন সেই  বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনাই। পাশাপাশি দেখেন সিনেমা, নাটক প্রভৃতি। একটা সর্বাঙ্গীন চর্চার কথা বলেছিলেন যে ঘোড়ার ঈশ্বর! অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আরেক আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফোটোগ্রাফার রঘু রাইয়ের কাছ থেকে। এছাড়াও বহু বিশিষ্টের সান্নিধ্যে এসেছেন। দিল্লির ললিত কলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত " ন্যাশনাল আর্ট ক্যাম্পে "ডাকও পেয়েছেন ২০১০ সালে।
    তাঁর প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে আছেন গুস্তাভ ক্লিমট, ইউজিন দেলাক্রোয়া, রেমব্রান্ট,ভিনসেণ্ট ভ্যান গগ প্রমুখ। ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে গগনেন্দ্রনাথ,অবনীন্দ্রনাথের ছবি খুব ভাল লাগে।রবীন্দ্রনাথের ছবি বুঝতে চেষ্টা করেন।রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে যেরকম সাবলীলতা আছে তেমনি আঁকার মধ্যেও একটা সাবলীলতা আছে বলে তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের সাবলীল রেখা তাঁকে বিশেষ করে টানে। ভাল লাগে গণেশ পাইন, ফিদা হুসেনের ছবি। সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে চন্দ্র ভট্টাচার্য, অতুল দোদিয়ার ছবির তিনি ভক্ত। রঘু রাইয়ের ফটোগ্রাফি আর সুবোধ গুপ্তার ইন্সটলেশনও তাঁর ভাল লাগার বিষয়। 
    সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে বললেন — "আমি হয়তো রাস্তায় নেমে মানুষ জন্য কিছু করতে পারি না। কিন্তু যেহেতু আমার ছবির  সাবজেক্ট আমার কালো আমি ও সাদা আমি, তাই এই দুয়ের লড়াইয়ে শেষমেষ আমি সাদা আমিকেই জিতিয়ে দিই।আমার ছবির মাধ্যমে সেই বার্তা দেবার চেষ্টা করি যাতে আমাদের  সকলকার ভেতরের পশুত্বকে ত্যাগ করে মনুষ্যত্বে উত্তরণ হয়।সেটা যদি আমরা সবাই আন্তরিকভাবে প্রাণপণ চেষ্টা করি তাহলেই এত অসহিষ্ণুতা অমঙ্গলের নাশ হয়। আর কিছু না।"
    তাঁর ছবির গুণগ্রাহী অনেকেই। অনেকেই আগ্রহে কেনেন তাঁর আঁকা ছবি। শুধু ছবি কিনেই ক্ষান্ত থাকেন না কেউ কেউ। ভালবেসে টেনে নিয়ে যান নিজের রেডিও স্টুডিওয়। তারপর উষ্ণ সখ্যের তরঙ্গকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। ভালবাসার মাত্রা আরও যোগ হয় যখন কোনও আর্টফিল্মের পরিচালক তাঁর আঁকা ছবি ব্যবহার করেন চলচ্চিত্রের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে। কেউ ভালবেসে অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয় করিয়েও নিয়েছেন একটি সিনেমায়। 
    বহু মানুষের সঙ্গ লাভ, বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ তাঁর জীবন। তবু এখনও তিনি নিজেকে একজন শিক্ষার্থী বলেই মনে করেন।প্রয়োজনে শিখতে পারেন শিশুর কাছেও। এখনও না শেখা, না বোঝা বিষয় নিয়ে মনের ভেতর চলে গবেষণা।অবসরে  কখনও কোলাজের কাজে মেতে ওঠেন। কখনও ইন্সটলেশন এর নিভৃত পরীক্ষানিরীক্ষায়।
    জীবন সম্পর্কে রয়েছে তাঁর দার্শনিক মনন।তিনি মনে করেন, "জীবনের চেয়ে বড় কিছু নয়।কেউ নয়। জীবন আছে তাই কবিতা আছে, জীবন আছে তাই শিল্প আছে। আমরা যেহেতু মানুষ তাই এই জীবনটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে গেলে আমাদের কাজ করে যেতেই হয়। যেহেতু পৃথিবীর অন্যান্য পশু পাখি প্রাণীদের থেকে আমরা আলাদা, তাই আমাদের ভেতর সত্তায় জাগ্রত থাকে গভীর চিন্তা চেতনা বোধ।" এক আধ্যাত্মিক বোধ সর্বক্ষণ অনুরণন তোলে তার চিন্তন শিকড়ে। সেটা কোনও নিদিষ্ট ঈশ্বরে বা ধর্মে আটকে নেই। তিনি বিশ্বাস করেন প্রত্যেক বস্তু বা ব্যক্তির একটা বেসিক মৌলিক ধর্ম আছে। যার কারণে প্রত্যেকেই স্বাতন্ত্র্যতায় উজ্জ্বল থাকার দাবীদার। কেউই ছোট বড় নয়।তাই বিশ্বাস করেন মানব ধর্মে। মান এবং হুঁশ থাকাটাই যেখানে প্রধান শর্ত। যে হুঁশে একজন মানুষকে কুকুর কামড়ালেও মানুষটি কখনওই কুকুরকে কামড়ায় না, সেই হুঁশেরই কথা বলেন তিনি। আছে আর এক বোধ, যে বোধ তাকে বিনয়ী করে। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা জাগায়। আলাদা করে তাই কোনও মূর্ত কি বিমূর্তের উপাসনার প্রয়োজন বোধ করেন না তিনি। তাঁর হৃদয় ভূমিতে তাই হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান শিখ জৈন বৌদ্ধ সব ধর্মের মানুষের জন্য পাতা আছে সম্মান আল্পনায় বোনা আসন।



    স্ত্রী শম্পা ও তিন বছরের ছেলে নৈঋতকে  নিয়ে নিউটাউন রাজারহাটের নিজস্ব বাসভবনে থাকেন। সুখেই  আছেন। তবু আজও ভুলতে পারেন না, অত্যন্ত দুঃসময়েও স্ত্রীর পাশে থাকার কথা। ভুলতে পারেন না, সেই সময়গুলিতে অনবরত সাহস, উদ্যম জোগানোর আর নির্ভরতার কথা। নিজস্ব রচনা শৈলীর খোঁজে একটা সময় যখন আর্থিক ও মানসিক ভাবে সংকটজনক  পরিস্থিতির মুখোমুখি, সে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যথার্থ যোগ্য সহধর্মিণীর কাজটি করে ছিলেন শম্পা। একাই হাল ধরেছিলেন সংসারের।সুকঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ। অথচ নীরব নম্র ভূমিকায় করে গেছেন। অত্যন্ত উজ্জ্বল মেধাবী ছাত্রী হবার কারণে জুটিয়ে ফেলেছিলেন কর্পোরেট সংস্থার চাকরি। শুধু তাই নয়, এখনও শিল্পীর ক্যানভাসে ফুটে ওঠা ছবির প্রথম রসাস্বাদন তিনিই করেন।এ বিষয়ে প্রয়োজনে নিজস্ব বিরোধী মত প্রকাশ করতেও ছাড়েন না। এভাবেই নিরন্তর পাশে থেকে চলেছেন তিনি। 
    অত্যন্ত সরল স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন বলেই বোধহয় ছবি আঁকার নেশার সঙ্গে  বাগান করার নেশার মধ্যে একটা স্বাভাবিক সেতু রচিত হয় সহজেই। তাই এই শিল্পী বাড়িতেই বানিয়ে ফেলেছেন উদ্যান ছাদ। প্রয়োজনে ফুলের পরাগ সংযোগেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর উদ্যান নিবিষ্টতার সুন্দর তাঁকে আরেক সুন্দর শিল্পের গভীরতার দিকে হয় তো নিয়েই যায়! তাই হয়তো প্রথাগত ভাবনার বাইরে গিয়ে  সৃজনশীল  তকমা তিনি দিতে চান আপামর সকল মানুষেকেই। তিনি মনে করেন প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই রয়েছেন এক একজন সৃজনশীল মানুষ। প্রত্যেকের ভেতরই আছে এক ধরনের প্রতিভা। কেউ যেটা ছবি এঁকে, কবিতা লিখে করছেন অন্যেরা সেটা অন্য পেশার মাধ্যমে করছেন,পার্থক্য শুধু এটাই।
    কবিতার বই নিয়ে মাঝেসাঝে বসে পড়েন দুপুর অথবা অলস বিকেলে। লাইনগুলো, শব্দগুলি কি ডাকলে সাড়া দেয়! কাছে আসে! কোন্ সে রস কবিতাটি সাজিয়ে রেখেছে! তার রস নিংড়ে নেবার আগ্রহে কাত করে রাখেন তৃষিত হৃদয় পাত্রখানি।ভালবাসেন গান শুনতে।হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দের গান তাঁর খুব প্রিয়। কখনও কখনও শোনেন সেতার সরোদ বা বাঁশি তবলার লহরী। সুরের মূর্ছনায় নিজের স্টুডিয়োয়  রঙ তুলি ক্যানভাসের আকুল ঘ্রাণ নিতে নিতে চলে ছবির জগতে ডুবে যাওয়ার সাধন প্রয়াস। আরেক আশীষের সঙ্গে কি আরেকবার দেখা হওয়া সম্ভব! রঙ তুলি ক্যানভাস নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন।







অ নু ক বি তা 

তিনটি অণুকবিতা 

ফটিক চৌধুরী

মেঘচোর


মিথ্যামেঘ ঘুরে বেড়ায় মাঝে মাঝে
যারা কখনও বৃষ্টি হয়ে ঝরেই না
সত্যের কাছে লুকোচুরি খেলে মেঘ
আকাশ এদের নিজের মনে করেই না।

স্থিতি


চয়ন করেছো কিছু ফুল
গাছেই তো ওরা ছিল ভালো
বয়ন করেছো যতো স্বপ্ন
তারা কি কখনও দেয় আলো?

উড্ডীন


তুমি আমাকে দুশমন ভাবো
          আমি ভাবি আসমান
          যেসব পাখি ভাসমান
ওদের সাথে চল ভেসে যাবো।

অন্য পুজো - গ ল্প


খেলাঘর 

গৌরব রায়


    বিকাশ কলকাতায় দুর্গাপুজোয় প্যাণ্ডেল বানায়।ইদানীং থিম পুজোর চল বেড়েছে।বড় বড় আর্টিস্টরা আসেন,মিটিং করেন ওয়ার্কশপ করান।তাদের প্ল্যানমতই কাজ হয়।দক্ষিণ কলকাতার এক নামকরা পুজো উদ্যোক্তাদের সাথে ওর কাজ।ডেকরেটার্সের সাথে চেনাজানা ছিল।ওই ওকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।বিকাশ দেখে কাঠ,বাঁশ,কাপড় দিয়ে কিভাবে একটা ফাঁকা জায়গায় আস্তে আস্তে একটা ম্যাজিক তৈরী হচ্ছে।ওর সাথে আরও জনা ১৫-২০ জন কাজ করে।এমনিতে সারা বছর অন্য কাজ করলেও পুজোর সময়টা কয়েকটা বেশি টাকার জন্যে বাড়ি থেকে এখানেই চলে আসে আবার পুজো মিটে গেলে বাড়ি ফেরে।বাড়ি বলতে এক কামরার ঘর,ছোট্ট  ঘুপচি রান্নাঘর ওর বৌ এর হাঁপ ধরে আসে।তাও তো নিজের নয় ভাড়া বাড়ি।

    স্বপ্ন দেখে ওর নিজের একটা বাড়ি হবে।সামনে এক চিলতে বাগান থাকবে,উঠোন থাকবে।গত বেশ কয়েকমাস ধরে কলকাতায় প্যাণ্ডেলের কাজ করছে।কিন্তু টাকা বেশি পায় না।খুব মন দিয়ে কাজ করে।কিন্তু কোনো পাত্তা পায়া না।ওদের পুজো প্রত্যেকবার কিছু না কিছু প্রাইজ পায়।সেরা থিম,সেরা প্রতিমা বা সেরা ভাবনা-কিন্তু প্যাণ্ডেল বানানোর তো কোনও প্রাইজ হয় না।ওর নামও কেউ জানে না।মিডিয়া আসে ক্লাবের সেক্রেটারি,সম্পাদক বা থিম মেকিং আর্টিস্ট ওদের সাথেই কথা বলে ছবি তোলে - ও দূর থেকে দ্যাখে।ও মনে করে মায়ের জন্যে বাড়ি বানাচ্ছে।কৈলাস থেকে মর্ত্যে এসে ওর তৈরী করা বাড়িতে মা পাঁচদিন থাকবেন।এর চেয়ে আর কি বড় প্রাইজ আছে।

    মাঝেমধ্যে  জোড়হাত করে মায়ের কাছে প্রার্থনা করে ওর নিজের বাড়িটা যেন আসছে বছর হয়ে যায়।


ভাবিনি এমন হবে

‌‌ শমিত কর্মকার

    কথায় বলে সময় মানুষের পরিবর্তন করে। মানে সেটাই ঠিক। এক‌টা সময় মানুষের মধ্যে এতো উন্মাদনা থাকে, আনন্দ থাকে কোন কিছুকে‌ কেন্দ্র‌ করে। আর সেটা যদি হয় কোন উৎসব তাহলে তো কোন কথাই নেই। আবার এই‌ আনন্দকে‌ ভেস্তে দেয় কোন একটা সময়।
‌    বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব হলো দূর্গাপূজা। সারাবছরের সব উৎসবের মধ্যে শ্রেষ্টতম উৎসব হলো এটি। সবাই যেন নতুন এক উম্মাদনায় জেগে ওঠে।‌ সব জায়গায় যেন সাজো সাজো রব।সে দোকান হোক, কুমোর পাড়া হোক কি পাড়ার পুজো প্যান্ডেল হোক। প্রত্যেকটা মানুষ সেজে ওঠে, সে গরীব হোক বা বড়লোক। যে‌ যার দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে উৎসবে সামিল হন এই সময়ে। প্রত্যেক‌ বছরই এর কোন‌ পরিবর্তন ঘটে না। এই উৎসব কে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয় নতুন নতুন সৃষ্টি। সে শিল্পী হোক কি কবি কি সাহিত্যিক যে যার সৃষ্টিকে তুলে ধরে এই সময়ে। প্রকাশিত হয় নতুন নতুন পত্রিকা বই শারদীয় পত্রিকা আকারে। গানের শিল্পী নতুন গান করেন,চিত্র শিল্পী নতুন নতুন আঁকা দিয়ে পুজোর মন্ডোব সাজিয়ে তোলেন। তেমন মৃত‌ শিল্পীরা গড়ে তোলেন মৃন্ময়ী মায়ের মূর্তি।
    এমন সব দেখেই ছোট থেকেই বড় হয়ে উঠেছে পিউ অমিত এবং সোমদত্তারা। একই পাড়ার বাসিন্দা বলে যে কোন উৎসবে ওরা সবাই মিলে আনন্দে মেতে ওঠে। আর দূর্গাপূজা মানে শ্রেষ্ট উৎসব।
কিন্তু প্রত্যেকবারের মতো এ বছর‌টা এক নয়। এটা এক অন্যরকম বছর। কোথাও যেন কোন রকম আনন্দ নেই। শুধু একটা ভয় প্রত্যেকটা মানুষকে গ্ৰাস করেছে। এ এক মরোন বাঁচন লড়াই। এক মারনব্যাধি সারা পৃথিবীকে গ্ৰাস করেছে। তাই পিউ‌ অমিত এবং সোমদত্তা দের মন এবার যেমন খারাপ তেমন আবার একটা ভয়। তাহলে এবার কেমন করে‌ এই শ্রেষ্ট উৎসব হবে? কোন দিকে কোন উম্মাদনা নেই নেই কোন আনন্দ। সেই সাজো সাজো ‌রব আজ ফ্যাকাসে। মা আসছেন এর কোন আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। বাতাসে বাতাসে গন্ধও ছড়িয়ে পড়ছে না।
এবার হয়তো পুজো‌ও হবে মাও আসবেন। কিন্তু থাকবে কি প্রত্যেক বারের মতো সেই উম্মাদনা বা সেই আনন্দ?  
এ বছর হবে এই অন্য রকম পুজো। থাকবে না হয়তো সেই জৌলুস ।


অন্যরকম পূজো

‌‌ সুদীপ সরকার 


    সন্দীপন চৌধুরী ঝামাপুকুর পল্লী সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির একজন একনিষ্ঠ সদস্য। এটি নেহাত একটা পল্লীর পুজো হলেও আয়োজনের আঢ়ম্বরতায় তা এলাকার বিশিষ্ট পুজোগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য। পুজোর দিনগুলোতে মন্ডপে দর্শনার্থীদের ঢ্ল নামে। ফি বছর মন্ডপ সজ্জায় নতুনত্ত্বের আমদানি এই পল্লীর দুর্গাপুজোর বিশেষত্ব। এর সাথে অতিরিক্ত সংযোজন পল্লীর সদস্য/সদস্যাদের বিচিত্র প্রতিভার সমারোহে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যা গোটা পল্লীবাসীকে এই কটা দিনের জন্য যেনো একই পরিবারের সূত্রে গেঁথে ফেলে। এবারে বাদ সেধেছে করোনা জনিত অতিমারী যা পল্লীর কচিকাঁচাদের সাথে সাথে গৃহবধূদেরও নিতান্তই নিষ্প্রভ রেখেছে। 
    সন্দীপনের স্ত্রী উর্মিলা একজন আদ্যন্ত গৃহবধূ। বাণিজ্যে মাস্টার্স কমপ্লিট করা উর্মিলা বিয়ের আগে একটা বেসরকারী সংস্থায় চাকরি করত। সন্দীপনের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার পরে উর্মিলা চাকরিটা ছেড়ে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী সন্দীপনের একার রোজগারেও উর্মিলার সংসারে যথেষ্টই স্বচ্ছলতা। স্বামী, ছ বছরের মেয়ে সানা আর বিধবা শাশুড়িকে নিয়ে উর্মিলা ঘোরতর সংসারী। পুজোর পাঁচটা দিনকে উপলক্ষ্যে করে বিগত তিন মাস ধরে চলা ব্যস্ততার ঘনঘটাটা উর্মিলা খুব উপভোগ করে। সংস্কৃতি মনস্কা উর্মিলা এই সংক্রান্ত সমস্ত উদ্যোগের অগ্রভাগে থাকে। নাটকের রিহার্সাল থেকে শুরু করে নিজের চরিত্রের পাঠ মুখস্থ করা বা মেয়েকে আবৃত্তির জন্য প্রস্তুত করানো বা নিজের গানের রিহার্সাল - এই কটা মাস চৌধুরী বাড়িতেও উৎসবের আঁচ পাওয়া যায়। সন্দীপনের মা রমলা দেবীরও এগুলো বেশ ভালো লাগে। তিনিও নাতনি বা বৌমার পারফর্ম্যান্স দেখতে অনুষ্ঠান স্থলে যান। এবছর এসবের কিছুই হবে না এ ব্যাপারে উর্মিলার মত ঝামাপুকুর পল্লীর প্রায় সব গৃহবধূই একপ্রকার নিশ্চিত কিন্তু পুজোটা আদৌ হবে তো!! মন্ডপ বেঁধে দেবী প্রতিমা এলে নিদেনপক্ষে পুজোর কটা দিন সন্ধ্যায় মায়ের মুর্ত্তির সামনে চেয়ারে বসে দল বেঁধে আড্ডাটা দেওয়া যায় কিন্তু ঘট পুজো হলে সেটাও তো অসম্ভব। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশ্বস্ততা সে সন্দীপনের থেকেও পায়নি বরং সন্দীপন বলেছে, আগামী রবিবার মিটিং আছে, সেদিনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। মহাষ্টমীর সন্ধ্যায় রান্নাঘরের টিমটিমে আলোর নীচে আটপৌরে শাড়ি পরে উর্মিলা লুচি ভাজছে - এই অসম্ভব ভাবনাকে তার উৎসবপ্রিয় মন চরম
দু:স্বপ্নেও প্রশ্রয় দিতে চায় না। সেও সন্দীপনকে চূড়ান্ত হূঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, মিটিং এ পুজোর ব্যাপারে যদি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নিতে পার তবে গাড়ি ভাড়া করে আমায় বাপের বাড়ি দিয়ে আসবে।
    রবিবার সকালে বাজারে সন্দীপনের সাথে শুভ্রাংশু,তপন, সমীরের দেখা হল, তারাও যথারীতি পরিবার থেকে প্রায় একই চাপ খেয়ে বসে আছে যদিও প্রাবল্যের নিরিখে তা সন্দীপনের তুলনায় কিছুটা কম। আজ মিটিং এ যদি সব প্রতিকুলতাকে জয় করে পুজোর ব্যাপারে কোনো সদর্থক সিদ্ধান্ত না নেওয়া যায় সেক্ষেত্রে গৃহবিবাদ অবশ্যম্ভাবী। নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনায় যা সারবত্তা দাঁড়াল তা বেশ দুশ্চিন্তার, কারণ কানাঘুষো যা শোনা যাচ্ছে তাতে বেশ কিছু প্রবীণ সদস্য ঘট পুজোর পক্ষে মত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। মধ্যবয়সী কিছু সদস্যও তাতে সায় দেবে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে প্রবীণ কিছু মানুষ এই সুযোগে ছেলে ছোকরাদের একটু টাইট দিতে আগ্রহী কারণ বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত এই ছোকরাদের সৌজন্যে তারা বেশ কিছুটা কোণঠাসা। সবই গ্রুপ পলিটিক্সের খেলা। অর্থাৎ সন্দীপনদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ, শাণিত যুক্তির মাধ্যমে সভার সিদ্ধান্তকে নিজেদের অনুকুলে রাখার। সন্দীপন বেশ খানিকটা নিষ্প্রভ চিত্তেই বাজার নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। পল্লীর সমমনস্কদের সাথে ফোনে কথা চলতে লাগল। বুদ্ধিমতী উর্মিলা বুঝতে পারল যে সন্দীপন বেশ খানিকটা চাপে আছে তাই সে চাপটা আরোও বাড়িয়ে দেওয়া সমীচীন মনে করল। উর্মিলা বলল, আজ পুজোর ব্যাপারে যদি সন্মতিসূচক কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে পার তবে তো পুজোর কটা দিন তোমাকে নিজেকেই রান্না করে খেতে হবে তাই এখন থেকে আমার কাছে রান্নাটা শিখে নিতে পার। উর্মিলা এ ব্যাপারে রমলা দেবীর সম্পূর্ণ প্রশ্রয় পাচ্ছে।
    টানটান উত্তেজনায় মাননীয় সভাপতির তত্ত্বাবধানে সভার কাজ শুরু হল। সম্পাদক মহাশয় জানালেন, কিছুদিন আগে স্থানীয় সব পুজো কমিটির সম্পাদকদের নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে একটা সভা হয়েছে, সেখানে পরিষ্কার জানানো হয়েছে, সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মেনে ও স্বাস্থ্য সচেতনতা সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক গাইডলাইন গুলোকে মান্যতা দিয়ে পুজো করা যেতে পারে। আমাদের ট্রাডিশনাল পুজো হবে কিনা সে ব্যাপারে এই সভাই সিদ্ধান্ত নেবে। প্রবীণ শ্যামসুন্দর বাবু বললেন, এমতাবস্থায় এবছর প্রতিমা পুজোর পরিবর্তে ঘট পুজোই শ্রেয় হবে। পাশে বসে থাকা বিধু বাবু ঘাড় নেড়ে পার্শ্বস্থ ব্যক্তির বক্তব্যকে সমর্থন
জানালেন। মধ্যবয়সী স্বপন দা পূর্বতনের কথাকে যথাযথ সঙ্গত করে বললেন, দীর্ঘ লকডাউন জনিত কারণে অর্থনীতির অবস্থা বেহাল তাই দেবী মা কে উৎসর্গ করে ঘট পুজোর প্রস্তাবই স্বাগত। রবীন দা বলল, আমাদের মন্ডপ থেকে যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে তবে আমরা দায়বদ্ধ হয়ে পড়ব তাই আনাঢ়ম্বরভাবে নিয়মরক্ষাই বাঞ্চনীয়। সন্দীপন, শুভ্রাংশুরা লক্ষ্য করছে সভার হাওয়া তাদের প্রতিকূলে বইতে শুরু করেছে। এখনই সভার মোড় ঘোরানো প্রয়োজন নচেৎ বাড়ি ফিরে গিন্নীদের রণংদেহী মুর্ত্তির সন্মুখে তাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশা হবে। সন্দীপন বলল, আমাদের পল্লী সার্ব্বজনীন বরাবর থিম পুজোর জন্য বিখ্যাত। এবারে অতিমারীর আবহে আমরা সামাজিক সচেতনতা সংক্রান্ত থিম তো করতেই পারি। বিধুবাবু সন্দীপনের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তা তোমার সামাজিক সচেতনতা সংক্রান্ত থিমের পরিকল্পনাটা কি একটু বুঝিয়ে বল তো ভায়া। সন্দীপন বলল, হূ এর সামাজিক সচেতনতা সংক্রান্ত গাইডলাইনকে মান্যতা দিয়ে আমরা এস.এম.এসের প্রচার করতেই পারি। রবীন দা বলল, সেটা কিরকম। সন্দীপন বলল, দেবী দুর্গা সহ লক্ষী, গণেশ, কার্ত্তিক ও সরস্বতী প্রত্যেক দেবদেবীর মধ্যে আমরা তিন ফুটের দূরত্ব বজায় রাখতে পারি যা প্রত্যেক আগত দর্শনার্থীকে সামাজিক দূরত্বের নিদান মেনে চলার বার্তা দেবে। প্রত্যেক দেবদেবীর মুখে মাস্ক থাকবে যা সকলকে অতি অবশ্যই মুখে মাস্ক পরার আহবান জানাবে। প্রত্যেক দেবদেবীর হাতে যদি আমরা স্যানিটাইজারের শিশি রাখতে পারি তবে হূ নির্দেশিত সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহারের মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধমূলক নিদান, আমরা থিমের মাধ্যমে মন্ডপে আগত মানুষজনের হৃদয়ঙ্গম করার ব্যবস্থা করতে পারি। শ্যামসুন্দর বাবু রে রে করে উঠলেন, মা দুর্গার মুখে মাস্ক থাকবে এটা আবার হয় নাকি, অসুর নিধনকারী মা আমাদের কাছে সর্বশক্তিমান দেবী হিসেবে পূজিতা হন তাই ওনার মুখে মাস্ক তো ভাবাই যায় না। এতে সকলে ধারণা করতে পারে যে স্বয়ং মা দুর্গাও করোনাকে ভয় পেয়েছে। মা সকলের ভয় নাশ করেন আর সেই মা যদি নিজেই ভয় পেয়ে যান তাহলে তো সাধারণ মানুষ ভয়ে সেঁধিয়ে যাবে। দেবী মা প্রবল পরাক্রমশালী অসুরকে বধ করে দেবতাদের রক্ষা করেছিলেন আর কোথাকার করোনা কে উনি ভয় পাবেন!! বিধু বাবু বলল, মায়ের হাতে অস্ত্রের বদলে স্যানিটাইজারের বোতল!! এই উলটপুরাণ ধম্মে সইবে না। সন্দীপন দৃশ্যতই উত্তেজিত। সে বলল, আপনারা এখনও এসব বস্তাপচা ধ্যানধারণা আঁকড়ে বসে রয়েছেন এটা ভাবতেই আমার অবাক লাগছে। দেবী দুর্গা ত্রিশূল হস্তে অসুর বধ করছেন, মা তার এই রূপের মাধ্যমে মানুষকে নিজেদের অন্তর্নিহিত কাম,ক্রোধ,লোভ,হিংসা,ঘৃণা নামক আসুরিক প্রবৃত্তিগুলো নিধনের বার্তা দেন। তাই এবছর মা যদি মুখে মাস্ক পরিহিতা হয়ে আসেন সেক্ষেত্রে মন্ডপে আগত সকল মানুষের কাছে অতি অবশ্যই যথাযথভাবে মাস্ক পরিধানের বার্তা দেওয়া যাবে। ধর্মের সাথে সঙ্গত করে তাদের বোঝানো যাবে আমাদের সামাজিক বার্তা।
    উপস্থিত সিংহভাগ সদস্য সন্দীপনের সাথে গলা মেলাল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে দেখে সম্পাদক মহাশয় নিজের হাতে মিটিং এর রাশ তুলে নিলেন। সন্দীপনের যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্যকে সমর্থন করে তিনি বললেন দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে আমাদের পল্লীতে যে উৎসবের আবহটা তৈরী হয় সেটাকে একেবারে নস্যাৎ করা উচিত হবে না বরং উৎসবের গতিমুখ কিছুটা অন্যরকম হতে পারে। বিধু বাবু, বলল, তাহলে এবারে মায়ের হাতে ত্রিশূলের বদলে স্যানিটাইজারের বোতল!! সম্পাদক মহাশয় বললেন, তা একেবারেই নয়। পুরাণ মতে মায়ের দশ হাতে যে দশ অস্ত্র থাকার কথা তাই থাকবে। নিয়মমত হাত ধোয়া বা হাত স্যানিটাইজ করার বার্তাটা আমরা অন্যভাবে দেব। মন্ডপের মূল প্রবেশ দ্বারে আমরা স্যানিটাইজার মেশিন বসাবো। আগত দর্শনার্থীরা স্যানিটাইজড হয়ে তারপর মন্ডপে ঢুকবে। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা একসাথে দশজনের বেশী মানুষকে কোনোভাবেই মন্ডপে ঢুকতে দেবে না। মুখে মাস্ক না থাকলে তাকে মন্ডপে ঢুকতে দেওয়া হবে না। মন্ডপের ভেতরে থাকা ভলিন্টিয়াররা কোনোভাবেই ভিড় জমতে দেবে না বরং সামাজিক দূরত্ব মেনে বাহির পথ দিয়ে তাদের বার করে দেবে। রবীন দা বলল, এ তো বেশ উত্তম ব্যবস্থাপনা হবে। এতে সংক্রমণ ছড়ানোর কোনো আশঙ্কাও থাকবে না। স্বপন দা বলল, এতো যা ফিরিস্তি শুনলাম তাতে ব্যয় সংকোচনের পরিবর্ত্তে ব্যয়াধিক্য ঘটবে। সম্পাদক মহাশয় সেই আশঙ্কাও অমূলক প্রতিপন্ন করে, মন্ডপসজ্জা  আলোকসজ্জার বাজেট গতবারের তুলনায় এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিলেন তৎসহ পুজোর মধ্যেকার দুদিন মধ্যাহ্নে সদস্যদের খাওয়া দাওয়ার পেছনে কমিটির যে বিপুল অঙ্কের অর্থব্যয় হয় তা এবারের জন্য বন্ধ রাখার কথা বললেন। শুভ্রাংশু বলল, লকডাউনের নেতিবাচক প্রভাব পল্লীর কোন কোন ব্যক্তির আয়ের ওপর থাবা বসিয়েছে তা আমরা বিলক্ষণ জানি। সুতরাং লকডাউনের বিরূপ প্রভাব যাদের ওপর পড়েনি তারা পূর্বের চাঁদা দিতে সমর্থ বলে ধরে নেওয়াই যায়। রাজ্য সরকারের চাকুরে স্বপনদা আর কথা বাড়ালেন না। সভার গতিমুখ আঁচ করে শ্যামসুন্দর বাবু আর তার সাকরেদ বিধু বাবু অনেক আগেই চুপ
করে গেছেন। প্রতিমা পুজোর সিদ্ধান্ত সর্ব্বসন্মতভাবে গৃহীত হল। প্রাসঙ্গিক সম্ভাব্য ব্যয় ধরে খসড়া বাজেট প্রস্তুত হল, তাতে দেখা গেল কিছু অর্থ উদ্বৃত্ত হবে। সভায় প্রস্তাব উঠল ঐ অতিরিক্ত অর্থে বেশ কিছু মানুষজনকে নতুন জামা কাপড় উপহার দেওয়ার যারা প্রকৃত অর্থেই লকডাউনজনিত আর্থিক বিড়ম্বনার শিকার। হৈ হৈ করে সকল শুভ প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্মতিতে পাশ হয়ে গেল। স্বপন দা বলল, আমাদের পল্লীর ঐতিহ্য মেনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটাও কি অন্য আঙ্গিকে করা যায় না। শ্যামসুন্দর বাবু স্বপনদার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। বিধু বাবুও ওনাকে অনুসরণ করলেন। মন্ডপে ঢোকার প্রবেশদ্বার সংলগ্ন রাস্তায় সামাজিক সচেতনতা মূলক পোস্টার লাগানোর সিদ্ধান্তের পাশাপাশি দলবদ্ধ নাটকের বদলে প্রাসঙ্গিক একক উপস্থাপনা মন্ডপ সংলগ্ন অনুষ্ঠান মঞ্চে প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। সভার আনুষ্ঠানিক কাজ শেষ হল।
    সন্দীপন, শুভ্রাংশুদের মুখে যেনো যুদ্ধ জয়ের হাসি। ওদের বুক থেকে যেনো একটা জগদ্দল পাথর নেমে গেল। সমীর তামাশার সুরে বলল, গৃহকর্ত্রীদের থেকে চাপ খেলে আপাত নিরীহ ব্যক্তিও কেমন পুরুষ সিংহে পরিণত হয়, আজ সেটা স্বচক্ষে দেখলাম। ঠাট্টা যে তাকে উদ্দেশ্য করেই সেটা বুঝতে সন্দীপনের খুব একটা অসুবিধে হল না, তবে এই রসিকতা উপভোগ করতে এখন তার বেশ ভালোই লাগছে।

অন্য পুজো - ক বি তা 

ক্ষুধার্ত সময়       

সুধাংশুরঞ্জন সাহা


ভয়ানক জীবন লিখতে লিখতে সময় ক্ষয়ে যায়।
শুধু পড়ে থাকে পারস্পরিক সন্দেহ,দোষারোপ,
আক্রোশ, অভিযোগ আর অনুশোচনা।
শ্রাবণের অমনোযোগী বৃষ্টি আচমকা ভিজিয়ে দিলে,
আকাশের সিঁড়ি ভাঙে অপরিচিত মেঘের বাড়ি।

ছাদে লুটোপুটি খাওয়া জ্যোৎস্না মেখে
লেখার টেবিলে ফিরে এসে দেখি
সামুদ্রিক শোকের লবনে রান্না হচ্ছে
নিঃসঙ্গ স্বপ্নের মাংস
আর চেটেপুটে খাচ্ছে ক্ষুধার্ত সময়।


বিশ্বমারী অথচ    

ব্যাসদেব গায়েন 


ভয়ের নামগন্ধ নেই রাজনীতির অলিন্দে
হিসেব মিলিয়ে দান ক্ষয়রাতি -
রেশনে যদি সব সমাধান হয়ে যায়
তবে ত্রাণ বন্টন হবে কাদের মাঝে
আর নেতাগোছের মানুষগুলো তো
একেবারে চিন্তাত্র জাগরোদ্বেগঃ

স্বার্থসিদ্ধির খোলা ময়দানে
যুযুধান দুপক্ষ বা একাধিক গোষ্ঠী
পরিযায়ীদের ক্লান্ত হতে নেই
নইলে খাদ্য ভর্তি বিভীষিকা চাপা দেবে
রাজনৈতিক বুলি ফুটলেও
মৃত্যুর আগে কোনো কদর নেই
এই ফুটিফাটা মহাবিশ্বে
জীবন মানে প্রতিনিয়ত সোচ্চার প্রতিবাদ
আর মৃত্যু সাদা কাপড়ের তলায়

ইমাজিন  

সৌরভ ঘোষ

জাগো.....

সার্বজনীন মা'এর আবাহন ইথার মাধ্যম

জাগে চ্যাপ্টা পাতা, গালফোলা শিশির ভেজা রাস্তা
অলস আনন্দে  দীঘল পাখির বাচ্ছা

প্রতিদিন ভোর ভোর জাগে আগুন চাখা মেছুনি,
পাড়ার মোড়ে সোনালি মেঘে ঢাকা চায়ের দোকানি;
আজ ইচ্ছে করে দেরি

পাগলাটে বেকার সেও অ্যালামে উঠেছে
মাংসল চোখ আধো বুজে মহালয়া শুনেছে

হলুদ কণ্ঠি পাখির জীবনের প্রথম লেজনাড়া
বাসিমুখো ফুলগুলোর পেঁজা মেঘে স্বপ্ন খোঁজা

গন্ধকবর্ণ জ্যোতি  অলীক স্বপ্ন দেখায় 

মা যদি হাঁটতে পারতেন, ছুটতে পারতেন
আমার স্কুলের ম্যাডামের মত মাথায় হাত বুলিয়ে বর দিতে পারতেন;
তাহলে কি কি চাইতাম.....হাঁটতাম, না ছুটতাম!

ময়লা মনের আসকারা কাজের মেয়ের মত ফাঁকিবাজ

দু-তিনদিন, বড়জোর সাতদিন, চমৎকার সঙ্গীতে
হাসি কান্নার মদিনা  
তারপর আবার নিজের দুপায়ে নিজের ভার বওয়া
মাঝেমধ্যে বধ হওয়া... 

আর একটা ভোর 

প্রদীপকুমার পাল 


সমস্ত দিনের শেষে সিঁদুর খেলে পশ্চিম আকাশ।
উৎসব থেমে যায় কোলাহল শেষে-- 
অন্য একটা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, 
পড়ে থাকে স্মৃতিগুলো পথের ধুলোয়।

আলো নিভে যায়, বাতি জ্বলে ওঠে। 
অন্য এক অনুভবে 
শেষবার তোমাকেই তো ছুঁয়ে থাকি। 

আলো নিভে যায় নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার, 
তোমাকেই ধরে রাখি দু'চোখে আবার। 

সমস্ত রাত্রি জুড়ে আয়োজন 
স্বপ্ন সাজানো, 
সামিয়ানা সাজিয়ে রাখি তারায় তারায়। 

দুটো চোখ স্বপ্ন দেখে 
আর একটা ভোর।

অ ন্য পুজো

গোবিন্দ মোদক


আদুল গায়ের যে ছেলেটা গাড়ি ধোয় রোজ ভোরে
কাজের আশায় যে মেয়েটা বাড়ি বাড়ি খুব ঘোরে 
যে বুড়োটা হকারি করে — ধরে ভোরের গাড়ি  
যে ছেলেটা খবরের-কাগজ দিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি।

যে সব কিশোর শিশু-শ্রমিক ইঁটের ভাটায় খাটে 
ইস্কুলে নয় যে শিশুদের কাজ করে দিন কাটে 
যে শিশুটি খাবার খোঁজে ডাস্টবিনটা খুঁটে
মাথায় বোঝা নিয়ে কষ্টে হেঁটে যায় যে মুট।
 
যে কিশোরী পরের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে 
লাঞ্ছনা পায় ফেরে শুধু অপবাদটা নিয়ে 
তেল অভাবে যে কিশোরীর রুক্ষ হাত আর পা
কাজ না করলে যে শিশুটির খাবার জোটে না।
 
সমাজের সব-ক্ষেত্রেই যাদের মাথা নিচু
খিদে ছাড়া জীবনে যারা জানলো নাকো কিছু
যাদের ডেকে কেউ বলেনা — আয়রে খাবার খা
সত্যি বলছি এই পুজোটা তাদের জন্য না !!

                  

নতুন শুরু  

সৈকত সরদার  

              
আবার একটা নতুন শুরু; করতে গিয়ে দেখি,
পুরনো সব দিনগুলো যে; থমকে আছে একি?

চলতে পথে হঠাৎ করে; আলতো করে হাতটা ধরে; 
নিয়ে গেছিলো অনেক দূরে; আজ সে কোথায় গেলো? 

সমস্তটা ঝাপসা হলো; রাস্তাদুটো আলাদা হলো; 
স্বপ্নগুলো মিলিয়ে গেলো; জীবনটা আজ হলো এলোমেলো।

তাই আজকে আবার নতুন করে করতে গিয়ে শুরু,
বুকের ভিতর করছে যে আজ বড়োই দুরুদুরু। 

তবু যে আজ চলতে হবে আমায় নতুন করে,
ভালোর কথা ভাবতে হবে রাত থেকে ঐ ভোরে। 

ভার্চুয়াল পূজো 

মিঠু দত্ত


কালে কালে দেখবো কতো 
            উল্টো রাজার দেশে 
মা এসেছেন মর্তে দেখো 
            নতুন সাজে সেজে।

দশভূজার নতুন রূপে 
       গেছে সবাই চমকে 
অসুর দূর্গার সোস্যাল ডিসটেন্স
     সিংহ গেছে বমকে।

মা দূর্গার হাতে দেখো 
            দশটি নতুন অস্ত্র 
বেনারসী সব দূরে রাখো 
       পিপিইকিট এখন বস্ত্র।

গঙ্গাজল চাইনা এবার
            আনো  স্যানিটাইজার
দরকার নেই অঞ্জলী দেবার
                 হাত ধোয় বারবার।

পুরুত মন্ত্র বলে অনলাইনে
             দূরের থেকে নমস্কার 
দক্ষিণা তো গুগল পে 

              পূজো এবার ভার্চুয়াল।।

যেখানে দাঁড়িয়ে 

ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়


আজ আমি,
রয়েছি যেখানে দাঁড়িয়ে,
সবাইকে হারিয়ে,
সীমানা ছাড়িয়ে।

সেথা ওঠে কেন কলরব,
শেষ হয় বেঁচে থাকার পর্ব।
আকন্ঠ নিমজ্জিত আমরা সবাই
দু'বেলা মরার আগেই মরব ?

আজ তুমি,
রয়েছ যেখানে দাঁড়িয়ে
মানবিকতা হারিয়ে,
বাঁচবার  তাগিদে।
সেথা ওঠে কেন কান্না
বেঁচে থাকবার অশেষ ধরনা
মৃত্যুভয়ে ছুটে বেড়াই সবাই,
শুনতে চাই না মায়াকান্না?

আজ সবাই,
রয়েছি যেখানে দাঁড়িয়ে,
অনেককে হারিয়ে
মৃত্যুকে তাড়িয়ে।

সেথা ওঠে কেন প্রতিবাদ,
গৃহচ্যুত, সমাজচ্যুত করার সংবাদ।
এতদিনে হয়েছে বুঝি আবাদ,
আমরাই বাঁচব,বাকি সব বরবাদ ?

নিভৃত মনের পুজো   

ডঃ রমলা মুখার্জী    


হোক না পুজো অন্যভাবে, নিভৃত মনের আরাধনা
বাহির পুজোর ঘুচুক আঁধার, অন্তরের হোক উপাসনা।
জানি যে জন গড়ছে ঠাকুর, তার এটা উপার্জন,
তবু বলবো সীসার রঙে জল দূষণ অতি ভীষণ।

বন্ধ হোক বেলপাতা, ফুল, জলে প্রতিমা নিরঞ্জন
মনের যত জমাট কালো এবার পুজোয় বিসর্জন।
আচার, আমোদ পরের কথা, আগে সামলাই পরিবেশ 
বাজি-বারুদের শব্দ-অগ্নি হোক একদম নিঃশেষ।

আলোকমালার ঝলকানিতে নিভে যায় চেতন আলো
স্বল্পালকে হোক পুজো, পরিবশ রক্ষার পক্ষেও ভালো।
শুদ্ধ হোক পরমা প্রকৃতি, পবিত্র হোক চিত্ত,
মানবী দুর্গার দুর্গ গড়ে সুরক্ষিত করি নারীত্ব।

যে দেশে নারী লাঞ্ছিত হয়, গরীবেরা মরে ভুখা
মারণ অসুখে অসহায় রুগী ঘরের কোনে একা
সে দেশে এবার পুজিত হোক স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার,
সাফাইকর্মী, পুলিশ আর সব, নিরলস সেবা যার।

অসুস্থদের পাশে থেকে কঠিন সময় করি পার 
স্বাস্থ্যবিধি হোক পূজা-উপাচার, চৈতন্যোদয় হোক সবার।



হোক অন্য পূজা   

মীরা রায়



প্রতি বছর হত মাটির দূর্গা প্রতিমা
আকাশ ছোঁয়া প্যান্ডেল, আলোর রশ্নির মালা।
এবার না হয় বাদ হয়ে যাক
কোটি কোটি টাকার খেলা।

এবার হোক মানুষ পূজা
দেওয়া হোক দুস্থ মানুষদের সম্মান।
বন্ধ হোক পূজা-পূজা খেলা
তবেই সব পরিস্থিতির হবে সমাধান।

এ বছর পূজা না হয় হল অন্য পূজা,
স্বস্তিতে থাকনা মানুষ গুলো,
এক সাথে সব জটলা করে
সংক্রমণ ছড়ানো নাই বা হল!

পথের ভিখারি গুলো না হয় চাঁদার পয়সায়
পেট পুরে খাকনা্ লুচি।
কোটি টাকার খরচ বাঁচিয়ে
দেশের সবার মন হোক না সুচি।

আনন্দে না হয় ক দিন থাকুন,
ঈশ্বরের ঙ্গানে হোক না জীবের সেবা।
এস, সবাই মিলে এক সাথে ধরি হাল
দেখি আসে ক'জন-কেবা!,

 

করোনাসুর

আশিস হালদার


বিনামেঘে বজ্রাঘাতে উঠলো কেঁপে দেবালয়,
দেব-দেবীরা শঙ্কিত খুব, এ কোন মহাপ্রলয় ?   
অসুর যারা, ত্রস্ত তারাও, এমন বিপর্যয়ে
দেবতাসুর সবাই মিলে কাঁপছে ভীষণ ভয়ে। 
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, ফন্দি আাঁটেন মনে,
দেবালয়ে অশুভ বিপদ লুকিয়ে কোনখানে ?  

চারিদিকে খোঁজ খোঁজ রব, নারদ মুনিও ফেল,
মা দুর্গার এন্ড্রয়েডে হঠাৎ আসে মেইল।
মহিষাসুর ভাবছে বসে পুজোর অনেক দেরী,
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, করলো কার্ফু জারি?  
স্যানিটাইজার, মাস্ক ব্যবহার করেন দেবতাসুর,
আকাশ ফেটে আওয়াজ এল আমি করোনাসুর।

কবিতা

অনির্বাণ ঘোষ


এই কবিতার প্রথম লাইনটি আমার দেওয়া।
তারপরে এগিয়ে নিয়ে গেছে পর্ণমোচী বৃক্ষ,
পাতায় পাতায় ছড়িয়েছে সেখবর
এখন গোটা একটা অরণ‍্য বসে আছে কবিতার একটা স্তবক
লিখবে বলে...
সমুদ্রের লবণ,পাহাড়ের ঢেউ-এরা কবিতায় অলংকার বসাবে,
একটুকরো শীতকালীন মেঘ; কবিতার শেষে তুলে ধরবে উপমা-
"জীবন আর কবিতা কি আলাদা?"

এই কবিতা প্রকাশ পাবে শহরের সমস্ত অলিগলিতে,
ঘুমানোর আগে এটি পাঠ হবে বাধ‍্যতামূলক।
সুনীল গঙ্গোপাধ‍্যায় আশ্বাস দিয়েছেন — এই কবিতা দিয়েই
তিনি আবার শুরু করবেন কবিতাজীবন...

কবিতা প্রকাশের লগ্ন আসন্ন,
অত‍্যন্ত জাঁকজমক আয়োজন, ভারতে প্রথম।
ট্রাফিকজ‍্যাম,সাথে ভাদ্রের বিষাক্ত গরম...
সমস্ত পোশাক খুলে এগিয়ে এলেন শাসক,
'নগ্ন!'....
তাঁর হাত দিয়েই হবে এ কবিতার উদ্বোধন।।

কুয়াশামানবী

সুমনা ভট্টাচার্য্য


উৎসব শহর রোজ বদলে চলে সুখের মায়াবী পোশাক আশাক
এসময় বড়োই বেমানান তুমি কুয়াশামানবী-
তোমার চোখ ঘেঁষে হেঁটে যায় নিঝুম অঘ্রানের করিডোর
অচেনা অক্ষাংশ দ্রাঘিমায় নিবিড় মুখজমিন-সরেজমিন;
জানলার মার্জিনে মেঘ,ইম্পোর্টেড পরদায় এলোমেলো ওড়ে একলা হাওয়া
ফ্লোর টাইলস ঠিকরে বেরোয় হার্বাল হাসি –যথাযথ ঢেকে রাখে অলিগলি-
কার্নিস বেয়ে গড়ানো আঁশটে  অনিবার্যতা ...
ব্যালকনির রেলিং এ মানিপ্ল্যান্টের শর্তসহবাস; 
রাজপথ মেতে ওঠে দমবন্ধ যূথচারী সংলাপে
ছাতিমের পাপড়ি মেলে দ্যায় জমে থাকা সম্বৎসরের মনখারাপের গন্ধ-
উৎসব যায় আসে ,ছোঁয় না তোমার ইনসুলিন নির্ধারিত শরীরশস্য;
তোমার কেউ কি ছিল রক্তের ,শাখাপ্রশাখার সমবায়ে?
এই এলইডি-শীতাতপ কমনীয় বাক্স বিষাদে কেউ কি থাকে স্পর্শের উপকণ্ঠে?
তোমার আঙুলের উদ্দেশ্যহীন ট্রেন মাঝেসাঝে থমকে দাঁড়ায় সিডেটিভ, ভার্চুয়াল স্টেশনে;
আলগোছ আঁচলে ঢেকে যায় কোমরের পৃথুল অবসর,
সামলে চলে আলোপেছল ইতিহাস ,
ত্বক বুনে চলে অনর্গল শীতলপাটি-ভাটিয়ালির গান।
বুকে ভর দিয়ে এগোয় সময় - আলো-আঁধারির রোলার কোস্টার ,
মাদারির তারে পা টিপে এগোয় কিন্নরী,
ম্যাজিশিয়ানের দু’হাত তখন রাতের পকেট থেকে হাতসাফাই করে শূন্যতা...
মণ্ডপে মন্ত্র, ধুপধুনো ঘোর- জনগনমন অনিকেত-
এসব উৎসব উর্বরতা কাটিয়ে তুমি জেগে ওঠ
যেন কোন প্রত্ন-বদ্বীপ...

           


গন্ধ 

সোহিনী রায় 


ছেলেটা প্রিয় গন্ধ মানে বোঝে বইমেলা আর বইপাড়া।
মেয়েটা গোলাপ নয়,শিউলি আর জুঁইয়ের গন্ধ ভালোবাসে।
ছেলেবেলা খোঁজে পুজোর গন্ধ।
কৈশোর খুঁজে চলে প্রেমের সুবাস।
কেউ চায় ধূপ ধুনোর গন্ধ,
কেউ বা ডেনড্রাইট।
সদ্য মা হারা ছেলেটা খুঁজে চলে মায়ের গন্ধ।
সোঁদা মাটির গন্ধ খোঁজে মন।
ভিটে বাড়ির গন্ধ খোঁজে ফ্ল্যাট বন্দি জীবন।
আর আমরা সবাই খুঁজি গরম ভাতের গন্ধ।



মেঘ জলে রোদের স্নান  

সাত্যকি  


মাটির পাশে স্থির হাত আর 
মেঘের নীচে রোদ  
হাত মুছে মুছে যাচ্ছে
নিস্তেজ একটা পাড়ার গল্প

সাদা মেঘের নীচে
যেখানে জমে উঠত খড়ের গন্ধ
মাদকতা বয়ে আনত শরীরে শরীরে
ভাষায় ভাষায় ভরে উঠত শিউলি ঘ্রাণ

আজ শুধু ছিন্ন পালের হাওয়া
মেঘের নীচে আরও অনেক ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ
মাথার পাশে মাথারা এখানে ঘুমায়
বৃষ্টিরা হাত রাখে শুকনো খড়
এলানো মাটির শরীরে
পাথর রঙের কাঠের পিঠে ছত্রাকের জন্ম হয়!

দেবীপক্ষ 

ড. শুভায়ু দে 


 এবার না হয় পূজোটা থাক ওদের সাথে।
 জেমস,রুবিনা,যে বা যারা আরো আছে।
যাদের কাছে,এই পূজো প্রতিদিনের  মতো।
ওদের এবার খুশীটা হোক পূজোর ছাঁচে।

 পিঠ চাপড়ে,বুকের মাঝে আদর দিও।
কাশ-শরতের সেলাই জামা থাকনা ছুঁয়ে।
মেঘপালিশের রোদকাঁথারাও উষ্কানি দিক।
আদরবাসা লেগে থাকুক পড়ার বইয়ে।

 পূজো মানেই বাঙালী না,সবার পূজো।
 আমার, তোমার, ফ্ল্যাটবাড়ি বা মাটির ঘরে।
 বিশের অমন বিষজ্বালা সব যাক না নিপাত।
 নীতিই আছে, সকলেই তো সবার তরে।'

লোডশেডিং এর জীবনখানা, যাদের ঘরে।
ইঁটভাটাতে জ্বালছে যারা আলোর শিখা।
রক্ত দিও,মজা করার সুখটা দিও।
এই পুজোতেই হচ্ছে তা'লে সবার দেখা!



আমার দুর্গেশনন্দিনী   

পার্থ প্রতিম পাল   


প্রায় এক সপ্তাহ পর - রূপংদেহী

জুলজুল চোঁখে তাকিয়ে ছিলো-
যেভাবে তাকালে নদী উথলে ওঠে..
শাপলা ফুল ফুটে উঠে মনপুকুরে।

ত্রিশূলধারিণীর পদতলে বিদ্ধ হলাম 
জবাকুসুম আর রক্তচন্দনের সুগন্ধে
দুর্গেশনন্দিনীর মতো মনের মানুষ পেলাম
ইস্ তোমাকে পেয়ে গান উঠে আসছে... 
জয়ংদেহী জয়ংদেহী যশোদেহী।

প্রেম চেয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে বসে গেলাম
আরাধ্য দেবীর ভেতরে তোমার মৃন্ময়ী রূপ
যা দেবো দশভূজাকে তাই দেবো তোমাকে
তুমি তো এিকালদর্শী আমার দুর্গতিনাশিনী

তুমি স্বর্গাদপীগরিয়ষী
তুমি জগৎজননী
তুমি স্বর্গ,মর্ত্য,পাতাল
তুমি অন্ধকার বিনাশিনী
তুমি প্রেমিকারূপীনি

তুমি আমার মন প্রাণ,প্রাণবায়ু
তুমি আমার প্রেম,পূজা ভগবান
তুমি আমার দশদিক রক্ষকর্তা
তুমি আমার হৃদষ্পন্দন দুর্গতিনাশিনী

ভয় হয়, তোমাকে নিয়েই ভীষণ ভয় হয়!
কাঠামো ছেড়ে মাটি যেভাবে মিশে যায় 
মাটির সাথে,আমাকে একলা করে... 
মিশে যেওনা মাটির সাথে।
হে, মৃন্ময়ী-
প্রণতি হই ;
যেওনা কখনো আমাকে একলা করে
সাজিয়ে রেখেছি অর্ঘ্য আমার মাটির দোড়ে।



স্বপ্ন

মুকুল হোসেন 


 দিন যায় রাত্রি আসে
 রাত্রি যায় দিন আসে।
 কোন এক স্বপ্ন দেখে মানুষ।
 সে কি স্বপ্ন নয়
 না বেঁচে থাকার আশা মাত্র।
 স্বপ্ন শেষ রাত্রি শেষ
 সকাল হলে বোধ কাজ করে।
 সে যে পারে না এড়াতে
 দিনটাতেও স্বপ্ন দেখে।
 সব চিন্তা সকল প্রার্থনা
 সব তার শূন্য লাগে।
 শরীরের স্বাদ নেই আর
 মনের স্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকে।
 চোখ তার ধু-ধু করে 
তাকিয়ে থাকে বহুদূরে।
 চোখে শুধুই  ধাঁধা দেখে।

 ভাবে লোক সমাজের মাঝে বসে।
 কবে আবার উঠবে হাত
 কিছুটা খাবার নিয়ে।
 নিশ্চিন্তে ঘুমাবে কি না আর
 দুটি পেটপুরে ভাত খেয়ে।

অন্য পুজো

উৎস ভট্টাচার্য  

                   

 ঢাকের বাদ্যি বাজার আগেই খুশীতে মন সাজে,
শারদীয়ার আগমনী সুর হাজার কাজের মাঝে৷
বছর ঘুরে মা আসছেন— তাইতো প্রকৃতি আজ,
আভূষণে উঠলো সেজে এমন খুশীর সাজ৷

কর্মব্যস্ত জীবনযাপন প্রাণবন্ত হলো,
ভুলে গিয়ে দ্বন্দ্ব-বিবাদ মনের আগল খোলো৷
বিগ বাজেটের থিমপুজো সব, জাঁকজমকে পূর্ণ,
উৎসবেতেও জ্বলেনি আলো— কারোর ভাঁড়ার শূন্য!

আম্ফানেতে ঘর ভেসেছে, শুকায়নি জল চোখে;
সেই গ্রামেতে উৎসব নেই— স্তব্ধ সবাই শোকে!
তারই উপর করাল ছায়া সঙ্গী  মহামারী৷
মৃত্যুমিছিল অব্যাহত, বাতাস হল ভারি!

করুণাময়ী মায়ের আশীষে সকলে থাক ভালো,
হতাশার সব আঁধার কাটুক, জ্বলুক আশার আলো৷
শারদীয়ার উৎসবে যেন কেউ না থাকে পিছে,
সন্তানেরা দুঃখ পেলে মায়ের পুজো মিছে!

শারদপ্রাতে আঁধার মুছে নবীন রবি উঠুক,
হৃদয় মাঝে মানবপ্রেমের পারিজাত ফুল ফুটুক!

ডানা

পুনম বোস    


এভাবেই উড়ে যায় মৃত ডানার পাখি!
তারা নির্ভয়ে উড়ে গেছে অরণ্য চূড়ার বাসায়
দূরে পাহাড়ি বরফে রাখা থাক আজন্ম শৈশব 
পেঁজা শ্রাবণে সরে সরে যায় পূজোর ভাসান
কাশের ঢাকে বয়ে যায় জীবনের ছেঁড়া রোদ-হাওয়া

এভাবেই উড়ে যায় মৃত জীবনের ফানুস! 
তারা অভয় দিতে দিতে রেখে গেছে অস্তিত্বের গান
ঘরের দেয়ালে বেঁচে থাকবার শপথ
শিশুদের ঠোঁটে ঠোঁটে ঘুমপরি হাসি
বেঁচে আছে ওরা ফিরে আসবার কোল জুড়ে।।

অন্য পুজো

হামিদুল ইসলাম

 
পূজো মানে আনন্দ 
পূজো মানে যে আনন্দের শেষ নেই 
পূজো মানে তোমার সাথে আমার দেখা রোজ
পূজো মানে অফুরন্ত আনন্দ সেখানেই।।

পূজোর সময় নতুন জামা কাপড় 
নতুন কিছু খাওয়া দাওয়া 
পূজোর সময় নারকেল তিল তিশির লাড্ডু 
পূজোর সময় পূজোতে যেনো সব কিছু পাওয়া।।

কিন্তু এবারের পূজো সম্পূর্ণ আলাদা 
এবারের পূজো মানে অন‍্য কিছু 
এবারের পূজোয় নেই সেই আনন্দ স্ফুর্তি
এবারের পূজোয় আনন্দ উৎসব সব যেনো মিছু।।

এবারের পূজোয় ঘরে ঘরে মানুষ এখনো ঘরবন্দি
এবারের পূজোয় আতঙ্কে ঘোরে মন 
এ পূজো ম্লান উৎসবহীন কেবল দায়সারা ভাব 
এ পূজোয় সবার মাস্কে মুখ ঢাকা দূরে থাকে আপনজন।।

অন্য পুজো

চিন্ময় মণ্ডল


আসছে উমা কদিন বাকি ঝলমল চারপাশ,
অনিশ্চিতের প্রহর শেষে প্রাণভরা নিঃশ্বাস। 

বছর জুড়ে জোয়াল টানা দুখের সাতকাহন,
একটুখানি খুশীর ছোঁয়ায় উছলিত প্রাণ মন।

দুঃখ ভুলে সুখ-সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে ভেলা,
আগমনীর আরাধনায় জম-জমাটি মেলা।

শিশুর থেকে যুবা প্রবীন সবার মুখেই হাসি,
কয়েকটা দিন দুঃখ ভুলে সুখসাগরে ভাসি।

দেবী মায়ের বোধন মানেই উমার আরাধনা,
খুশীর জোয়ার চতুর্দিকে মন যেন আনমনা।

উপচে পড়া খুশীর সাজে ঝলমল চারধার,
অশীতিপর পরাণ খুড়োর মনটা কেবল ভার।

মাটির দোরে বসে খুড়োর উদাস করুণ মুখ,
খুশির ছোঁয়া সকল ঘরে খুড়োর মনে দুখ।

ভাঙাচোরা মাটির দোরে ফ্যালফেলিয়ে খুড়ো,
পলক বিহীন দৃষ্টি  নিয়ে শূন্যে তাকায় বুড়ো।

সজল চোখে বৃষ্টি নামে কপোল ভাসে বানে,
স্থানুর মতো বসে খুড়ো উচ্ছ্বাস নেই প্রাণে।

ভগ্ন বসত জীর্ণ কাপড় একাকী এক কোণে,
পরাণ খুড়োর হেলদোল নেই উমার আগমনে।

বংশেতে তার কেউ বেঁচে নেই একারই সংসার,
আত্মীয় তার গ্রামের মানুষ নিয়েছে সব ভার।

সারাবছর উৎসবে আর নামলে পুজোয় ঢল,
আনন্দ নেই খুড়োর মনে কেবল চোখে জল।

শোকে পাষাণ পরাণ খুড়ো একলা মনের দুখে,
নিজের মেয়ে উমায় খোঁজে রা কাড়েনা মুখে।

সেই যেবারে গাঁ ভাসলো পুজোর আশেপাশে,
ভয়াল বানে ডুবলো ভিটে দামোদরের গ্রাসে।

দিনটা ছিল পুজোর আগে পিতা-পক্ষের শেষ,
আকাশ বাতাস ছড়িয়ে ছিল মহা খুশীর রেশ।

খুড়ো তখন ব্যস্ত বেজায় দেবী উমার কাজে,
ঘর সংসার সকল ভুলে একাগ্র তার কাজে।

পরাণ খুড়ো গড়তো উমা নিজের মতন করে,
জাগত উমা তুলির ছোঁয়ার অশেষ যতন ভরে।

খুড়োর ঠাকুর গড়ার খ্যাতি আশেপাশের গাঁয়,
জনজোয়ার পড়তো ভেঙে দেখতে প্রতিমায়।

গড়তো খুড়ো একটা কেবল একটাই প্রতিমা,
প্রতিমাতো নয় দেখতে যেন অবিকল তারি মা।

সব ঠিকঠাক চলছিল বেশ ফি বছরের মত, 
প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে উমায় খুড়ো বিভোর তত।

হুড়মুড়িয়ে বাঁধ ভেঙে জল ভাসালো গ্রামটাই
চকিত বানে ভাসলো ভিটে নেই কোত্থাও ঠাঁই।

ভাসিয়ে নিল স্বপ্ন খুড়োর ভাসালো ঘর-ও-বার
একই সাথে খুড়োর আশার সব হল ছারখার। 

বান ভাসি সব মানুষ যখন ব্যস্ত বাঁচার তরে
খুড়ো তখন পাঁজা করে আঁকড়ে উমায় ধরে।

উমা যে তার মা'য়ের মতন নিজের হাতে গড়া
কেমন করে ভাসায় তাকে এমনই গাঁটছড়া! 

পড়েন খুড়ো দোটানাতেই বাড়ে বানের জল
দেবী উমায় জড়িয়ে বুকে কাঁদেন অবিরল।

পরাণ খুড়োর ছোট্ট মেয়ে তারও নাম উমা
নিজের গড়া প্রতিমাও ঠিক যেন তার উমা।

খুড়োর মা ও মেয়ে উমা প্রাণের অধিক প্রিয় 
জড়িয়ে মা'কে ইষ্ট জপেন বলেন ক্ষমা দিও।

চোখ বুজিয়ে ডাকেন মা'কে রক্ষা করো মাতা
তোমার অধম সন্তানদের তুমিই পরিত্রাতা। 

বানের জলে ঘর ভেসে যায় সেই দিকেতে চেয়ে 
বাঁচার লড়াই লড়ছে তখন খুড়ী ও তার মেয়ে।

উমা তখন জড়িয়ে গলা আঁকড়ে ধরে মাকে
বাঁচার জন্যে মরিয়া লড়াই কাদা জলের পাঁকে।

লড়াই থামে প্লাবন তোড়ে মা-মেয়ে ভেসে যায় 
বিপুল জলরাশির দমক আছড়ায় সীমানায়।

লড়াই থামে মা ও মেয়ের বানের জলের বাঁকে
পরাণ খুড়োর স্বপ্ন হারায় ঘোলা জলের পাঁকে।

ছোট্ট উমা মা'য়ের সাথে হারায় বানের জলে
আঁধার নামে খুড়োর ঘরে অথৈ জলের তলে।।


- ( ২ ) -



    নির্মলাদেবী জীবনে বহু ঝড় ঝাপটা সয়ে এসেছেন। তাঁরা মোট তিন ভাই দুই বোন। নির্মলাদেবী সবার বড়। তবে তাঁর জন্মের আগে আরও দুই ভাই জন্মে ছিল কিন্তু জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই হাম হয়ে তারা মারা যায়। নির্মলা দেবী আর ঠিক তাঁর পরের ভাই ও আক্রান্ত হয়েছিল হামে তাই নির্মলাদেবীকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁর মামারবাড়িতে আর সেখানে থেকেই মানুষ হতে থাকেন নির্মলাদেবী। নির্মলাদেবীর মা যাঁর জন্ম প্রায় আজ থেকে একশ বছর আগে তিনি তখনকার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষর করা স্নাতক হওয়ার প্রশংসাপত্র রয়েছে নির্মলাদেবীর মা'র নামে। তাঁর বাবাও তখনকার হিসাব অনুযায়ী যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন এবং খুব সুন্দর নাটক লিখতেন। সেই গুণ কিছুটা নির্মলাদেবী এবং তাঁর ছোটো ভাই এর মধ্যে বিদ্যমান আর পুরোপুরি বিদ্যমান বড় মেয়ে জয়িতার মধ্যে। তবে জয়িতা সব চেয়ে ভাল লেখে কবিতা সেদিন জয়িতা না থাকা কালিন মাঝে মাঝেই জয়িতার কবিতার খাতা দেখতেন তিনি আর সেই খাতা দেখতে গিয়েই সেদিন চোখে পড়ে গেলো রিপোর্টগুলো।
    জয়িতার বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই চোখাচোখি হয়ে গেল মা নির্মলাদেবীর সাথে। 
    ‘‘জয়ী, চোখে মুখে জল দিয়ে জামা কাপড় বদলে ঠাকুরঘরে একবার আসিস’’ —  এই কথা বলে মা নির্মলাদেবী চলে গেলেন সুগন্ধী ধূপ হাতে নিয়ে সমস্ত দেব দেবীর ছবিতে ধূপ দেখাতে দেখাতে। 
    জয়িতা শুধু জিজ্ঞাসা করল — ‘‘বাবা কোথায় মা?
    — ‘‘কোথায় আবার যেখানে এখন থাকে রতনকাকুদের বাড়ি দাবা খেলতে। তুমি একটু তাড়াতাড়ি ঠাকুর ঘরে এস।’’
    জয়ীতার এখন সব সময় কেমন যেন ক্লান্ত লাগে। সেদিন হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে প্রথমে পাঁচদিন ভর্তি রেখে তার জরায়ু থেকে স্যাম্পেল নিয়ে বায়োপসি করা হবে। তারপর করা হবে অপারেশন যার নাম 'ফুল হিসটেরকটমি' অর্থা তার শরীর থেকে বাদ পড়বে জরায়ু, ইউটেরাস আরও অনেক ইত্যাদি প্রভৃতি অর্থাৎ আর কোনোদিন মা হতে পারবে না সে অর্থাৎ নারীত্বের একদিকের স্বাদ সে কোনোদিন পাবে না।
    লুকিয়ে রাখা  রিপোর্টগুলো ঠাকুরঘরে মার হাতে দেখে থতমত খেয়ে গেল জয়িতা....।
    কথাটা বীরেন্দ্রবাবুর ঠিক বোধগম্য হল না। নির্মলাদেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি কেমন যেন বাকরহিত হয়ে গেলেন। আর তারপর শুধু একটা কথাই বললেন — ‘‘এই মেয়েকে তো কেউ বিয়ে করতে চাইবে না।’’
    বীরেন্দ্রবাবু অর্থাৎ জয়িতার বাবার কাছ থেকে এই উত্তর আসবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি নির্মলাদেবী। তিনি শুধু আগুনে চোখে ঘৃণা মাখিয়ে বলতে পারলেন — ‘‘চিরটাকাল মেয়েদের বোঝাই ভেবে এলে? তোমার বড় মেয়েতো চাকরী করে সংসার টানে তাও....তাও!’’
    কোনো এক আত্মীয়ের বিয়ে বাড়িতে গিয়ে বীরেন্দ্রবাবুর পছন্দ হয়ে যায় নির্মলাদেবীকে এবং তারপর কিছুদিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর একপ্রকার দু বাড়ির অমতেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় দুজনে আর ভাড়া বাড়িতে আলাদা সংসার শুরু হয় তাদের। প্রথমে যতখানি খোলামেলা মনের মনে হয়েছিল বীরেন্দ্রকে আস্তে আস্তে সে ভুল ভাঙতে থাকে। বীরেন্দ্রর ছিল পুত্র সন্তান লাভের প্রবল ইচ্ছা যার ফলে টানাটানির সংসারে তিন তিন বার আঁতুরঘরে ঢুকতে হয় নির্মলাদেবীকে আর প্রতিবারই কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর বীরেন্দ্রর মধ্যযুগীয় মনটা আরও বেশি বেশি মুখোশ খুলতে থাকে। কিন্তু আজ যখন মেয়ে জীবন মরনের প্রান্তে এসে উপস্থিত তখন বীরেন্দ্রবাবুর এই কথা ছাই চাপা আগুনটা জ্বালিয়ে দিল নির্মলাদেবীর মনে।
                                                    
ক্রমশঃ ---------


পাঠ প্রতিক্রিয়া - eইলশেগুঁড়ি-১

দীপক আঢ্য


    মোবাইলে পেলাম ঝকঝকে eইলশেগুঁড়ি দ্বিমাসিক অনলাইন পত্রিকা। লকডাউন বিশেষ সংখ্যা, মে-জুন ২০২০। এর আগে বিভিন্ন ই-ম্যাগাজিন হাতে এলেও কতকগুলি বিশেষ কারণে এই পত্রিকাটি মনের কোণে একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। তার সর্বপ্রথম কারণ হল পত্রিকাটির ঝকঝকে উপস্থাপনা ও ফ্রেন্ডলি অ্যাকসেসিবিলিটি। এ তো গেল টেকনিক্যাল কথা। পত্রিকার শুরুতেই  কবি আর্যতীর্থের ‘কবিতা নয়’ কবিতায় সদ্য-প্রয়াত শিল্পী ইরফান খানের প্রতি যে শ্রদ্ধা কবির কলমে উঠে এসেছে তা এককথায় অনবদ্য। ঠিক একই ভাবে কবি চিন্ময় মণ্ডলের দুটি কবিতাকেও উল্লেখ করা যায়, যেখানে চুনি গোস্বামী ও ঋষি কাপুর দুজনেই সমুজ্জ্বল। 
    লকডাউন যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটা সুফলও বয়ে আনতে পারে তার উদাহরণ ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকেও নাকি প্লেগের ভয়ে গৃহ বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল কিছুকাল। এমনকি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বহু নাটক ও সনেটগুচ্ছ যে লকডাউনেরই ফসল তা বহু বিদগ্ধ পণ্ডিতের কলমে উঠে এসেছে বারংবার। তবুও এতটা উচ্চকিত না হলেও বলব, ‘কবিতা গুচ্ছ’২ বিভাগে প্রায় আঠারো জন কবির অনেক কবিতা পাঠকের নিভৃত অবকাশে ছুঁয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। এই ব্যাপারে সবুজ সরকার, তাপসী শতপথী পাহাড়ী, অজিত কুমার করের কথা উল্লেখ্য। ‘কবিতা গুচ্ছ’ ১ বিভাগেও তেমনি, সুজন পাল , সুমন দিন্দা চিন্ময় মণ্ডল , দেবব্রত ঘোষ মলয় প্রমুখর কবিতার বিষয় পাঠকের ভালো লাগবে আশা করা যায়। তুলনামূলক ভাবে গদ্যাংশ অনেক বেশি দুর্বল বলে মনে হলেও তুহিন কান্তি বিশ্বাসের লকডাউনের দিনলিপি ভালো লেগেছে। ধারাবাহিক লেখাটি এর আগে আমার পড়া হয়নি বলে সেটি সম্পর্কে আলোচনা থেকে রহিত থাকলাম। 


লিটল ম্যাগাজিন আলোচনা

কুঁড়ি

আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ৷৷ আগস্ট ২০২০
সম্পাদক— দেবব্রত ঘোষ মলয়

আলোচক — নির্মলেন্দু কুন্ড  


খুব মনে হয় আবার আমি ছোট্ট হতাম যদি
সাত সাগরে মিশতো আমার ইচ্ছেখুশির নদী

    এই করোনাকালে বাড়িতে থাকতে থাকতে খুব বুড়ো না হয়ে পড়লেও স্মৃতি রোমন্থনে খামতি নেই আমার ৷ তাই এই যৌবনে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়ছে আমার শৈশব আর কৈশোরের কথা ৷ মনে পড়ছে সেইসব ছেলেমানুষির কথা, যা এখন ভাবলেও হাসি পায় ৷ মনে পড়ছে চাঁদমামা, শুকতারা আর আনন্দমেলার পাতায় হারিয়ে যাওযার কথা ৷ এমনই এক মুহূর্তে আমার হাতে এল ইলশেগুঁড়ি প্রকাশনীর ছোটদের পত্রিকা 'কুঁড়ি'-র আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ৷ বাড়ির বড়রা যেমন আগে আমার হাতে তুলে দিতেন পত্রিকার নতুন সংখ্যা, এখনও তেমনি আমার হাতে থাকা মোবাইলে যত্ন করে এই নতুন পিডিএফ সংখ্যাটা পাঠালেন অগ্রজ দেবব্রতদা ৷
    পত্রিকাটি সাজানো রয়েছে অসংখ্য কবিতা, ছড়া, গল্প, একটা কমিকস ও বেশ কিছু সুন্দর হাতে আঁকা ছবি দিয়ে ৷ সকাল দেখে যেমন বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে, তেমনি প্রচ্ছদের ব্যাক কভারে অর্থাৎ ফ্রন্টাল ব্যাকে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র পল্লব কুমার পালের আঁকা ছবিটা দেখে মন ভরে গেল ৷ ছড়া ও কবিতাগুলির বেশিরভাগই খুব ভালো ৷ তার মধ্যেও ডঃ রমলা মুখার্জী, গোবিন্দ মোদক, সৃজন পাল, দীপক আঢ্য, অর্ণব গরাই, স্বপনকুমার বিজলী, মিন্টু প্রামাণিক, কপিলদেব সরকার, ব্রজকিশোর রজক, রাজীব মিত্র, তুহিন কান্তি বিশ্বাস, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়তী পাত্র প্রামাণিক, শঙ্কর কুমার চক্রবর্তী, অমিতাভ দাস প্রমুখরা দারুণ লিখেছেন ৷ অনেক নামই বাদ থেকে গেল ৷ ছড়া মানেই কিন্তু মন ভোলানো কিছু কথার ফুলঝুরি নয়, সেইসাথে বর্তমান সময়কেও ধরার চেষ্টা করেছেন কিছু কবি ও ছড়াকার ৷ আমার চোখে রাজীব মিত্রের "আমরা কুঁড়ি" কবিতাটি এই পত্রিকার মলাট-কবিতা ৷ লক ডাউনে আমাদের থেকেও বেশি হাঁপিয়ে উঠেছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো— সেই সত্যিও ফুটে উঠেছে তুহিন কান্তি বিশ্বাসের কবিতায় ৷ অনিন্দ্য পালের "ছোটবেলা" কবিতাটি আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ালো ৷ প্রদীপ কুমার পালের "শিশুদের নজরুল" কিছু অজানা কথার সন্ধান দেয় ৷ গল্প বিভাগে সিদ্ধার্থ সিংহের 'খেঁকশিয়ালের লেজের রঙ' আমাদের সেইসব উপকথার জগতে নিয়ে যায়, যা আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি কিছু সদুপদেশও দিত ৷ এছাড়া সমর মিত্রের 'পায়রা ও পেয়ারা', বিনয় ভড়ের 'পত্রী ও মোম', পূর্বাসা মণ্ডলের 'মায়ের কোল', রাজকুমার ঘোষের 'বিট্টুর কেরামতি' সুন্দর লাগলো ৷ তবে এই পত্রিকার সম্পদ কচি-কাঁচাদের আঁকাগুলো ৷ কিছু ক্ষেত্রে ওগুলোই হয়েছে কোন গল্প বা কবিতার অলংকরণ ৷ কিছু আঁকার হাত যথেষ্ট পরিণত ৷
    শতাধিক পাতার এই পত্রিকাটিতে খুবই সামান্য কিছু বানান ভুল আছে, যা সম্পাদকের মুনসিয়ানার পরিচয় দেয় ৷ তবে আমি নিশ্চিত, আগামী সংখ্যায় এটুকুও থাকবে না ৷ এই 'কুঁড়ি' যে ভবিষ্যতে শতদল হবে, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই ৷ আগামী সংখ্যার অপেক্ষায় রইলাম, মনটাকে আরও একবার ছোট্টবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এইরকম কুঁড়িরাই ভরসা ৷














No comments

Theme images by luoman. Powered by Blogger.