ইলশেগুঁড়ি ই পত্রিকা ৮
এবার প্রচ্ছদ শিল্পী দীননাথ সাহা
সম্পাদকীয়
শিল্পী ও শিল্প
প্রকৃতির কাছের শিল্পী তাপস গঙ্গোপাধ্যায় - সুবোধ পাণ্ডে
কবিতা
ভালবাসার রূপকথা - তনিমা সাহা
সিংহ দরজা - সুবোধ পাণ্ডে
ভেতরের মানুষ - সুপ্রিয় মান্না
আনুগত্যের বোঝা - অনুপম দাস
অপরাজেয় - শ্যামল কুমার রায়
সিগন্যাল - সঞ্জীব দে
পাখির বাসা - দিলীপ পাল
জীবনশৈলী বিষয়ক - উত্তম চৌধুরী
রাজা - স্বপনকুমার বিজলী
কালবৈশাখী ঝড়ের সময় - অঞ্জলি দে নন্দী, মম
ঘুমিয়ে গেছে প্রেম - ইঞ্জামামুল হক
প্রখর রোদ্দুর - মহাজিস মণ্ডল
কেউ হারায়নি - অমলেন্দু কর্মকার
রূপকথা চাই - ঝুম্পা বাগ
সত্যের সদা জয় - শুভ্রা ভট্টাচার্য
সেলফি - মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় রায়
প্রচ্ছদ - সুমনা ভট্টাচার্য্য
একলা এ মন - অঞ্জন দাস মহাপাত্র
দুঃখের পাণ্ডুলিপি - তুষার ভট্টাচাৰ্য
জ্ঞানগান - শীতল চট্টোপাধ্যায়
রবিবার - সুস্মিতা শীল
গল্প
অ-বলা কথা - নন্দা রায় পোড়েল
ভুতুড়ে বাড়ি (ছোটোগল্প) - সুদীপ সরকার
ধারাবাহিক উপন্যাস
কর্কটক্রান্তি - অমিতাভ দাস
যাপন যতই ধূসর হোক, জীবন থেমে থাকে না।
মানব সমাজ গত এক বছরেরও বেশী সময় থমকে গেছে, এখনো স্বাভাবিক নয় কিছুই। আমরা হারিয়েছি অনেক সুহৃদকে, হয়েছে অনেক ক্ষতি। এখন সময় নয় ভাবালুতার, চাঁদ ফুল জ্যোৎস্নার কাব্য লেখার। তবুও, মানুষ ফিনিক্স পাখির মত ছাই ঝেড়ে মাথাচাড়া দিয়ে বারে বারে জেগে ওঠে।
আমরাও এই সব সয়েই সৃজনের মধ্যে থাকার চেষ্টা করছি। নিয়ম মেনেই প্রকাশিত হল ইলশেগুঁড়ি ই-পত্রিকার অষ্টম সংখ্যা।
প্রিয় পাঠক, আপনার সুচিন্তিত মতামতই আমাদের একমাত্র প্রেরণা এই কঠিন সময়েও নিয়ম করে পত্রিকা প্রকাশের।
সবাই সুস্থ থাকুন, সাবধানে থাকুন।
দেবব্রত ঘোষ মলয়
সম্পাদক
শিল্পী ও শিল্প
প্রকৃতির কাছের শিল্পী তাপস গঙ্গোপাধ্যায়
সুবোধ পাণ্ডে
পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা নিসর্গের দুর্বার আকর্ষণ, জন্মের পর থেকে, শিশুবেলা থেকে কাউকে কাউকে এমন ভাবে টানে, বলতে গেলে অস্থি মজ্জায় এমন জড়িয়ে যায় যে, সেই সুন্দর থেকে সহজে তার মুক্তি মেলে না।
এমনই এক পাহাড় জঙ্গল ঘেরা উড়িষ্যার রাউরকেল্লার অন্তর্গত সুন্দরগড় জেলার ছোট্ট এক গ্রামের কোলে ১৯৭০ সালে জন্ম হয়েছিল শিল্পী তাপস গঙ্গোপাধ্যায়ের।এবং যথারীতি এখানেই বেড়ে ওঠা।
পিতা গোপাল চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলের ফার্মাসিস্ট কাম সুপার।কলেজের দায়িত্বপূর্ণ সমস্ত কাজ সামলানোর পরও অফুরান উদ্যমে আন্তরিক প্রচেষ্টায় পাশাপাশি আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের অনুন্নত সম্প্রদায়ের কিশোর যুবকদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ফুটবল টিম,যা সেই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে খুব সহজ কাজ ছিল না।এছাড়া তাঁর ছিল বাগান করা,পশুপাখি পালনের শখ।শখ ছিল অ্যাকোরিয়ামের।
স্ত্রী পদ্মাবতী দেবী ছিলেন এ ব্যাপারে সমান উৎসাহী।হাতে কলমে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে অনুপ্রেরণাও জোগাতেন সর্বাবস্থায়।
সন্তান পালনের ক্ষেত্রেও উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন দুজনে।তাই সন্তানদের শিশু বয়সে খেলতে খেলতে পড়াশোনা অগ্রাধিকারই দিয়েছিলেন তাঁরা।ফলত ছোট্ট তাপস এবং তার দিদি প্রকৃতির উন্মুক্ত পরিবেশে খেলে বেড়াতেন, দৌড়ে বেড়াতেন।আনন্দমুখর তানে প্রকৃতির রূপ রস উপলব্ধি করতেন প্রতিটি মুহূর্তে।
তবে শিল্পের প্রতি তাপসের গভীর অনুরাগ জন্মায় তাঁর মামাদের থেকে।পাঁচ মামার প্রত্যেকেই ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক।ছবি আঁকা,নাটক করা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকা ছিল তাদের স্বভাব ধর্ম।
তবে সব মামাদের মধ্যে থেকে ছোট মামা সঞ্জীব রায়ের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।এই মামা দুর্দান্ত ছবি আঁকার সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার গান গাইতে পারতেন।
এছাড়াও শিল্পী তাপসের দিদিরও ছিল ওড়িশি নৃত্যের প্রতি টান।শিখতেন মনপ্রাণ ঢেলে।
সব মিলিয়ে এমন এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, উদার উন্মুক্ত জল হাওয়া তাকে শিল্পের প্রতি ক্রমশ অনুরক্ত করে তোলে।
চার পাঁচ বছরের শিশুবেলা থেকেই মামাদের দেখাদেখি কাগজে আঁকিবুঁকি করতে শুরু করেন তাপস।
ওই বয়সেই কেমন করে যেন তার প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতেই বেশি ভালো লাগত।
পরবর্তীতে প্রথাগত বেটার এডুকেশনের লক্ষ্যে তাপসেরা চলে আসেন চুঁচুড়ায়।যদিও পিতা কর্মসূত্রে উড়িষ্যাতেই থাকতেন।এখানে স্কুল জীবনের শিক্ষার পাশাপাশি চলতে থাকে ওর আপন খেয়ালে ছবি আঁকা। তখনও পর্যন্ত তিনি যে শিল্পীই হবেন, এমনটা ভাবেন নি।
সে ঘটনার মোড় নেয় একটা ছবি আঁকা কম্পিটিশনের মধ্যে দিয়ে।
ছোট মামার উৎসাহে জীবনে প্রথমবার চুঁচুড়া অঞ্চলের একটি ক্লাবে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় নাম লেখান তিনি।
সেখানে আলাপ হয় সুজিত সেন নামের সমবয়স্ক একটি কিশোরের সঙ্গে। প্রথম প্রাইজ পাওয়া সুজিত এবং দ্বিতীয় প্রাইজ পাওয়া তাপস এরপর যেন অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু হয়ে যান।এরপর সুজিতের হাত ধরে আলাপ হয় চন্দননগর নিবাসী প্রখ্যাত শিল্পী ও শিক্ষক পার্থ ভট্টাচার্যের সঙ্গে।
অসাধারণ ছবি আঁকেন পার্থবাবু। ভারতের অগ্রগণ্য শিল্পীদের মধ্যে তাঁকে ধরা হয়।
শিক্ষক হিসেবে পার্থবাবু ফ্রেন্ড ফিলজফার কাম গাইডের ভূমিকা পালন করেন।তাঁর আন্তরিক শিক্ষাদান এবং অসম্ভব উৎসাহ, অনুপ্রেরণায় কলকাতা গভর্মেন্ট আর্ট কলেজে চান্স পান তিনি।
কলেজ জীবনে বহু শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ভাবে পার্থবাবুর কাছেই পাঠ নিতেন।এছাড়া সুযোগ পেয়েছেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক শ্রীমতী গীতা ভট্টাচার্যের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করার।
১৯৯২ সালে আর্টকলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসার পর জীবন সংগ্রামের তাগিদে সম্বলপুরের কাছে কিছুদিন একটি প্রাইভেট স্কুলে আর্টের শিক্ষকতা করেছেন।এ অঞ্চলের পরিমণ্ডল জুড়ে দণ্ডকারণ্য,কোরাপুট ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ পাহাড় জঙ্গলের আবহ যেন নেশাগ্রস্ত করে তুললো তাকে। তাই ছুটির দিনগুলোতে তিনি কাগজ রং তুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন নিসর্গ আঁকতে। বহুদিনের চর্চিত বিদ্যার সঙ্গে আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে তিনি একের পর এক ল্যাণ্ডস্কেপ এঁকে গেছেন।
পরবর্তীতে সেই স্কুল ছেড়ে চলে
আসেন ধানবাদের একটি বিদ্যালয়ে।প্রকৃতির অপার আশীর্বাদের ছোঁয়া এখানেও যেন পেলেন।চলল ফর্ম ভাঙচুরের খেলা,নিজস্ব শৈলী নির্মাণের খেলা।
ছবির মাধ্যম হিসেবে জল রঙ, তেল রঙ অ্যাক্রিলিক কালার চারকোল সবের ব্যবহার তিনি করেছেন। তবে তার প্রিয় মাধ্যম মিক্সড মিডিয়া।
তার প্রিয় শিল্পী হলেন ভিনসেণ্ট ভ্যানগগ। ভালো লাগে গুস্তাভ ক্লিমটের শিল্প কর্ম।ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথের পরম্পরা ধরে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে গণেশ পাইনের কাজ।
চাকুরি জীবনের ছুটির দিনগুলোর ল্যাণ্ডস্কেপ সিরিজ নিয়ে তাপস যখন ১৯৯৫ সালে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে গ্রুপ প্রদর্শনী করলেন, সাড়া পেলেন চমৎকার! বহু সিনিয়র আর্টিস্ট এবং বহু বোদ্ধা তার ছবির অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন। তবে "টেলিগ্রাফ পত্রিকার " বিশিষ্ট সাংবাদিক, ক্রিটিক সমীর দাশগুপ্ত কাগজে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ছাপলেন তাপসের ছবির কথা। তার ছবির বিষয় নিয়ে, মাধ্যম নিয়ে এমন নান্দনিক বিশ্লেষণ খাড়া করলেন যা তাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করল
নিদিষ্ট লক্ষ্যে এগোবার জন্য। আলো হিসাবে সে যেন পথ নির্দেশ করল। সংকল্প করলেন, ছবি নিয়েই বাকি জীবনটা কাটাবেন।
এরপর অনেকগুলি শিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করলেন তিনি। তবে মাইলেজ পেলেন মুম্বইয়ের জাহাঙ্গীর আর্টগ্যালারিতে প্রদর্শনী করতে গিয়ে। সেখানে টাইমস অফ ইণ্ডিয়ার আর্ট ক্রিটিক কাম ফোটো জার্নালিস্ট নিউফ লিনা
আব্রাহাম তার ছবি নিয়ে যে ভালোলাগার কথা ব্যক্ত করলেন কাগজে, যা তাকে আরও অনুপ্রেরণা জোগাল।সেইসঙ্গে বিশেষ ভাবে সমাদৃত হলেন বিভিন্ন স্তরের মানুষের অন্তরে।এবং এ প্রদর্শনী মারফত আর্থিক সাফল্যের খতিয়ান চিহ্নিত করতে পেরে কাজের উৎসাহ আরও যেন আর বেড়ে গেল।এই সময় বিদেশেও তার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী প্রদর্শিত হয়।
এই ঘটনার কয়েক বছরের মধ্যে তাপসের ছবি আঁকার চর্চা বহুগুণ বেড়ে চলে।
২০০৩ সালে ব্যাঙ্গালোরে প্রথমবার একক প্রদর্শনী করার পর মানুষের অন্তরের যেন আরও কাছে পৌঁছোন এই শিল্পী। ছবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্থিক
সাফল্যের দিকটি সমানভাবে চললো।
এই সময় থেকেই প্রাইভেট গ্যালারি গুলোর সঙ্গে নিয়মিত কাজ করার অভিজ্ঞতা তাকে বহুগুণে সমৃদ্ধ করে।
শিল্প জীবনে বিভিন্ন বাঁকে তাপস
অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, স্নেহের সান্নিধ্য পেয়েছেন বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীদের কাছ থেকে। তবে দিল্লির এক আর্ট গ্যালারিতে ব্রাশের স্ট্রোকে করা একটা ঘোড়ার ছবি দেখে প্রখ্যাত শিল্পী সুনীল দাস যে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন, যে ইন্সপিরেশনের আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন, তাতে ওই কম বয়সেই তাপস বুঝতে পেরেছিলেন, প্রকৃত বড় শিল্পীরা সত্যিই কত উদার আর বিনয়ী হন।আজীবন এই শিক্ষাকে ভোলেন নি তিনি।
বিশেষ অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসা পেয়েছেন নামজাদা শিল্পী ও অধ্যাপক গণেশ হালুইয়ের কাছ থেকে।বলতে গেলে প্রকৃতির প্রকৃত অবজারভেশন, প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসার সঞ্চার ঘটে গণেশ হালুইয়ের পরামর্শেই।
তবে লক্ষ্যনীয় বিষয় এই যে ২০০৯ সালের আর্থিক মন্দার কারণে অন্যান্য ক্ষেত্রের সঙ্গে ছবি বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফলে শুধুমাত্র ছবি নয়,তার পাশাপাশি ইন্টেরিয়র ডিজাইন তৈরির কাজে নিজেকে সঁপে দিতে হয় তাপসকে।কেননা ততদিনে পিতা গত হয়েছেন।মা অসুস্থ।নতুন সংসার পেতেছেন।সেই সংসার ধর্ম পালনেরও দায়িত্ব বড় কম নয়।
এই কঠিন সময়ে ছায়া সঙ্গী হয়ে লড়াইয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করেছেন সহধর্মিণী রাঞ্জু গঙ্গোপাধ্যায়। একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুবাদে আর্থিক দিকটা বেশ কিছুটা সামলেছেন তিনি। তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তাপসের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে নিরন্তর অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন,সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন আজও।তাই আজও সমস্ত বিরুদ্ধ হাওয়াকে ঠেলে দিয়ে ছবি আঁকার সঙ্গে তাপসের জড়িয়ে থাকা সম্ভবপর হয়েছে।
তাপসের ছবির বিষয় হিসেবে যে নারী এসেছে, সেও যেন কোথাও
প্রকৃতিরই আরেক প্রকাশ।এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে কখনও প্রতিবাদ,কখনও মানুষের অসহায়তা।
মাঝে মাঝে শিল্পের দাবী মেনেই কখনও কখনও এসে পড়েছে রাঢ় বাংলার মাটির ঘ্রাণে মেশা ঘরবাড়ি,তার বুকের চলমান জীবন।
বিভিন্ন সময়ে ছবিতে বৈচিত্র্যের লক্ষ্মণ পরিস্ফুট হলেও প্রকৃতিই তার আত্মার আনন্দ,তার আবেগের জিয়ন কাঠি।এখনও তাই ঘুরেফিরে প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
ইদানীং এই প্রকৃতির বিমূর্ত রূপেই তিনি মজে আছেন। গাছপালা মেঘ পাহাড় বনের শ্রেণি উঠে আসে রং তুলি চারকোল প্যাস্টেলের হাত ধরে।
প্রকৃতির প্রতি তার এত তন্ময়তার, এত ভালোলাগার কারণ কি?শিল্পী তাপসের কথায়, ‘‘প্রকৃতিই হল আমাদের প্রত্যেকটি মানুষের অনন্ত ভালোবাসা এবং অনন্ত সৌন্দর্যের মূল। আমি আমার শিল্পের মাধ্যমে সেই প্রকৃতির অনুকরণের চেষ্টা করে গেছি মাত্র।’’
এ সৌন্দর্য নেশার সুখ, এ অনাবিল আনন্দের পাশাপাশি শৈশব দিনের কথা ভেবে নষ্টালজিয়ায় ভুগতেও তার ভালো লাগে। তাইতো তিনি আজও ভুলতে পারেন না উড়িষ্যার পাহাড় অরণ্য ঘেরা শৈশব কৈশোরের সেইসব সোনালী দিনগুলো। ভুলতে পারেন না খরগোশ পোষার স্নেহ উজানো ক্ষণ,ভুলতে পারেন না শৈশবের চোখের মণিতে ধরে রাখা অ্যাকোরিয়ামের রঙীন মাছেদের চলাচল,ভুলতে পারেন না পিতা মাতার উদ্যান চর্চার দিনগুলিকে।তাই তো সেই পুরনো শৈশবকে ফিরে পেতে নিজের বাড়িতে করছেন উদ্যান চর্চা। ফুল ফল সব্জিরা সেখানে হাওয়াতে মাথা দোলায়। শাখায় পাতায় কখনও কখনও আসে পাখি ফড়িংয়েরা।
শিল্পী তাপস গাছপালা অরণ্য এত ভালোবাসেন যে,নিজের একমাত্র কন্যার নাম রেখেছেন সিমলি।সেও ছবি আঁকে।
এই শিল্পী অবসরের প্রাঙ্গণে বাউল গান, লোকগীতি ধরেন উদাত্ত গলায়। গাইতে তার ভালোই লাগে।গাইবার সময় আনন্দে চোখ বুজে আসে। এক সময় স্বনামধন্য লোক সঙ্গীত শিল্পী স্বপন বসুর উৎসাহ অনুপ্রেরণা পেয়েছেন যে!এই স্বপনবাবুই এক সময় অবারিত দ্বার খুলে দিয়েছিলেন আন্তরিক, উদার স্বভাবে।
গান তো না হয় গাইলেন তাপস।
লক্ষ্যনীয়, তাপসের এই অবসর প্রাঙ্গণের অন্তরের সুর কোথায় যায়? কি করে?
ওই সুরেদেরও বোধহয় একটা দায়িত্ব বর্তায়।তাইতো সুরের বিপরীতে ওরাও ফিরিয়ে দেয় ভালোবাসা।
কবিতা
ভালবাসার রূপকথা
তনিমা সাহা
ভালবাসার রূপকথা যদি হত্যি হয়, তবে–
তবেকেন ভালবাসা ঠকে বারে বারে
জানি- জানি, বলবে যে মানুষ চিনতে হয়েছিল ভুল;
সত্যিই কি তাই―
কিন্তু তখন তো ভালবাসাটা সত্যি-ই ছিল, তবে–
তবে মিথ্যেটা কোথায় হলো,
যে বৃষ্টিস্নাত সায়াহ্নে ধরেছিলাম হাত তোমার,
দেখেছিলাম তোমার আঁখির গভীরে,
নিভৃতেই ডুব দিয়েছিলাম সেদিন–
তোমার অধরের ঔদ্ধত্য তৃষ্ণায়;
তুমিও তো ছিলে সেদিন সমর্পিত,
বলতে কি পারো…সে সবই ছিল শুধুই মিথ্যে ছলনা,
বলতে কি পারো….মিথ্যে দিয়ে সাজিয়েছিলে তুমি সেসবই,
এই ভালবাসার রূপকথাকে;
কিন্তু রূপকথা যে মিথ্যে হয় না প্রিয়,
মিথ্যে অভিনয় করে সাজানো যায় না রূপকথাদেরকে;
যদি হতো সব মিথ্যে, হতো সব ছলনা, হতো সব শুধুই অভিনয়,
তবে কেন সেই সায়াহ্নে চিকচিক করেছিল তোমার চোখের জল,
যখন তোমার 'তুমিকে' সঁপেছিলে আমার 'আমিতে'।
সিংহ দরজা
সুবোধ পাণ্ডে
অন্যের কারণে যদি তোমার মধ্যে
অসহিষ্ণুতা প্রবেশ করে
ঈর্ষা প্রবেশ করে
প্রতিশোধস্পৃহা প্রবেশ করে
ঘৃণা প্রবেশ করে
ক্ষুদ্রতা প্রবেশ করে
তবে সে তো তোমারই মৃত্যু
আনন্দময় অফুরান ভেতর বেঁচে থাকার
সিংহ দরজা
খোলার আগে
একবার ভেবে দেখো কথাটা....
ভেতরের মানুষ
সুপ্রিয় মান্না
সজোরে ধাক্কা খেলাম সেদিন নিজের সাথে!
বেশামাল পা, ছিটকে পড়লাম মেঝেতে।
অসাড় শরীরটা কিছুক্ষন স্তম্ভিত!
হতবাক হয়ে দেখলাম...
খসে,খসে পড়ছে দেহের ভেতর জমানো যন্ত্রণারাশি-
আমার দোষ-গুন, মান-অভিমান, দুঃখ-শোক,মন্দ-ভালো
সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মেঝেময়, এলোমেলো।
মাথার ভেতর ঘন কুয়াশা যেন ঘিরে রয়েছে
ভারী মাথায় বাড়ছে জটিলতা, বোবার মতো চুপ!
এ শূন্যতা থেকে নিজেকে টেনে তুলতেই হবে!
কেউ টের না পাওয়ার আগেই সাফ্ করতে হবে মেঝে
যা কিছু মঙ্গল, যা কিছু ভালো ও কিছু ভাঙা স্বপ্নকে
বেছে, বেছে তুলে রাখি বুক পকেটে।
হয়তো সেখান থেকেই একদিন আবার মিশে যাবে ভেতরের মানুষে
ততক্ষণে! রুক্ষ, নিকৃষ্ট উপলব্ধিগুলোকে ঝেটিয়ে ফেলি ডাস্টবিনে
হাল্কা লাগছে বেশ! পরিশুদ্ধ ভোরের স্নিগ্ধ আলোয়...
আনুগত্যের বোঝা
অনুপম দাস
মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো টিয়া পাখিটা একদিন খাঁচায় বন্দি হল।
কদিন পর সে আবিষ্কার করল আকাশে মুক্তি আছে, কিন্তু খাঁচায় আছে নিরাপত্তা।
আকাশে ওড়ার পরিশ্রম আছে, খাঁচায় আছে অফুরান বিশ্রাম।
পাখিটা ভাবল আকাশের মুক্ত স্বাধীনতার চেয়ে খাঁচার আনুগত্য আনন্দের।
খাঁচার আনুগত্য স্বীকার করলেও পাখিটার অবচেতনে ছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
তাই সে এখন আনুগত্যের শাসন এড়িয়ে খাঁচার বাঁধন ভাঙতে চায়।
নতুন সকালে মুক্ত আকাশ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে আয় আয়।।
পাখিটার চাঞ্চল্য মালিকের নজরে আসামাত্রই কাটা পড়লো তার সবকটা ডানা।
খাঁচাই এখন বিধ্বস্ত পাখিটার জীবনে চরম বাস্তব, আর মুক্ত আকাশ তার স্বপ্ন।
খাঁচার মধ্যে আজও পাখিটার সুখের আয়োজন রয়েছে আগের মতই।
বাঁচার তাগিদে সে সমস্ত আনুগত্য মেনে নিয়েছে।
প্রতি সকালে মুক্ত আকাশের আহ্বানে তার মন চঞ্চল হয়।
সুখের আশায় আনুগত্যের আনন্দে মশগুল পাখিটা আজ আনুগত্যের বোঝা বহন করছে শুধু বাঁচার তাগিদে।
অপরাজেয়
শ্যামল কুমার রায়
আজ খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে,
ভরসা জোগালে তুমি প্রেয়সী।
কাড়তে পারেনি প্রেম
অতিমারি।
তুমি হেরে গেছো অতিমারি।
হাতে হাত রেখে বাঁচব -
কয়েক যুগ।
জানি, বেশ রিক্ত আমি।
বেকারত্ব আমার নিয়তি।
ছিঃ! আমি না পুরুষ
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা?
আজ বাস্তবের ফেরিওয়ালা।
সিগন্যাল
সঞ্জীব দে
সিগন্যাল সবুজ হলুদ হতে,
হলুদ লালে
সময় লাগে না বিশেষ।
চলার ব্যাকরণ লেখা থাকে
শূণ্যতায় পায় পায়,
বাতাস চোরাগোপ্তা ভাবে
দঙ্গলে ফাঁক খুঁজে খুঁজে এগোয়।
হাওয়ায় ভাসতে থাকে
ন্যায় নীতির প্রকরণ যা কিছু
আলো ছায়ারও একধরনের
বোঝাপড়া গড়ে ওঠে
চিলেকোঠায় তৈরি হয়
যা কিছু গোপন,
কৈশোরের আভিজাত্যের প্রেম,
পাশের বাড়ির জানালার খড়খড়ি
খোলা না খোলার
হাতে খড়ি।
পাখির বাসা
দিলীপ পাল
পাখি গুলো কোথায় গেলো
ভাঙলো ওদের বাসা
উড়ে গেল খড়ের কুটো
থাকল না আর আসা
ঝড় তুফানের বাচ্চা ছানা
সেওতো গেল জলে
জোরাজুরি সেও হারালো
এখনো ভাসার দলে
পাখ-পাখালি ছন্নছাড়া
কে দেয় তাদের ভাষা
ডালপালা সব মাথা মুড়ে
ঘর ভাঙা ঝড় পাশা
গরু-বাছুর ছাগলছানা
তাদেরও এক দশা
ভাঙ্গা ঘরে বসত মানা
বাঁধের উপর বসা
ঘর ভেঙ্গেছে মন ভেঙেছে
শোকে তাপে মরে
কবে আবার জুড়তে পাবে
ভাঙ্গা দলের ঘরে ।
জীবনশৈলী বিষয়ক
উত্তম চৌধুরী
আব্রুগুলো উড়ে যাচ্ছে। একটি একটি করে
খসে পড়ছে আড়ষ্ট ভাব। আমাদের জীর্ণ
মুখোশগুলো লজ্জার হাত ধরে ফিরে যাচ্ছে
কালোর গভীরে। আলোর শরীর বেয়ে
উঠে আসছে অমোঘ দর্পণ। দর্পণে বিম্বিত জীবনশৈলী।
হে শৈলী তুমিই বলতে পারো ইতিবৃত্ত পুরোনো দিনের।
হে শৈলী তুমিই বলতে পারো সমকালে কতটা গ্রহণ।
হে শৈলী তুমিই বলতে পারো ভাবীকাল কার, কাহাদের।
আমাদের তাপ-অনুতাপ, আমাদের অস্থির সময়ের চোখ
তোমার বুকের উপর যেন আশ্চর্য ট্র্যাপিজ খেলছে।
রাজা
স্বপনকুমার বিজলী
রংবেরঙের পদ্ম ফুটে
ঝিলের জলে আছে
পানকৌড়ি মনের সুখে
খেলছে তাদের কাছে ।
সাদা মেঘের ভাসছে ভেলা
নীল আকাশের বুকে
কাঠবিড়ালি মাঠের ধানে
দেখছে গন্ধ শুঁকে ।
শিউলি ফুটে ঝরছে কত
মেঠো পথের পাশে
আটচালাতে ঢাকের আওয়াজ
হাওয়ায় ভেসে আসে ।
ইচ্ছে মতো সব খাওয়া চাই
ফুচকা পাপড় ভাজা
পুজো এলে আমি যেন
চারটে দিনের রাজা ।
কালবৈশাখী ঝড়ের সময়
অঞ্জলি দে নন্দী, মম
গোধূলিতে উঠেছে ঝড়।
কালবৈশাখী, করছে তান্ডব নৃত্য।
ধ্বংস কার্য তো ওর নিত্য ভৃত্য।
ভেঙে দিল কর গরীব ঘর।
কত বিটপি শাখা।
সেথায় থাকা
কত বিহঙ্গ বাসা।
ঠিক তেমনই সময় তুমি এলে।
দিলে ঢেলে
প্রলয়ংকর ভালোবাসা।
আমি পারি নি তা নিতে।
প্রবল তোমার সে ভালোবাসা
ওলট পালট করল আমার চাওয়া পাওয়ায়।
হল বিপরীত হিতে।
তোমার চলে যাওয়ায়
ছিল আমার পরিপূর্ণতা পাওয়ায়।
ঘুমিয়ে গেছে প্রেম
ইঞ্জামামুল হক
প্রেম,তুমি এত কমদামী,দশমাসে ফেলে যাও ডাস্টবিনে ?
পাথরের ঘাড় ভেঙে বয়ে চলে নদী;জমা পলি নেবে কিনে ?
শিশুগাছ মাথা উঁচু করে আকাশ দ্যাখে পাথরের বুক চিরে
চাতকের চোখ বর্ষায়,তালগাছে ঝুলন্ত ঘরে দেখি বাবুই পাখিরে ।
সিগারেটের বিলাসিতা দেখে বুঝি লজ্জা পায় তামাক পাতা !
জনমের অধিকারে পাওয়া পরজীবী শিশু ভুলে বাড়ির ছাতা ।
সজনের ডালে ফিঙের ভিড়,নদীতে ভাসে অজস্র মাছ
কবরে শুয়ে থাকে নাড়ির টান, মানুষের প্রেম ঘুমায় আজ ।
প্রখর রোদ্দুর
মহাজিস মণ্ডল
আমার নিভৃত যাপনে দেখি খেলা করে
দুরন্ত সময় আর নদী
আদিগন্ত রাত আর গল্পের ধারাপাত
ক্রমশ প্রহর পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে আলো
আমার শহরের সমস্ত অন্ধকার ভেসে যাচ্ছে
আমার পায়ের নিচে দৃঢ় মাটি চারপাশে বিশ্বাসের শিকড়
নক্ষত্রের ডানার ভিতর শব্দের সঞ্চার
বুকের অন্দরে উড়ে উন্মাদনার পরাগরেণু
দু'চোখে ঘুমের স্বপ্নশালুক নয় প্রখর রোদ্দুর...
কেউ হারায়নি
অমলেন্দু কর্মকার
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় নদীর চরে যে মেলা বসে ছিল
আমার অর্ধভূক টিফিনের ক্ষুধার তাৎপর্য লেগে থাকা
কয়েকটা দশ-কুড়ি আর পঁচিশ পয়সা দিয়ে
একটা বাঁশি কিনে ছিলাম ।
সালটা চুরানব্বই হোক বা উনপঞ্চাশ; কার কি যায় আসে ?
ঘরমুখো সূর্যটা সেদিন পূর্ণিমার কথা ভেবে দাঁড়ায়নি,
বাঁশিওয়ালার চশমার ক্যানভাসে সেদিন ফুটে উঠেছিল
বিবর্তনের অতৃপ্ত ভবিষৎ ।
খুঁজে পাইনি তোমায়..... ।
সন্ধ্যা নেমে ছিল মরা নদীর আঁচলে
তারাদের ঘুমভাঙানিয়া সুর বাজিয়েছিল বাঁশিওয়ালা
...বলেছিল এ সুর বিরহের ।
তারপর ....
অনেক গুলো বছর স্কুলপালানো ছেলের মত
ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে কবে।
ফিরে গেছে ফ্যাকাশে বসন্ত গুলো চুপচাপ
শুধু নদীর ঠোঁটে কিছু পলাশের চিহ্ন লেগে আছে।
ফিরে এসেছে সবাই...
তুমি বাদে ;
অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় হেঁটে এসেছে
পরিযায়ীর বার্ষিক গতিও আজ সংক্রমিত।
তবুও হারায়নি পথ;
কেউ পথ হারায়নি,
বছরেরর সুতোটা ছিঁড়েছে মাত্র
সুরের গন্ধ টুকু গেছে হারিয়ে ।
রূপকথা চাই
ঝুম্পা বাগ
রূপকথা তো বটেই!
মানুষটা যে মানুষ হবেই
চক্ষু মেলে দেখবো আমি
সুস্থ রবি উঠবে তবেই।
পুষ্ফুটিত পাপড়ি মেলে
ফুলেরা উঠবে গেয়ে,
নতুন রবি সোনার বরণ
বাতাস আসবে ধেয়ে।
মনুষ্যত্ব বাঁচিয়ে রেখে
হবে সবাই এক,
কিচিরমিচির করে পাখিরা
উড়বে দিয়ে ডাক।
মানুষ কেবল বাসবে ভালো
প্রাণের প্রকৃতিমাতা,
চারিদিকে উড়বে শুধু
নতুন প্রেমের পাতা।
স্বপ্নের এই দেশ আমার
সে তো শুধু রূপকথাই,
গড়তে হলে স্বপ্ন তবে
রূপকথা চাই রূপকথা।
সত্যের সদা জয়
শুভ্রা ভট্টাচার্য
লোভ হিংসা স্বার্থের নেশায়
জীবনের ক্ষতি বৃহত্তর হয়,
তবুও ভেক আত্মতুষ্টিতে
মিছে শক্তিকে করি ক্ষয়।
শুভবুদ্ধি সততায় হলে বাস
অন্তর থাকে নির্মল নির্ভয়,
বিবেক চেতনা শুভ প্রেরনা
আনে সদা মানবতার জয়।
মিথ্যা আমিত্বের কাছে কভু
নাহি করো নত উন্নত শির,
সত্যের পথ কঠিন হলেও
জেনো নাহি সেথায় ভীড়।
তাই শত বাধা বিপত্তিতেও
রও সদা অবিচল ধীর স্থির,
মিথ্যাচারে কাপুরুষ ভয়ে মরে
আজীবন লড়ে যায় শুধু বীর।
মন আয়নায় নিজেরে দেখ
অন্তর মুক্ত পরিশুদ্ধ করো,
যেথা ন্যায়পরায়নতা সততার
প্রতিচ্ছবিই হোক সদা বড়ো।
উচ্চ শিরে দুষ্টের দমন করে
ন্যায় প্রতিষ্ঠার তরে সবে লড়ো,
সততার তরেই জীবন যুদ্ধ
সুচরিত্রে সুস্থ সমাজ গড়ো।
সত্যের পথ হোক না কঠিন
জীবনভোর দুর্যোগ দুর্দিন!
সহায়সম্বলহীন চলার পথে
তবু ঝড় থেমে আসে সুদিন।
ভীত মিথ্যুকের পরাজয়েই
বিশ্বাসভরা সত্যের সদা জয়,
আমিত্বে সততা উদারতা রহিলে
অন্তর আত্মা বিশুদ্ধ দেবতাময়।।
সেলফি
মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় রায়
এত কিছু বুঝতাম না হয়তো বোঝার কথাও ছিল না
সকাল সন্ধ্যে নিয়ম করে পড়তে বসা
সকলের এক পাত এক আস্বাদ
ভালোমন্দ বিচারের ছিল না কোনো বিচার ।
বিকেলের মাঠ ছুটে বেড়াতো পাড়ার বন্ধুদের পায়ে
সেখানে যা কিছু ঝগড়া যা কিছু মান অভিমান
পশ্চিমের সূর্য নিয়ে যেতো সাথে।
ছিল না সেলফি ।
শুধু স্মৃতিপাতে আঁকিবুকি।
এত জটিলতা এত মেপে চলা মানসিক চাপ
কিভাবে হবে কোনঠাসা সে তো বোঝা দায়।
মানুষ হওয়ার স্বপ্নে নামি দামি স্কুল পেশাগত যোগ্যতা ।
যা কিছু চিকচিক গণতন্ত্র সবই ধূলিসাৎ
যদি রাজনীতি অর্থনীতির গলায় না জমে ভাব।
আজ সুযোগ এসেছে দেখোনদারী ডামাডোল ,
নিয়ে নিয়ে দেয়ার সেলফি বিড়ম্বনা ।
কতটা তোমার কে নেবে হিসাব?
দেখতে ভালোই লাগে পাশের বাড়ির ছেলেটা
জীবন বাজি রেখে মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
অথচ ঘরে ফিরে তার পাতে পাতে কি ঝুটছে ?
বোকা ছেলে ! সেলফি তুলে পাবলিক কর।
এতো তোর একার নয় এতো দেশের লজ্জা দশের লজ্জা।
প্রচ্ছদ
সুমনা ভট্টাচার্য্য
দু এক টুকরো জীবন নিয়েই কেনা বেচা -
দু’এক টুকরো স্বপ্ন গুছিয়ে রাখে গেরস্থালীর একগোছা কোণ
তারপর বাদবাকি সব জুড়ে গেলো যে যার মতো;
রাঁধাবাড়া শেষ হতেই এক টুকরো মেঘ এসে ছুঁয়ে দ্যায় অভিমানী চিবুক
বুক জুড়ে টাপুর টুপুর কারাওকে মূর্ছনা…
অথচ বাইরে অথৈ আঁচ ঝলসে দিচ্ছে চোখ ;
দুধেতে আমেতে মিলেমিশে গেলে
সবার চোখে থই থই করে ওঠে নটেশাক মুড়োনোর গল্প।
তবুও দরজার কাছে বসে থাকে অতিথি বৎসল অপেক্ষা -
তোমার চোখ ফিরেও দেখল না নিজেকে -
আয়নায় বাসী হয় রাতজাগা ক্লান্ত প্রচ্ছদ।
লাটাইয়ের সুতোয় ওড়ে ছাপোষা অভ্যেস গুলো এদিক ওদিক -
তবুও কার্নিসে যে আটকে থাকে সে তোমারই ছিঁড়ে যাওয়া উড়ান -
অচানক ঝড় বৃষ্টিতে খরস্রোতা হয়ে ওঠে ঢালু অশান্তির মোড়গুলো…
একলা এ মন
অঞ্জন দাস মহাপাত্র
একলা মন উদাশ হাওয়ার মতো
খামখেয়ালে উড়ায় ঝরা পাতা
সংগোপনে লুকায় গভীর ক্ষত
আড়াল করে হাজার ব্যাকুলতা ||
একলা মন নিজের মতোই বাঁচে
খড় কুটোতে সাজায় সুখের ঘর
একই ছবি হাজার টুকরো কাঁচে
চুরমার করে কালবৈশাখী ঝড় ||
একলা মন ভাঙা স্বপ্নটাকে গড়ে
অতীত ভুলে বর্তমানেই থাকে
নতুন করে বাঁচার লড়াই লড়ে
শিক্ষা নিয়ে সময়ের বাঁকে বাঁকে ||
একলা এ মন জোনাকি হতে চায়
একটু খানি থাকবে আপন আলো
কোনো মেঘলা রাতে অমাবস্যায়
বাসবে সবাই একটু খানি ভালো ||
একলা এ মন একাই ভাবে সব
জন্ম একা, একাই মরন জানে
সব স্বপ্ন সত্যি হওয়া কি সম্ভব
বেঁচে থাকার ব্যর্থ অভিযানে ||
দুঃখের পাণ্ডুলিপি
তুষার ভট্টাচাৰ্য
রাত্রির নিজস্ব দর্পণে শুধু অনন্ত দুঃখের
পাণ্ডুলিপি ভেসে ওঠে ;
উদ্ভাসিত জোছনায় দু'ডানা মেলে তবু
উড়ে যায় রাত পাখিরা
নিখিল দিগন্ত পানে ;
রজনীগন্ধা স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঘরে
কেউ না কেউ
জ্বালিয়ে দিয়ে যায় ভালোবাসার
সাঁঝবাতি প্রদীপের আলো l
আর তখনই ভুলে যাই দুঃখের ধারাপাত l
জ্ঞানগান
শীতল চট্টোপাধ্যায়
ছকে বাঁধা মনটাতে ছিল বেশ দায়
প্রাইভেটে-স্কুলে স্যার দেওয়া পড়া চায় ৷
ছিল তাই ভয়ও লেখা-পড়া করে
ক্লাস সিঁড়ি টপকানো চাই পড়া জোরে ৷
স্কুলে একে অপরের বন্ধু ভীষণ
কিন্তু পড়াতে ঠিক প্রতিযোগী মন ৷
এই ধারা বদলিয়ে গেল সেই কবে !
স্কুল পথ সাথে ফের কবে দেখা হবে ?
পড়া আছে যদিও স্কুল বাড়ি কই ?
স্কুলকে মনেতে বলি কেউই পর নই ৷
না গিয়েও বুঝছি তোমাতেই মন বাঁধা
তোমাতেই হবে যে জ্ঞানগান ঠিক সাধা ৷
রবিবার
সুস্মিতা শীল
রবিবার মানে স্কুল ছুটি,
রবিবার মানে বাবা বাড়ি।
রবিবার মানে সকাল দশ টায় ঘুম থেকে উঠি
রবিবার মানে ফুলকো লুচি
রবিবার মানে ঠাকুরমা ঝুলি
রবিবার মানে আঁকার ক্লাস
রবিবার মানে গানের তালিম
রবিবার মানে মাংস ভাত
রবিবার মানে দুপুরবেলা ভাতঘুম
রবিবার মানে সান ডে
সান ডে মানে সানডে সাসপেন্স
রবিবার মানে সারা সপ্তাহের লড়ায়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার দিন।
গল্প ১
অ-বলা কথা
নন্দা রায় পোড়েল
তখন কলেজে পড়ি।এক পয়লা বৈশাখের সকাল।বাকসাড়া বাজারের রেললাইন টপকে রিকশা নিলাম।যাব জিগাছায় এক বন্ধুর বাড়ি।উপলক্ষ্য বন্ধুর ভাইঝির জন্মদিন।বন্ধুর বাড়ির পাশেই আছে একটা ছোট্ট মাঠ।সেখানে পৌঁছে রিকশা থেকে নামতেই শুনতে পেলাম গরুর ডাক।সে ডাক উপেক্ষা করেই ঢুকে গেলাম বন্ধুর বাড়ি।
সারাদিন খুব হৈ হৈ করে কেটে গেল।মাঝে মধ্যে গরুর ডাকও কানে আসছিল।কিন্তু সারাদিন এত হৈ চৈ আর আনন্দে ছিলাম যে গরুর ডাক কানে আসলেও ভ্রুক্ষেপ করিনি।দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বেলা একটু গড়াতে সবাই মিলে ছাদে উঠলাম।পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে দেখি দিক চক্রবাল লাল করে রক্তিম দিনমনি ধীরে ধীরে কোন অজানা তিমিরে লীন হতে চলেছে।আর পূব আকাশটা সোনালী আভায় ভরে গেছে।একেই কি বলে গোধূলির স্বর্ণরাগ?জানি না! তবে আমার উদাসী বাউল মন কি যেন খুঁজে চলেছে দিক থেকে দিগন্তে!কী অপরূপ দৃশ্য! মুগ্ধ চোখে প্রকৃতির রূপ- রস আস্বাদন করছিলাম।সম্বিত ফিরল ত্রাহি স্বরে গরুর হাম্বা -হাম্বা রবে।মাঠের দিকে চোখ পড়তে দেখি সকালের সেই গরুটা আমাদের দিকে তাকিয়ে একই ভাবে হাম্বা হাম্বা করে ডেকে চলেছে। মনে খটকা লাগল সকাল থেকে এক ভাবে ডেকে চলেছে কেন?গরুটার কাছে যাব শুনে বন্ধু বলল---খবরদার যাস না।দেখছিস না এ দেশী গরু নয়?জার্সি গরু।শিং দুটো দেখেছিস?তাছাড়া গরুটা সাংঘাতিক!এ পাড়ার সবাই জানে গরুটা ভীষণ গুঁতোয়।তাই ওর ধারে কাছে কেউ যায় না।এমনকী ওর মালিকও ওকে সমঝে চলে।
কিন্তু গরুটার লম্ফঝম্ফ দেখে আমার খুব মায়া লাগল।সারাদিন একভাবে একই জায়গায় খুঁটিতে বাঁধা আছে।হয়তো ওর খুব কষ্ট হচ্ছে।বেচারি অবলা প্রাণী!বন্ধুর মুখে শুনলাম গরুটাকে সকলে এত ভয় পায় যে ওর কাছে কেউ ঘেঁষে না।ওর মালিক সকালে মাঠে বের করে দিয়ে যায় আর সন্ধ্যেবেলায় অফিস থেকে ফিরে গোয়ালে ঢোকায়।সারাদিন ঠাঁ-ঠাঁ রোদে বেচারি দাঁড়িয়ে থাকে।অবলা জীবটার ওপর আমার ভীষণ মায়া লাগল।সকলের কথা অগ্রাহ্য করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম গরুটার দিকে।আমাকে দেখেই অত বড় জার্সি গরুটা এমন লম্ফ -ঝম্ফ শুরু করে দিল যা দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গ্সেলাম।হাম্বা হাম্বা করে এমন লাফাচ্ছে যেন মনে হচ্ছে খুঁটি শুদ্ধু উপড়ে ফেলে ওই বড় বড় শিং দুটো আমার পেটে ঢুকিয়ে দেবে।কী তেজী গরুরে বাবা!ভয়ে আমি আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসছি।তা দেখে গরুটা আরো লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।গরুটার মতলব বোঝার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।অদ্ভূত ব্যাপার!আমাকে দাঁড়াতে দেখে গরুটা কেমন শান্ত হয়ে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি সাহস করে ওর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম।গরুটা ওর মাথাটাকে এমন ভাবে ওপর নীচে করে নাড়াচ্ছে যেন মনে হচ্ছে ও বলছে আয় আমার কাছে।এক প্রতিবেশী সাবধান করে দিলেন---ওই গরুটার কাছে যেওনা।বড্ড গুঁতোয়।আমি জীব-জন্তু ভীষণ ভালবাসি।তাই প্রতিবেশীর কথা উপেক্ষা করে দুরু দুরু বুকে দূর থেকে আলগোছে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।উপস্থিত সকলে হই হই রই রই করে উঠল।তেজী গরুটা নিমেষে শান্ত হয়ে গেল।সাহস করে আর একটু কাছে গিয়ে ওর গলায় হাত বোলাতে লাগলাম।আমাকে অবাক করে দিয়ে ও আমার বাঁ- চোখের নীচেটা গরম জিভ দিয়ে চাটছে আর ওর দুচোখ বেয়ে জল ঝরে পড়ছে।আমি চমকে উঠলাম।আনন্দে-দুঃখে-আবেগে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম।মুংলি মুংলি তুই এখানে!তুইএত বড় হয়ে গেছিস মুংলি!মাঠে উপস্থিত লোকজন স্তম্ভিত হয়ে দেখল চার -চক্ষুর ফল্গুধারা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
এর ঠিক চার বছর আগের ঘটনা।আমার বাবা তিনটে জার্সি গরু কিনেছিলেন অবসর নেবার পর দুধের কারবার করবেন বলে।অবসর নিতে তখন মোটে আর মাত্র তিন বছর বাকী।যাইহোক সেই গরুগুলোর পরিচর্যা আমরা সবাই মিলে যে যখন সময় পেতাম করতাম।গরুগুলো বেশ বড়সড় ছিল।শিংগুলোও শরীর অনুযায়ী তেমনি বড়সড় আরডগার কাছটা তীক্ষ্ণ।সত্যি কথা বলতে কি প্রথম প্রথম ওদের কাছে যেতে বেশ ভয় পেতাম।তিনটে গরুই ছিল কালো কুচকুচে।তার ই মধ্যে একটার গায়ে ছিল একটু লালচে আভা।ওটাকে বলতাম লালী,আর দুটোর নাম দিয়েছিলাম বুধি আর কালি। মুংলি ছিল ওই কালির বাচ্চা।
ছোট্ট মুংলি উঠোনময় দাপিয়ে বেড়াত।শীতের রোদে আমরা যখন উঠোনে আমরা রোদ পোহাতাম মুংলি মানুষের বাচ্চার মত একেবারে আমাদের গা ঘেঁষে শুয়ে থাকত।একদিন জল দিয়ে ওকে স্নান করাচ্ছিলাম,আচমকা ওর একটা শিং আমার ডান চোখের নীচে লেগে রক্ত ঝরতে লাগল।ছোট্ট মুংলির মধ্যে সেদিন দেখেছিলাম অপরাধবোধ।অবলা জীবটা সেদিন আমার ক্ষতস্থানটা গরম জিভ দিয়ে চেটে দিচ্ছিল।আমি ধমকে উঠলাম---কী করলি কি?একেবারে রক্ত বের করে ছাড়লি?তার ওপর জিভ দিয়ে চাটছিস। আমার জ্বালা করছে না?মুংলি ডাগর দুটো চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।অবলা প্রাণীটা যেন বলতে চাইল---আমার অন্যায় হয়ে গেছে।সেদিন সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করেনি।এক জায়গায় শান্ত হয়ে গুটি সুটি মেরে শুয়ে থাকল।দেখে মায়া লাগল।ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললাম---না রে মুংলি তুই কোন দোষ করিসনি।ও আমার সারা মুখ চেটে দিয়ে দে ছুট।তারপর উঠোনময় ছোটাছুটি শুরু করে দিল।
একবার আমার বাবার মাইনর হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল।বাড়িতে লোকজনের ভীড় জমে গেছে।মুংলি কী বুঝল কে জানে!চুপ করে এক জায়গায় শুয়ে সবাইকে লক্ষ্য করতে লাগল।যখন বাবাকে ধরে এ্যাম্বুলেন্সের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন ও হাম্বা হাম্বা করে সারা বাড়ি মাত করে দিচ্ছিল।একবার এর কাছে একবার ওর কাছে দৌড়চ্ছে আর একবার বাবার কাছে দৌড়চ্ছে।কিছুতেই বাবাকে এ্যাম্বুলেন্সে উঠতে দেবেনা।বাবা যে কদিন হাসপাতালে ছিল সে ক'দিন বাবার ঘরে ঢুকে বাবাকে খুঁজছে।ভালো করে খেত ও না।খেতে খেতে বার বার রাস্তার দিকে দৌড়চ্ছিল।আর যেদিন বাবা হাসপাতাল থেকে ফিরল সেদিন ওর তাণ্ডব দেখে কে!একবার বাবার কাছে যাচ্ছে আর একবার উঠোনময় তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে!
এরকম কত মধুর স্মৃতি যে মুংলিকে নিয়ে আমাদের আছে!
দুর্ভাগ্যক্রমে একে একে আমরা সব গরুগুলোকেই বেচে দিতে বাধ্য হলাম।মুংলির যখন এক বছর বয়স তখন মুংলির মাকেও বাধ্য হলাম বিক্রি করে দিতে।সেদিন মুংলি সারাদিন মুখে কিছু তোলেনি।সর্বক্ষণ শুধু অস্থিরভাবে মাকে খুঁজেছে আর চিৎকার করেছে।এমনকী রাতে আমাদের কাউকে ঘুমোতে দেয়নি।বছরখানেক বাদে মুংলিকেও আমরা বেচে দিতে বাধ্য হলাম।প্রত্যেকবারই গরুগুলোকে আমরা বেচেছি আর ভয়ানক কষ্ট পেয়েছি।কিন্তু মুংলিকে যখন নিতে এসেছে তখন আমরা প্রিয়জন হারানোর শোকে বেদনায় হাউ হাউ করে কাঁদছি।আর মুংলি?ও তখন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর বোবা চাউনিতে জল টস টস করে ঝরে পড়ছে।ওর নতুন মালিক ওকে মারতে মারতে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে।ও কিছুতেই আমাদের ছেড়ে যাবে না।চার পায়ে শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।নতুন মালিক গলার দড়ি ধরে যখন টানছে তখন ও এক পা এগোচ্ছে আর দু পা পিছোচ্ছে।যখন দড়িতে জোরে টান পড়ছে ও পিছন ফিরে তাকাচ্ছে আর তারস্বরে হাম্বা হাম্বা করে চিৎকার করছে।যেন বলতে চাইছে---কষাইগুলো আমাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে আর তোমরা মুখ বুজে তা দেখছ?তোমরা কি বুঝতে পারছো না আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাইছি না?আমি যে তোমাদের বড্ড ভালোবাসি।
সেই মুংলি আজ বাছুর থেকে যুবতী গাভী।মা হতে চলেছে। ওকে অনেকক্ষণ ধরে আদর করলাম।মুংলিও জিভ দিয়ে চেটে চেটে আমাকে কত যে আদর করল!আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল।কাঁদতে কাঁদতে বললাম---কি করব বল মুংলি,তোকে ছেড়ে দিতে যে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম রে সোনা।ক্ষমা করিস।আমরা মানুষরা বড় বিশ্বাসঘাতক বেইমান!আমরা ভালবাসার মর্যাদা দিতে জানিনা রে।আমাদের মুখে ভাষা আছে কিন্তু হৃদয়ে তোদের প্রতি বোধ নেই।আর তোরা বোবা অবলা?অথচ তোদের হৃদয় এত বড়!
ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চলেছি।শাড়ির আঁচলে টান পড়তেই ফিরে দেখি মুংলি মুখে করে আমার আঁচল ধরে টানছে।তখনও ওর চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ছে।ছুটে গিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললাম---এমন করিসনা মুংলি।আমি কতদূর যাব বলতো?সন্ধ্যে হয়ে আসছে না?বলেই আঁচলটা সামনে টেনে ফিরে চলেছি।দিক-দিগন্ত কাঁপিয়ে ও হাম্বা হাম্বা করে ডেকে চলেছে।পিছন ফিরে দেখি ও এমন লম্ফঝম্ফ করছে মনে হচ্ছে খুঁটিটাই উপড়ে ফেলবে।আবার দৌড়লাম ওর কাছে।জড়িয়ে ধরে বললাম---এমন মায়ার বাঁধনে আর টানিস নারে মুংলি!আমি তোরই মত অসহায়।আমার সাধ্য নেই তোকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাবার।লক্ষ্মী সোনা তুই আমাকে আর পিছু ডাকিস না।কথা দিলাম মাঝে-মধ্যে আমি তোর কাছে আসব ।তারপর মন শক্ত করে ফিরে চললাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিওর হাম্বা হাম্বা ডাক আর লম্ফঝম্ফ!যেন ত্রিভুবনেশ্বরের কাছে ও কৈফিয়ত চাইছে---কেন ,কেন দিলে এ পরাধীন জীবন?প্রাণই যদি দিলে তবেএমন শিকল বাঁধা প্রাণ কেন?
পরের দিন ট্রেনে করে কলেজ যাবার পথে দেখলাম একটা গরু লাইনে কাটা পড়েছে।কলেজে গিয়ে সেই বন্ধুর মুখে শুনলাম আমি চলে আসার পর মুংলি খুঁটি উপড়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসছিল। লাইন পার হতে গিয়ে অবলা মুংলি..........
গল্প ২
ভুতুড়ে বাড়ি
সুদীপ সরকার
শৈশবে মাতৃহারা সৈকত ছোটোবেলা থেকেই একটু ডাকাবুকো ধরণের। সৈকতের যখন তিন বছর বয়স তখন নিখিল বিশ্বাস বিপত্নীক হন। এরপর থেকে একমাত্র সন্তানের, মায়ের অভাব পূরণ করার চেষ্টায় পিতা নিখিল বিশ্বাসের কোনো কার্পণ্য ছিল না। অনেক নিকট আত্মীয়ের শত অনুরোধ সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। তিনি একজন ব্যাঙ্ক কর্মচারী হয়েও সৈকতের যত্নআত্তির কোনো ত্রুটি রাখেননি। তবুও সৈকতের মা হয়ে উঠতে পারেননি কারণ মায়ের যে কোনো বিকল্প হয় না। সৈকত যখন দেখত, ইস্কুলে তার প্রায় সব বন্ধুর মায়েরা আসে তাদের টিফিন খাওয়াতে তখন সৈকতের খুব কষ্ট হত। সৈকত একা একা গাছতলায় বসে টিফিন খেত। সব বন্ধুরা যখন মায়ের হাত ধরে ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরত তখন সৈকতকে বাড়ি ফিরতে হত বাবার ঠিক করে দেওয়া অটোকাকুর অটোতে চেপে। বাড়িতে ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে সৈকত খুব কাঁদত। তার মায়ের ওপর ভারী অভিমান হত। যদিও বাচ্চা সৈকত তার এসব দুঃখের কথা বাবাকে কিছুতেই বুঝতে দিত না। মাতৃহারা ছেলেরা বোধহয় একটু অল্প বয়সেই বেশী পরিণত হয়ে যায়। এইসময় সে প্রায়ই রাত্রে একটা স্বপ্ন দেখত। একজন মা তার মাথার কাছে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পারাচ্ছে। স্বপ্নে দেখা সেই মায়ের মূর্ত্তিটা তখন থেকেই তার মননে গ্রোথিত হয়ে গেলো। সৈকত যেনো উপলব্ধি করলো, মায়েরা এমনই হয়। নিজের না দেখা মায়ের অবয়বটা, স্বপ্নে দেখা মায়ের মধ্যে খুঁজে পেয়ে সে বড় আনন্দ পেত। এর বেশ কিছুদিন পর, সৈকত তখন কৈশোরে উপনীত, বন্ধু তাপসের বাড়ি গিয়ে একটা তৈলচিত্র লক্ষ্য করল। তার স্বপ্নে দেখা মায়ের মুখের সাথে ঐ তৈলচিত্রে অঙ্কিত নারীর মুখের হুবহু মিল প্রত্যক্ষ করে সে জানতে পারলো, এটা মা সারদা দেবীর ফটো। রামকৃষ্ণানুরাগী তাপসের সাহচর্যে স্থানীয় মঠে কিছুদিন যাতায়াত করে সারদা মায়ের ওপর লেখা অনেক বইয়ের পঠন সে সম্পূর্ণ করল। যদিও প্রকৃতিগতভাবে সৈকত কিছুটা নাস্তিক ধরণের তবুও মঠের সামাজিক কাজকর্ম তার বেশ ভালো লাগতে শুরু করে। মঠের এক শান্ত, স্থিতধী মহারাজের নিস্বার্থভাবে এই সকল কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার ঘটনাও, সৈকতের মনে গভীর রেখাপাত করে। শ্রদ্ধায় ভক্তিতে সৈকত ঐ মহারাজের বেশ কিছুটা ফ্যান হয়ে যায়। এরপর থেকে সৈকতের জীবনে আরোও একটা বদল আসে। কোনো আধ্যাত্মিক টান থেকে নয় বরং মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে, সে সারদা মায়ের একটা ফটো নিজের কাছে রাখা শুরু করে।
সৈকত এখন একজন যুবক। যাদবপুর থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা সম্পূর্ণ করে সে এখন একটা বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার চাকুরে। নিখিল বাবুর অবসর জীবনে বিভিন্ন রোগ নিত্যসঙ্গী হয়েছে। বিপত্নীক নিখিলবাবু ছেলেকে ভালোভাবে মানুষ করার তাড়নায়, নিজের শরীরের যত্ন সেভাবে নিয়ে উঠতে পারেননি। এখন বাড়িতে বৌমা এনে সৈকতকে জীবনে থিতু করে দিয়ে যেতে পারলেই যেনো তিনি নিশ্চিন্ত হন। সৈকত এব্যাপারে একদমই উদাসীন। বাবার এই সংক্রান্ত কোনো কথাকে সে আমলই দেয় না। মাঝে মধ্যেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে পাহাড়ে ট্রেকিং করতে যাওয়া তার এখন অন্যতম একটা নেশা হয়েছে। নিখিলবাবুদের আদি বাড়ি বর্ধমান জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। যদিও বর্তমানে তারা কোলকাতার বেহালাতে থাকেন। নিখিল বাবুর পিতা স্বর্গীয় মনোময় বিশ্বাস এই বাড়ি তৈরী করেন।নিখিল বাবু সেই পাঁচ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে বেহালাতে চলে আসেন। তারপর আর কখনও সেখানে যাননি। স্বর্গীয় মনোময় বিশ্বাসও জীবদ্দশায় কখনও চাননি, তার একমাত্র সন্তান নিখিল কখনও সেথায় যাক। সৈকত অনেকবার বাবার কাছে বায়না করেছে তাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রতিবারই নিখিলবাবু সযত্নে পাশ কাটিয়ে গেছেন। সৈকত বেশী চাপাচাপি করলে বলেছে, ও এখন ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে গেছে রে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। দেশের বাড়ির কথা তুই ভুলে যা বরং এই বাড়িটাকেই দেশের বাড়ি বলে ভাবা প্র্যাক্টিস কর।
সৈকত বাবাকেও বেশীদিন ধরে রাখতে পারলো না। শৈশবে মাতৃহারা সৈকত যৌবনে পিতৃহারা হল। এই পার্থিব জগতে তার নিজের বলতে কেউ রইলো না। এরপর তার বাউন্ডুলেপনা যে আরোও খানিক বাড়বে তা সহজেই অনুমেয়। রোমাঞ্চপ্রিয় সৈকতের ইচ্ছে হল, তাদের দেশের ভুতুড়ে বাড়িটায় অন্তত একবারের জন্যে হলেও যাওয়ার। সেখানে যাওয়ার জন্য বাবার থেকে পাওয়া গুটিকতক তথ্যই শুধুমাত্র সম্বল। গ্রামের নাম নৈচনপুর, সেখানে মাঠের মধ্যে দোতলা বাড়ি। বাবার মুখে সে শুনেছে, বাড়িটায় এখন কেউ থাকে না। শুধুমাত্র সৈকতের দাদু মনোময় বিশ্বাসের এক তুতোভাই যাকে সৈকতের বাবা খগেন কাকু সম্মোধন করত, সে বাড়িটায় থাকে দেখভালের জন্য। এই খগেন দাদুকে সৈকত তাদের বেহালার বাড়িতে দু একবার যেতে দেখেছে। বাবার সাথে কোনো দরকারে দেখা করতে এসেছিল। ছোটোবেলায় দেখা খগেন দাদুর মুখটা সৈকতের আবছা মনে আছে। বাবার মুখে সে আরোও শুনেছিল, গ্রামটা পঞ্চাশ বছর আগেও যা ছিল এখনও তাই রয়ে গেছে। বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। এছাড়াও বাবার থেকে ঐ বাড়ি সম্পর্কে আরোও একটা বিশেষ তথ্য সৈকত পেয়েছিল, নৈচনপুর গ্রামে গিয়ে 'বিশ্বাস ভিলা' বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।
অকুতোভয় সৈকত হাতে থাকা গুটিকতক তথ্যের ওপর ভর করে রহস্যে মোড়া অজানার সন্ধানে পাড়ি দিল। এসপ্ল্যানেড থেকে বাসে চেপে প্রথমে বর্ধমান স্টেশন তারপর বর্ধমান থেকে গাড়ি ভাড়া করে নৈচনপুর গ্রাম। সৈকত যখন গ্রামে পা রাখল, সূর্য্য তখন পশ্চিমে অবস্থান করছে। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে সৈকত হেঁটে চলেছে। শহুরে সৈকত গ্রামের সোঁদা মাটির গন্ধ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। পথিমধ্যে বিশ্বাস ভিলার কথা যাদেরই শুধোচ্ছে, সবাই যেনো রহস্যের দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকছে। যদিও সকলে সঠিক পথের দিশাই দেখাচ্ছে। সর্বশেষ, এক বয়স্ক দাদুকে জিজ্ঞাসা করলে তিনিও বিষ্ময়াবিষ্ট নয়নে তার দিকে চেয়ে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়লো, তুমি কে? বিশ্বাস ভিলায় তোমার কি কাজ? আমি মনোময় বিশ্বাসের পৌত্র, নিখিল বিশ্বাসের ছেলে। বয়স্ক দাদু কিঞ্চিৎ আনমনা হয়ে বলল, তুমি ওখানে কেনো যাচ্ছ? থাকতে যাচ্ছি। মানে!! ঐ ভুতুড়ে বাড়িতে তুমি থাকবে কি করে!! সৈকত, দাদুর কথায় বিশেষ আমল না দিয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে চলল।
অবশেষে প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ সৈকত এসে দাঁড়াল বিশ্বাস ভিলার সন্মুখে। কে একজন যেনো হ্যারিকেন নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। একদম সামনা সামনি আসতে হ্যারিকেনের আলোয় বোঝা গেল, একজন বৃদ্ধ লোক।
- তুমি বাবা শেষমেষ এলে
- আপনি কি খগেন দাদু
-ঠিক চিনেছো, তা পথে আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো।
- না, একদমই না, বিশ্বাস ভিলা বলতে সবাই দেখিয়ে দিল।
- সে তো দেখিয়ে দেবেই বাবা। একসময় তোমাদের বংশের এখানে কত রমরমা ছিল।
- আপনি জানলেন কি করে, যে আমি আজ এখানে আসব? আপনি আমাকে চিনলেনই বা কি করে? আমি তো এখনও আমার পরিচয় দিইনি।
- আমি জানতাম নিখিলের ব্যাটা একদিন ঠিক এখানে আসবে। নিখিল সেই যে বাচ্চাবেলায় গেল আর তো কোনোদিন এলো না।
- আপনাকে ছোটোবেলায় দু একবার আমি দেখেছি, বেহালার বাড়িতে। বাবার সাথে দেখা করতে যেতেন।
- হ্যাঁ, তখনই তোমাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, এ ডাকাবুকো ছেলে নিজের শেকড়ের সন্ধানে এখানে অন্তত একবার আসবেই। বিয়েথা তো এখনও করোনি, তার মানে তুমিই বিশ্বাস বংশের শেষ পুরুষ।
- হ্যাঁ তা বলতে পারেন। সৈকতের একটু যেনো খটকা লাগছে, খগেন দাদুর তো এত কথা জানার কথা নয় কিন্তু সে বিষয়টাকে খুব একটা পাত্তা দিল না।
- তোমার জন্য দোতলার কোণের ঘর রেডি করা আছে। চলো, তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি।
সারা বাড়ি অন্ধকার দেখে সৈকত বলল, এখানে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি কিন্তু গ্রামের কিছু বাড়িতে লাইট জ্বলছে যেনো দেখলাম।
- বিশ্বাস ভিলা মাঠের একদম মাঝখানে, এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার তাগিদও কেউ কোনোদিন দেখায়নি। তোমার দাদু এখান থেকে চলে যাওয়ার পর আমিই সবেধন নীলমণি হয়ে এই বাড়ি পাহারা দিয়ে চলেছি। অন্ধকারে সিঁড়ি ভেঙ্গে দাদু-নাতি কোনোরকমে দোতলায় পৌঁছালো।
সৈকতকে খগেন দাদু তার জন্য নির্দিষ্ট ঘর দেখিয়ে দিল। ঘরে শুধুমাত্র একটা চৌকি পাতা আছে আর একটা লম্ফ জ্বলছে। ঘরটার পাশে একটা বারান্দা আছে, সেখান থেকে অমাবস্যার নিকষ সন্ধ্যায় শুধুমাত্র অন্ধকারই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। চারিদিকে কোনো বাড়ি নেই, শুধু ধু ধু করছে মাঠ তা পরিষ্কার দেখতে না পাওয়া গেলেও, বেশ বোঝাই যাচ্ছে।খগেন দাদু জিগ্যেস করলো, রাতে কি খাবে বাবু? সৈকত বলল, দাদু আজ আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আজ রাতের মত খাবার আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কাল সকালে বরং আপনাকে বলবো। খগেন দাদু বলল, আমি নীচের তলাতেই থাকি, তুমি আমায় অসুবিধে হলে ডেকো। সৈকত ব্যাগ থেকে টর্চ লাইটটা বার করল। দোতলাতেই একটা টয়লেট আছে, সেখানে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকলো। অনেকক্ষণ খাওয়া হয়নি। ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার ছিল, সেগুলো খেল। রিল্যাক্স মুডে একটু বারান্দায় দাঁড়ালো। বারান্দা থেকে বাইরের দিকে তাকালে কেমন যেনো গা ছমছম করে। সৈকতের মত ডাকাবুকো ছেলেরও গায়ে শিহরণ জাগছে। নীচেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাক পক্ষীরও দেখা নেই। খগেন দাদু বোধহয় খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে। সৈকতও ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। সৈকত ভাবছে, কাল সকালে উঠে খগেন দাদুর মুখে এই বিশ্বাস ভিলার গল্প শুনতে হবে। সে তো নিছক এখানে ঘুরতে আসেনি বরং এখানকার অনেক রহস্য উন্মোচন করতে এসেছে। বাবা সারাজীবনে কেনো তাকে একবারও এখানে নিয়ে আসেনি, বারবার শুধু ভুতুড়ে বাড়ি বলে এড়িয়ে গেছে। সেইসব রহস্যের অনুসন্ধান তাকে করতেই হবে। সৈকত বিছানায় শুয়ে এসব ভাবছে। এমন সময় দরজায় খটখট করে আওয়াজ হল। কেউ যেনো বাইরে থেকে ডাকছে। সৈকত দরজা খুলে দেখল, কেউ কোথাও নেই। সে ভাবল, হয়ত তার মনের ভুল। দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর আবারও খটখট করে আওয়াজ হল। সৈকত দরজা খুলল না। পরের বার একটু জোরেই শব্দ হল। সৈকত গলা ঝাঁকিয়ে বলল কে? উত্তর এল, আমি খগেন দাদু, তোমার জন্য জল এনেছি। দাদু, আপনি কি একটু আগে এসেছিলেন? কৈ না তো। ওটা তাহলে সৈকতের মনের ভুলই ছিল। রাত বাড়ছে। বারান্দার সামনের জানলাটা খোলাই আছে। যদি একটু প্রকৃতির হাওয়া আসে এই আশায়। সৈকত দেখল, জানলার পাশ দিয়ে কে যেনো একটা চলে গেল। প্রথমবার সে কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। তার মনের ভুলও হতে পারে। জানলার দিকে চোখ স্থির করে রাখল। এবার সে স্পষ্ট একটা কালো মাথা দেখতে পেল, বারান্দার এদিক থেকে ওদিকে গেল। দরজাটা খুলে কি একবার দেখবে। আচ্ছা আরোও একবার দেখতে পেলে সে বাইরে বেরিয়ে দেখবে। কিছুক্ষণ বাদে ঐ কালো মাথাটা আবারও দেখতে পেল। বারান্দার এপাশ থেকে ওপাশ গেলো এবং জানলার দিকে চেয়ে দেখলো। সৈকত এবার টর্চটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরল কিন্তু কাউকে কোথাও দেখতে পেল না। টর্চ জ্বালিয়ে এদিক ওদিক দেখল কিন্তু কেউ কোথাও নেই। বাবা যে ভুতুড়ে বাড়ি বলত বোধহয় এই কারণেই। কিছুক্ষণ পরে আবার সেই কালো মাথা, বারান্দা দিয়ে এপাশ ওপাশ করছে আর জানলার দিকে তাকাচ্ছে। মুখটা অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার কিন্তু একটা কালো মাথার আনাগোনা পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছে। সৈকতের গা টা ছমছম করছে। সৈকত একদম জানলার কাছটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, বিশেষ কিছু দেখতে পেল না। এবারে চৌকিতে গিয়ে বসল। এইবার যেন পরপর দুটো কালো মাথা এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল। এটা কি ভুতের আনাগোনা নাকি কোনো মানুষ ভয় দেখাচ্ছে। সৈকত তো জেনেশুনেই বিপদের মধ্যে এসেছে। সে তো জানতই, তাকে অনেক বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হতে পারে। হাতে বড় টর্চ আর সঙ্গে করে নিয়ে আসা একটা ছোটো লাঠি সম্বল করে আবারও সে দরজা খুলে বাইরে গেল। যথারীতি দেখল কেউ কোথাও নেই। সে ঘরের ভেতর ঢুকতে যাচ্ছে এমন সময় তার মনে হল তার গলাটা কেউ যেনো সজোরে চেপে ধরে আছে। তার দমবন্ধ হয়ে আসছে অথচ চারপাশে কোনো মানুষ নেই। সৈকত হাঁসফাঁস করতে করতে কোনোক্রমে 'মা গো বাঁচাও' বলে চেঁচিয়ে উঠল। কয়েক মুহুর্ত্তের মধ্যে গলাটা আলগা হয়ে গেল। কোনোরকমে সে ঘরের ভেতর ঢুকে হাঁপাতে লাগলো। ব্যাগ থেকে মায়ের ফটোটা বার করে বুকে আঁকড়ে ধরলো। এমন সময় দরজায় আবার খটখট শব্দ। সৈকত এবার সত্যিই ভয় পেয়েছে। কোনো সাড়া দিল না। জীবনে এই প্রথম মৃত্যু ভয় সে যেনো উপলব্ধি করলো। আবারও খটখট শব্দ। দরজার ওপার থেকে খগেন দাদুর গলা। গলার আওয়াজটা যেনো একটু বেশীই রূঢ়। সৈকত যেনো একটু বল পেল আবার গলার আওয়াজটাও অদ্ভুত শোনালো। ভয় মিশ্রিত ভরসায় বলীয়ান হয়ে সে দরজাটা খুলল। খগেন দাদুর এ কি ভয়ানক রূপ। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল হয়ে জ্বলজ্বল করছে। সন্ধেবেলায় দেখা মুখের সাথে এই মুখের যেনো কোনো মিলই নেই। অন্ধকারে সারা শরীর দেখাও যাচ্ছে না, শুধুমাত্র মুখটা, আরোও ভালোভাবে বললে শুধুমাত্র জ্বলজ্বলে চোখটাই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
- বাবুসোনা, তুমি কি ভয় পেয়েছ?
- কই না তো
- তুমি অতো জোরে চেঁচালে, তাই তো ছুটে এলাম।
- না ঠিক আছে।
- তুমি চাইলে নীচে আমার সাথে শুতে পারো।
- সৈকত একটু ভেবে বলল, না, আমি এখানেই ঠিক আছি। কাল সকালে দেখা হবে।
এই বলে সৈকত সপাটে দরজাটা বন্ধ করে দিল। জানলাটাও আস্তে আস্তে গিয়ে বন্ধ করে দিল। চৌকিতে গিয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়ল। বাচ্চা ছেলের মত মায়ের ছবিটা বুকে আঁকড়ে ধরল। খগেন দাদুর এই পরিবর্ত্তিত মুখমন্ডলটা কিছুতেই সে মেলাতে পারছে না। দাদু কি গাঁজা টাঁজা খায়। বন্ধুদের সাথে ঐসব একটু আধটু খাওয়ার অভ্যেস সৈকতেরও আছে কিন্তু তাই বলে মুখের চেহারা এতো বীভৎস হওয়ার তো কথা নয়। বন্ধ ঘরের মধ্যে থেকে সৈকত বুঝতে পারছে বাইরে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। এত ঝড় যেনো বাড়িটাকেই শেকড় শুদ্ধু উবড়ে ফেলবে। জানলা খুলে প্রকৃতির রোষানল দেখার মত মনের জোর সৈকতের আর নেই। খগেন দাদুর ভয়ানক চোখ দুটো সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। সৈকত চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো। চোখ খুলে সৈকত দেখল, জানলা দিয়ে আলো ঢুকছে। ভয়ের মধ্যে মায়ের ছবিটা বুকে আঁকড়ে ধরে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও বুঝতে পারেনি। সৈকত ভাবল, আজ এখানে থাকলেও ওপরের ঘরে কোনোভাবেই শোয়া যাবে না। খগেন দাদুকে বলে নীচের একটা ঘরই ম্যানেজ করতে হবে। এইসব সাত পাঁচ ভেবে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগটা নিয়ে সে নীচে নেমে এলো। নীচে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও খগেন দাদুকে দেখতে পেল না। ভাবল, হয়ত কোনো কাজে বাড়ির বাইরে গেছে। সৈকত ভাবল, যাই আমিও একটু গ্রামটা ঘুরে আসি। ব্যাগটা নীচে না রেখে সঙ্গে করে নিয়েই সে বেরিয়ে পরলো। রাস্তায় সেই বয়স্ক দাদুর সাথে সৈকতের দেখা হল, যিনি গতকাল সন্ধেবেলায় তাকে বিশ্বাস ভিলার রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। গতকাল সন্ধেতে বিশ্বাস ভিলায় ঢোকার আগে এই দাদুর সাথেই তার শেষ দেখা হয়েছিল।
- কি শহুরে বাবু, কাল কোথায় ছিলে?
- কেনো বিশ্বাস ভিলায়
- মানে! ঐ ভুতুড়ে বাড়িতে তুমি একা একা থাকলে।
- একা একা কেনো থাকতে যাবো, খগেন দাদুও ছিল।
- খগেন দাদু বলতে খগেন বিশ্বাস! কি যে বল নাতি, খগেন বিশ্বাস তো ছয় মাস আগে মারা গেছে, ওকে তুমি কোথায় পাবে। তোমাদের শহুরে বাবুদের মস্করা কিছুই বুঝি না। এই বলে সে হাঁটা দিল।
সৈকতের বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেছে। সে বাকশক্তি রহিত হয়ে গেছে। শরীরের ভেতরটা ঝিমঝিম করছে। জীবনে প্রথমবার ভুতকে প্রত্যক্ষ করে ডাকাবুকো সৈকতের তখন নাজেহাল অবস্থা।
কোলকাতা ফিরে সৈকত বাড়িতে না গিয়ে সোজা মঠে গিয়ে সেই মহারাজের সাথে দেখা করল। মহারাজকে ঘটনার পুঙ্খনুপুঙ্খ বৃত্তান্ত শোনালো। মহারাজ সৈকতের মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকল। এই ধরণের মহারাজরা সিদ্ধ পুরুষ হয়। তারা যোগপূর্বক অনেক কিছু দেখতে পায়। মহারাজের মুখে সৈকত যা শুনল তাতে সে চরম বিষ্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ল। বাস্তবে এও কি সম্ভব!! বিশ্বাস ভিলায় কোনো এক অশরীরী আত্মা দীর্ঘদিন ধরেই বসবাস করছে। সৈকতের পূর্বপুরুষরা হয়ত সেই কারণেই নৈচনপুর ছেড়ে কোলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে। এখন নৈচনপুরের বিশ্বাস ভিলার সেই অশরীরী আত্মাকে দূর থেকে কোনো একজন কাপালিক নিয়ন্ত্রণ করছে। ঐ দুষ্ট কাপালিক, গোটা বিশ্বাস ভিলাটার দখল নিতে চায়। এক্ষেত্রে তার পথের একমাত্র কাঁটা বিশ্বাস বংশের শেষ বংশধর সৈকত। এর আগে খগেন বিশ্বাসও তার রোষের শিকার হয়েছে। ঐদিন সে সৈকতকে মেরে নিষ্কন্টক হতেই চেয়েছিল। অশরীরী আত্মাকে খগেন দাদু বানিয়ে সেই কাপালিকই দূর থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিল। ঐ কাপালিকই অশুভ প্রেতাত্মাকে দিয়ে সৈকতকে গলা টিপে মারতে চেয়েছিল। সৈকত যখন 'মা গো বাঁচাও' বলে চিৎকার করে ওঠে তখন নিজের অজান্তেই সৈকত মা সারদা দেবীর মুখটা স্মরণ করে। এতে সৈকতের শরীরে শুভ শক্তির প্রবেশ ঘটে। শুভ শক্তির প্রচন্ড প্রভাবে অশুভ শক্তি পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর সৈকত মায়ের ফটো বুকে আঁকড়ে থাকায় কাপালিক বুঝে যায়, এই শুভ শক্তির সাহচর্য থেকে সৈকতকে না সরাতে পারলে, সে কিছুতেই লক্ষ্যে সফল হবে না। তাই অশরীরী শক্তি খগেন বিশ্বাসের রূপ ধরে আবারও সৈকতের কাছে আসে এবং তাকে নীচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। তাতেও অশুভ শক্তি ব্যর্থ হয়। কাপালিক এরপর ভীষণ রেগে গিয়ে ঝড়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে। তখন সৈকত যদি মায়ের ফটো ছেড়ে একবার বাইরে বেরোত তাহলেও কাপালিক একটা সুযোগ পেয়ে যেত। এক্ষেত্রেও ভয়ার্ত সন্তান কখনই তার মাকে ছাড়েনি। ফলত শুভ শক্তির পবিত্রতার কাছে অশুভ শক্তি পিছু হটতে বাধ্য হয়। দেবী মহামায়ার অফুরান শক্তির কাছে কাপালিকের সকল চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। সৈকত অক্ষত থাকে।
সৈকত মঠ থেকে বেরিয়ে আসছে। মঠের দেওয়ালে লেখা মা সারদা দেবীর একটা বাণীতে সৈকতের দৃষ্টি আটকে গেল। "আমি থাকতে বিধিরও সাধ্য নেই, আমার সন্তানদের কোনো ক্ষতি করে"।
পূর্বকথন:-
জরায়ু ক্যান্সারের সূচক সি.এ.১২৫ রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট অস্বাভাবিক রকমের বেশি আসে জয়িতা নামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের,ইতিমধ্যে ইউ.এস.জি রিপোর্ট জানান দিয়েছে টিউমারের অস্তিত্ব।অপারেশনের কিছুদিন আগেই রোগীর আত্মীয়ের হাতে চরমভাবে আহত হন এক জুনিয়ার ডাক্তার শুরু হয় ডাক্তারদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট
৭
জয়িতার হাতে এখন অঢেল সময়,কারণ তার চাকরিটা গেছে। বেসরকারী সংস্থা শুধু শুধু পুষতে রাজি নয় এক অকেজো স্টাফকে।শর্মি অর্থাৎ শর্মিষ্ঠা অনেক চেষ্টা করেছিল সেটা বাঁচতে, কিন্তু যখন বস বলল,শর্মিষ্ঠা, জয়িতা তোমার বান্ধবী হতে পারে কিন্তু আমাদের একজন কর্মীমাত্র আর তুমিও তাই। তখনই শর্মি বুঝতে পেরেছিল যে বেশি তদ্বির করতে গেলে তার চাকরিটিও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে।সে এসে এ কথা জয়িতাকে জানাতে জয়িতা মৃদু হেসে বলেছিল, এভাবেই সব চলে যায়,সবাই চলে যায়। কিচ্ছু জবাব দিতে পারেনি শর্মিষ্ঠা শুধু স্পর্শ করে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল পাশে থাকার আশ্বাস।
দিনকে দিন রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ক্রমশ ভেঙে পড়ার দিকে এগোচ্ছে, কার্যত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ডাক্তারেরা,সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা কার্যত অচল। বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে টিমটিম করে চলছে পরিষেবা এবং তা যে কোন মূহুর্তে স্তব্ধ হয়ে যাবে। জুনিয়ার ডাক্তারদের সমর্থনে সিনিয়ার ডাক্তাররা একে একে সরকারি পদ থেকে ইস্তফা দিতে লাগলো। সরকার আর ডাক্তার দু পক্ষেরই অনড় অবস্থানে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতে লাগলো রোগীরা।
জয়িতার শরীর ক্রমশ আরও শুকিয়ে যাচ্ছে।তাকে যেন একটা লড়াইতে নামার আগেই জোর করে হারাতে নেমেছে সব্বাই। চাকরি হারানোর পর তার নিজেকে শুধু সংসারের বোঝ ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। ভেবেছিল যে বাড়িতে টিউশানি শুরু করবে কিন্তু সে বুঝতে পারে শরীর বোধহয় আর সঙ্গ দেবে না।তবে অযাচিত ভাবে সে সঙ্গ পাচ্ছে সরিৎ এর আর সে ভালোই বুঝতে পারছে যে সে না চাইলেও সরিৎ তার সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। জয়িতার হাতে এখন অঢেল সময় তাই শরীর ভালো থাকলে সে তার কবিতার খাতা খুলে মাঝে মাঝেই কয়েকটা লাইন লেখে, এভাবেই একদিন সে লিখে ফেলল,
"সমুদ্র ঘেঁটেছি কাল সারারাত
কাল সারারাত আকাশ খুঁড়েছি
ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া সমস্ত প্রেম
কুড়াতে কুড়াতে দুহাত ভরেছি।
ভিড় ঠেলে ঠেলে একা হয়ে যাওয়া
একা হয়ে যাওয়া বাউলের মতো
নদী জুড়ে কত সাঁকো রাখা ছিল
সাঁকো জুড়ে দেখি কী গভীর ক্ষত।"
সরিৎ দেখল লেখাটা বলল, আরো লেখো জয়ী দেখবে অনেকটা লাঘব হবে তোমার যন্ত্রনা।কবিতা তোমার কাছে প্রাণবায়ু,লেখো আরো লেখো। জয়িতা আরো লেখে আর লেখে,
‘‘একা একা বেঁচে আছি বেশ
বেঁচে আছি মৃত্যুকে ঘিরে
কি জানি কখন হব শেষ
নাকি পাব ভাঙা ঢেউ ফিরে।
রোদ সব জমা থাক মনে
জমা থাক অনেক আপন
এভাবেই ভাল হব জেনে
একা একা নিভৃত যাপন’’
একদিন প্রবল যন্ত্রনায় কষ্ট পেতে পেতে রাগে- দুঃখে-অভিমানে জয়িতা লিখে ফেলে কয়েকটা লাইন,
‘‘তোমার আছে রাজারনীতি তোমার আন্দোলন
তোমার আছে ব্যালট বক্স আর স্টেথোর স্পন্দন।
আমরা সবাই কে আর বলো নালার ধারের পোকা
তোমরা দারুন প্রতিভাবান আমরা ভীষণ বোকা।
একদিকেতে মন্ত্রী-রাজা আরেকদিকে 'ঠাকুর'
দুর হয়ে যাহ্ রুগীর ধারী গলির নেড়ি কুকুর।
দয়ায় আছিস-দয়ায় বাঁচিস পায়ের নীচেই থাক
যুদ্ধে রাজা আর ঈশ্বর তোদের জীবন?? 'ভাগ....'।
কেউ কারোকে ছাড়ব নাতো এক ইঞ্চিও জমি
মরলে তোরা মরেই যা আজ করনা রক্ত বমি।
লড়াই হলে কয়েকটা প্রাণ যেতেই পারে চলে
এমনিতেই তো বেঁচে আছিস দয়ার শরীর বলে’’
ইতিমধ্যে বেশ কিছু বাদানুবাদের পর উঠে গেছে ডাক্তারদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট।উঠে যাওয়ার প্রথম দিনেই জয়িতাকে নিয়ে গিয়ে দেখানো হয়েছে হাসপাতালের আউটডোরে ডাক্তার আবার ইউ এস জি করতে নির্দেশ দিতেই সরিৎ তার সমস্ত সোর্স কাজে লাগিয়ে সেদিনই ইউ এস জি করিয়েছে আর রিপোর্ট হাতে পেয়েছে পরদিনই তাতে দেখা গেছে টিউমারের সাইজ বেড়ে গেছে কয়েক সেন্টিমিটার। দুদিনের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে জয়িতা এবং ডাক্তার বলেছে পরদিন এক ইউনিট রক্ত দিয়ে আর দুদিন অবজার্ভেশনে রেখে অপারেশন করা হবে,সরিৎ এর সোর্সে অসুবিধা হয় না রক্ত পেতে, রক্ত দেওয়ার দিন জয়িতা জানতে পারে একদিন বাদ দিয়েই তার অপারেশন। জয়িতা চোখ বন্ধ করার পর একটা আবছায়া মুখ দেখতে পায় কে.... সরিৎ?মামা? বাবা!!
ক্রমশঃ....
এবারও ইলশেগুঁড়ির দুটি শারদ সংখ্যা
প্রকাশিত হবে পুজোর অনেক আগেই
No comments