Header Ads

Header ADS

ইলশেগুঁড়ি ই পত্রিকা ৯ প্রথম খণ্ড

ইলশেগুঁড়ি পরিবারের পক্ষ থেকে জানাই শারদ শুভেচ্ছা


শারদ ই-পত্রিকা

প্রথম খণ্ড
১লা সেপ্টেম্বর ২০২১

সুচিপত্র

আমার পুজো 


নিবন্ধ
 দুর্গাপূজোর একাল সেকাল - অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়
আমাদের বাড়ীর পূজার সেকাল একাল - উত্তম চক্রবর্ত্তী 

কবিতা 

দুর্গতিনাশিনী  - অমিত চট্টোপাধ্যায়
আমার পূজো - সুব্রত দাস 
অ্যাবাউট এ দুর্গাপূজা - শ্রাবণী ভৌমিক

গল্প 

কড়া দিদিমণি - শম্পা সাহা
হঠাৎ - অঞ্জলি দে নন্দী, মম
সন্তানসৌতম 



আকাশ মেঘলা, মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার সাথে দু-এক পশলা জোর বৃষ্টি। মানুষের মন ভাল নেই। যে কালান্তক অতিমারী শেষ করে দিয়েছে স্বাভাবিক যাপন, তার তীব্রতা কমলেও আজও তার উপস্থিতি প্রকট। এ সময়েও ইলশেগুঁড়ি থেমে থাকেনি, মুদ্রিত সংখ্যার সমান্তরালে নিয়মিত প্রকাশ করেছে অনলাইন ই-পত্রিকা। পাশাপাশি, এই প্রায়ান্ধকার সময়ে ইলশেগুঁড়ি পরিবার গঠন করেছে সামাজিক সংগঠন বন্ধুমহল, এবং সদস্য, পাঠক ও বন্ধুদের সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুগর্ত ত্রাণে। এ হেন সময়ে ইলশেগুঁড়ি মুদ্রিত শারদ সংখ্যা এবারও সাহিত্য সংখ্যা যা প্রকাশিত হবে শারদ উৎসবের অনেক আগেই।
এটা অত্যন্ত আনন্দ ও শ্লাঘার বিষয় আমাদের এই পরিবার গত ১৫ই আগস্ট ছয় বছর পূর্ণ করে পদার্পন করল সপ্তম বছরে। এই শুভক্ষণকে মনে রেখে ইলশেগুঁড়ি পরিবার নিয়ে এল এক অভিনব উদ্যোগ - সাত সপ্তাহে সাত সাতটি পূজাসংখ্যা। আজ, ১লা সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রিয় পাঠক বন্ধুদের হাতে তুলে দেওয়া হল প্রথম খণ্ড শারদ ই-পত্রিকা।   



দুর্গাপূজোর একাল সেকাল

অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়

ছোটবেলার  দুর্গা পূজো

    আমাদের ছোটবেলায় দুর্গাপূজো ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। জাঁকজমক যতটুকু ছিল তা সবটাই   শহরে। বাড়িতে কঠোর অনুশাসনে বড় হতাম। স্কুল জীবনে কলকতায় গিয়ে ঠাকুর  দেখার অনুমতি ছিল না। আমাদের ছোট মফস্বল শহরের মধ্যেই আমাদের ঠাকুর দেখা।  তাতে অবশ্য আনন্দের খামতি ছিল না। দুর্গাপূজো মানেই আনন্দ। স্কুল ছুটি। মহালয়া থেকেই মোটামুটি বন্ধ পড়াশুনো।
    আমাদের যৌথ পরিবারে অনেক ভাইবোন। সারাদিন ধরে চলতো ফর্দ বানানো। কবে কোথায় মানে কোন পাড়ায়  ঠাকুর দেখতে যাব, কি কি খাবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। মা একটা ছোট মানি ব্যাগ দিত। তার মধ্যে যত্ন করে রাখতাম বাবার কাছ থেকে পাওয়া সবেধন নীলমনি এক টাকা। হ্যাঁ, এক টাকা। মায়ের নির্দেশ চার দিনের খরচ ওই এক টাকা। প্রতিদিন চার আনা করে। আজ আমি যখন আমার ছেলে মেয়েকে ওই কথা বলি  ওরা  হাসে।  ভাবে আমি মজা করছি। আসলে এটা জেনারেশনের পার্থক্য। আমাদের সময়ে ছিল পূজোর আনন্দটাই মুখ্য। কটা  জামা প্যান্ট পেলাম বা কত টাকা হাত খরচা পেলাম সেটা নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা ছিল না। বর্তমান প্রজন্ম দুর্গা পূজোর আনন্দ উপভোগ করে টাকার মূল্যে। সাধারণ একটা জামা প্যান্ট আর জুতো। এই ছিল আমাদের পূজোর বাজার। পূজোর পরে ওই জুতোটাই স্কুলে পরে যেতাম।
    সপ্তমীর দিন বাড়ির সবার সাথে যেতাম ঠাকুর দেখতে। হেঁটে হেঁটে। পূজো মন্ডপে না ছিল আলোর রোশনাই আর না ছিল কোন জাঁকজমক। অল্প  বাজেটের সব পূজো। তাই দেখতাম দু চোখ ভরে। একটার পর একটা। এভাবেই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। ফেরার সময় অবস্থা শোচনীয়। নতুন জুতো পরে পায়ের গোড়ালিতে ফোস্কা। হাঁটার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে জুতো মোজা  খুলে  হাতে নিয়ে  খালি পায়ে হাঁটতে  হাঁটতে বাড়ি আসতাম। 
বাকি দিনগুলো স্রেফ হাওয়াই চটি পরে ঘুরে বেড়াতাম। তাতে আত্মসম্মান এতটুকু ক্ষুন্ন হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
    দশমীতে সবার মন ভারাক্রান্ত। মা চলে যাবে কৈলাশে। আবার একটা বছরের অপেক্ষা। কাঁদতে ইচ্ছে করতো। পাড়ার পুকুরে হত বিসর্জন। তার আগে মন্ডপ থেকে ঠাকুর নামিয়ে রাখা হত মাঠে। এরপর ঢাকের তালে তালে ধুনুচি নাচ। প্রথমে ছোটরা। তারপর বড়রা। বড়রা সিদ্ধি খেয়ে আসতো। মাঠ ভর্তি। পাড়ার সমস্ত মানুষ ছোট থেকে বড়,পুরুষ মহিলা সকলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতো সেই নাচ। এই ভাবে চলতো ঘন্টা দুই। তারপর বিসর্জন। বিসর্জনের পরে  ছুটে  যেতাম মন্ডপে। ঠাকুর মশাই মন্ত্র উচ্চারণের সাথে সাথে ছিটিয়ে দিতেন শান্তির জল। ক্লাবের কর্ম কর্তাদের মধ্যে একজন কিনে আনতো বড় এক ঠোঙা বাতাসা। দিত হরির লুট। ধাক্কাধাক্কি, কাড়াকাড়ি। সে এক অনাবিল আনন্দ। ভক্তিভরে ধুলোয় মাখামাখি বাতাসার গুঁড়ো চেটেপুটে খেতাম। শুরু হত কোলাকুলি। গুরুজনদের প্রণাম। এবারে বাড়ি ফেরা। ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সমাজ জীবনের সমস্ত ভালো দিকগুলোই প্রণাম ও আলিঙ্গনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেত।
      পরের দিন সকাল থেকেই বন্ধুরা মিলে সবার বাড়ি বাড়ি যেতাম বিজয়া করতে। সেটাই ছিল প্রচলিত রীতি। মা, জেঠিমা, কাকিমারা সকলেই প্রস্তুত। গুরুজনদের প্রণাম করার পরেই চলে আসতো বিজয়ার মিষ্টি। আদর ভালোবাসার এতটুকু খামতি ছিল না কোথাও। পরের দিকে পেট ভরে যেত। আর খেতে পারতাম না। শুকনো খাবারগুলো পকেটে ঢুকিয়ে নিতাম।
    বিজয়ার আনন্দ এখানেই শেষ নয়। এরপরে ছিল আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বিজয়া করতে যাওয়া। তখনকার দিনে বিজ্ঞান একটু কম উন্নত হওয়ায় একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে  সামাজিকতা রক্ষা করতাম। এখনকার মত হোয়াটস্যাপ বা ফেসবুকের মাধ্যমে নয়। কারণ মোবাইল ফোন তো তখন অপরিচিত শব্দ। তার আগমন ঘটেই নি এই দেশে। তখন সম্পর্কের বন্ধন  ছিল অটুট। দূরে যারা থাকতেন তাদের পত্রের মাধ্যমে প্রণাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করতাম। চিঠির মাধ্যমে তারাও আশীর্বাদ করতেন। এই ভাবেই আনন্দ সহকারে বহন করে চলতাম আমাদের সনাতন রীতি রেওয়াজ।
    সে সব সুখের দিন  আজ আর নেই। 


বড়বেলার  দুর্গা পূজো

    এখনকার দুর্গা পূজো আমার চোখে পূজো নয় শুধু অর্থের দম্ভ। লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করে হীরে জহরতের প্রদর্শনী। বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়ে যায় মায়ের মুখ। নামীদামী  ক্লাবের মাথায় বসে আছেন রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রী। কার পূজো কত বড়? কার পূজোমন্ডপে সবচেয়ে বেশি ভিড় হল? এই নিয়েই ব্যস্ত সাংবাদিকরা আর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলো। সবটাই প্রভাবশালী লোকেদের ব্যক্তিগত ক্ষমতার প্রচার। রাজনীতির রঙ লেগেছে পূজো মন্ডপে। দুর্গাপুজো এখন আর চার দিনে শেষ হয় না। দ্বিতীয়া থেকে চলে দ্বাদশী ত্রয়োদশী পর্যন্ত। বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে সমাজের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ভিড় জমান মন্ডপে মন্ডপে। প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে উত্তর থেকে দক্ষিণের সমস্ত ক্লাব। বুদ্ধিজীবীরা হলেন বিচারক। টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে দেখানো হয় পূজা পরিক্রমা। ঘন্টায় ঘন্টায় মাপা হয় দর্শক সংখ্যা। পঞ্চমীতেই আপামর জনসাধারণ জেনে গেছে  বিজেতাদের নাম। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল। রাত যত বাড়ে, ভিড় তত বাড়ে। এখনকার দিনে দূর্গা পূজো মানে শিল্প প্রদর্শনী। সব থিম পূজো। আলোর রোশনাই আর মন্ডপসজ্জার কারিকুরি তাক লাগিয়ে দেয়। এরপর আছে কার্নিভাল। পুরস্কার বিতরণ। ইত্যাদি ইত্যাদি। এত কিছু মিটলে তবে বিসর্জন।
    খুব দ্রুত পাল্টে গেল আমাদের সংস্কৃতি, রীতি রেওয়াজ। আচার-আচরণ। এখন সব্বাই করে তাই সব্বাই করছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানের কলি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। ‘‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।’’ 
    এখনকার আনন্দ মনে হয় বড্ড বেশি লোক দেখানো। কৃত্তিমতায় ভরা। ভালো লাগে না এই মেকি আনন্দ। মন ছুটে যেতে চায় অন্য কোথাও। অন্য কোনখানে। যেখানে জাঁকজমক নেই, প্রচার নেই, বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়ি নেই, নেতা মন্ত্রীর খবরদারি নেই, লক্ষ লক্ষ মানুষের ঠেলাঠেলি, গাদাগাদির দম বন্ধ করা ভিড় নেই। আছে শুধু নীরবে, নির্জনে মাতৃ আরাধনা।  যেখানে অন্তরের অন্তঃস্থলে ফোটা পদ্মফুল নিবেদিত হয় মায়ের রাঙা চরণে সেখানে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে মনে হয় সার্থক আমার মানব জনম।
    এমনই এক স্থানের খোঁজ পেলাম কুমায়ুন পাহাড়ে। আলমোড়ায়। সেখানে ব্রাইট এন্ড কর্নারে আছে রামকৃষ্ণ কুটীর। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নেমে গেছে পায়ে চলা পথ। দূরে ঘন সবুজ জঙ্গল। জঙ্গলের পেছনে গভীর খাদ। খাদের ভেতর এখনো জাল বিছিয়ে আছে ভোরের কুয়াশা। অপর প্রান্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের চূড়া। নাম না জানা পাখিদের কলতানে মুখরিত এক অসাধারন প্রাকৃতিক পরিবেশ। ধরা ধামে একেই মনে হয় বলে স্বর্গ। স্বামীজী মহারাজের সাথে আগেই যোগাযোগ হয়েছে। আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি আমন্ত্রণ  জানালেন। দেখবো পূজো পাহাড়ে। অঞ্জলি দেব ভক্তি ভরে।
    ভোর বেলায় নামলাম লাল কুয়ায়। সেখান থেকে মোটরে সোজা আলমোড়া। মহারাজ বলেছিলেন অঞ্জলি দিতে হলে একটু তাড়াতাড়ি আসতে হবে। সেইমত হিসাব করে চলা। পথে বিপদ। মোটর গাড়ির একটা চাকা পাংচার। অত সকালে কোথায় দোকান? কিভাবে সারাবে? যাইহোক, কোন একটি গ্যারাজের মিস্ত্রিকে ডেকে তুলে ঠিক করা হল পাংচার। আবার ছোটা।কুটিরে যখন পৌঁছালাম ঘড়িতে সময় সকাল  ন’টা।
    মন্দিরের দরজা বন্ধ। জানিনা কেন মহারাজ দরজা খুলে বাইরে এলেন। পরিচয় দিতেই সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন ভেতরে। বললেন, হাত মুখ ধুয়েই চলে আসুন। অঞ্জলি দেওয়া শুরু হয়েছে। বাকি কথা পরে হবে।
    হাত মুখ ধুয়ে খালি পায়ে মায়ের মন্দিরে প্রবেশ করলাম। এখানে ঘটে পূজো। ঘটের  বিপরীতে মায়ের ফটো। ধুপ, ধুনো এবং ফুলের গন্ধে পরিপূর্ন। ফিরে পেলাম পূজোর গন্ধ। ছোটবেলার সেই ভালো লাগা আবার ফিরে  এলো। শতরঞ্চি বিছানো। অঞ্জলি দিতে এসেছেন অনেকে। আমরাও বসলাম। স্বামীজীরাও আছেন। সমস্তটাই তদারকি করছেন মহারাজ। পুরোহিতের শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারনে মন্ত্র পাঠ সমস্ত পরিবেশটাকেই এক অন্য মাত্রায় পর্যবসিত করেছে।
    কোথাও ছিটেফোঁটা অর্থের দম্ভ, জাঁকজমক, আলোর রোশনাই, ক্ষমতার  অহংকার নেই। আছে শুধু ভক্তি, শ্রদ্ধা আর বিনয়। ভক্তি ভরে মায়ের পায়ে দিলাম পুষ্পাঞ্জলি। অনাবিল আনন্দে ভরে গেল মন। এরপরে স্থানীয় কিছু পূজোমন্ডপে গেছিলাম। আড়ম্বরবিহীন সব পূজো। পূজোর আয়োজকরা এখানে সকলেই সাধারণ পাহাড়ি মানুষ। না আছে এদের পরিচিতি, না আছে ক্ষমতার অহংকার। ভক্তি ভরে মায়ের পুজো করতেই এরা ভালোবাসে আর সেটাই করে। রঙিন কাগজ আর বেলুন দিয়ে সাজানো রাস্তা। ভিড় নেই, হল্লা নেই, জৌলুশ নেই। আছে রীতি রেওয়াজ আর ভক্তি।
    ফিরে পেলাম আমার হারিয়ে যাওয়া  আনন্দে ভরা দুর্গা পূজোর  দিনগুলো।

আমাদের বাড়ীর পূজার সেকাল-একাল

উত্তম চক্রবর্ত্তী

    ছোটবেলার দিনগুলো মাঝে মধ্যে উঁকি দেয় মনের মাঝে। আজ সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি চলছে। দোতলার বারান্দায় বসে শিউলি গাছটার দিকে তাকিয়ে আছি। চলছে শরৎ কাল। কিন্তু কে বলবে শরৎ, যেন বর্ষারাণী এখনো মায়া কেটে যেতে পারেনি। 
    তাকিয়ে আছি দূরের মাঝপাহাড়ী বনের দিকে। ঝাপসা, সব ঝাপসা। গিন্নি চা দিয়ে গেল। গরম কাপে চুমুক দিয়ে বহুদিন পর ফিরে গেলাম শৈশবের দিন গুলোতে। আমার গ্রামের বাড়ি, অর্থাৎ পুরুলিয়ার কাঁসাই নদীর তীরে পায়রাচালী। গাঁয়ের পরিধি বেশ বড়। ওখানেই কেটেছে আমার শৈশব। শরৎকাল এলেই মনের মাঝে উতলা হাওয়া কানে কানে বলে যেত, ওরে পূজো আসছে। আমরা মানে তুতোভাইদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দ জন। বাবা, কাকা, জ্যেঠু মিলে ছিলেন পাঁচ ভাই। যৌথ পরিবার। বাবা পূজোর আগে আমাদের জন্য এনে দিতেন লঙ ক্লথ, জামা প্যান্ট তৈরীর জন্যে। সব ভাইদের জামা প্যান্টের রঙ এক। পাড়ার দর্জি শান্তিদা তৈরী করতো। সার্টিনের কাপড়ে শান্তিদার দোকানে তৈরী পাতলুন, পাতলুনের পায়াতে দুটো লাল রঙের বর্ডার। স্কুল ছুটির পর বাড়ী ফিরে একবার ছুটে যেতাম শান্তিদার সেলাই দোকানে। আমার জামা পাতলুং তৈরি করলো কিনা দেখার জন্য।
    প্রতিদিন তাড়া দিতাম, এরপর আমারটা তৈরি করে দাও না শান্তিদা। শান্তিদা বলতো অখন আসো কত্তামশাই, তুমার পাতলুং আর জামা বানায়্যে দিব। দিন পেরিয়ে যেত, অখন যে কখন বুঝতে পারতাম না। 
    এরপর আমরা ভাইরা মিলে ছুটতাম দুর্গামন্দিরে। সেথায় সৃষ্টিকাকা আপন খেয়ালে মাটির তালে একমনে ফুটিয়ে তুলতো মায়ের মূর্তি। আমার কাকা জ্ঞান শঙ্কর চক্রবর্ত্তী। খুব রাশভারী মানুষ। বলতেন ওরে সৃষ্টি, একচালাতে মায়ের মুখমন্ডল থেকে যেন আলোর ছটা বের হয়। মৃন্ময়ী যেন চিন্ময়ী হয়ে ওঠে। সেদিকে লক্ষ্য রাখিস। 
    সৃষ্টি কাকা হাত জোড় করে বলতো, জো হুজুর আঁইজ্ঞা। হামদের বাপ ঠাকুরদাদা ইঠিনে ঠাকুর গড়্যে গেছেন। হামরা উয়াদের সঙে আসথি। দেখথি হাতের কাইজ। উনারা যেমনটি কইরতেন অমনটিই হবেক্। তাই ত মাটি ছানার আগে ঢের ভাঁউর কইরে লিই। মনের ভিতরে মায়ের ছবিট আগে আঁক্যে লিই। নিরামিষ্যি খাই। মুত্তি গড়হা শ্যাষ হোক্, চইখ্ দানের ছামুতে টুকদু দেখ্যে যাবেন। উয়ার পর ঘাম তেল মাইরব্য। তখন মা চকচকাবেক্। 
    কাকা বেরিয়ে গেলেই আমরা ভাইরা মন্দিরে ঢুকে পড়তাম। সৃষ্টি কাকার ছানা মাটি নিয়ে ঠাকুর গড়ার চেষ্টা করতাম। ঠাকুর গড়তে গড়তে সৃষ্টি কাকা পিছন ফিরে বলত, বাবা ঠাকুররা,মাটিট লষ্ট কইরঅ না। ইমন কইরে কি ঠাকুর হয়? আগে মায়ের মূর্তি লিজের হৃদয়ে আঁইকত্যে হয়, উয়ার পর দেইখব্যে মা লিজের কাইজ লিজেই করাই লিবেক্। রাখ রাখ, মাটি রাখ। হঁ, শুনঅ যাওয়ার সমুই তুমাদের লাগ্যে ইকটা কইরে লাড়ু গোপাল বানাই দিহে যাব। ইখন ডিসটিরাব কইরঅ না। যাও, ঘরে যাও। সাঁজের আলঅ নাম্যে আল্য। মা ঠাকরুনরা চিন্তা কইরবেক্।
    সন্ধ্যা নামতো। শাঁখের আওয়াজে সারা গ্রাম মুখরিত হত। আমরাও হ্যারিকিনের আলোতে পড়তে বসলেও মন পড়ে থাকতো দুর্গা মণ্ডপে। মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তিতে। পূজোর দিন গুলি কখন আসবে ... 
তারপর পিতৃপক্ষের অবসান। ভোরবেলায় আমাদের ঢাউস রেডিওতে বেজে উঠতো বীরেন্দ্র কিশোর। 
"য়া দেবী সর্ব ভূতেষু মাতৃ রূপেন সংস্থিতা-"
    তখনকার দিনে সারা অঞ্চলে কেবল আমাদের বাড়িতেই রেডিও ছিল। রেডিও রাখলে সরকারকে ট্যাক্স দিতে হতে। প্রতি বছর রেডিওর লাইসেন্স রিনিউ করাতে হত। 
    বাবা, কাকারা আর জ্যেঠু, সাথে আমরাও। অঞ্চলের বহুলোক আসতো বীরেন্দ্র কিশোর শুনতে। আমাদের উঠোন ভরে উঠত। ব্রাহ্মমূহুর্তে সবাই যেন চলে যেতাম দেবীর আগমনীর রাজ্যে। এই তো পূজো এসে গেল। 
    দেখতে দেখতে ষষ্ঠীর সকাল। বাজির ব্যাগ হাতে আমরা মন্ডপে বাজি ফাটাতাম। ষষ্ঠীর দিন নবপত্রিকা তৈরী করত গ্রামেরই অলীক পাল। মহালয়ার দিন থেকে তিনি একবেলা নিরামিষ আহার করতেন। তৈরী হত নবপত্রিকা। অর্থাৎ নয় ধরনের পাতা, যা মায়ের প্রতিভূ। এগুলি হল ধান, বেল, কচু, মান, অশোক, ডালিম্ব, জয়ন্তী, হরিদ্রা ও কদলী। নতুন পাটের দড়ি দিয়ে নবপত্রিকা বাঁধা হত। খুব যত্ন সহকারে নবপত্রিকা বেঁধে জিজ্ঞাসা করতেন, কি দাদা ঠাকুর, দেখলে নবপত্রিকা কি ভাবে বাঁধতে হয়? 
    এরপর ষষ্ঠীর সন্ধ্যা বেলায় বিল্ব বরণ অনুষ্ঠান। মনের মাঝে শুরু হয়ে যেত পূজোর বাজনা।মণ্ডপে আলোর রোশনাই। বাবা কাকাদের মন্দিরে তদারকি। সাজ সাজ রব। মণ্ডপে বাজতে থাকে ঢাক ... ড্যাম কুড়াকুড়-ড্যাম কুড়াকুড়। 
             সারারাত ঘুমোতে পারতাম না। কখন ভোর হয়। পূব আকাশে ভূরসা তারা দেখে বাবা সবাইকে ঘুম থেকে তুলে দিতেন। সবাই স্নান সেরে নতুন ধুতি, উত্তরীয় পরে যেতাম মন্দিরে। তারপর নবপত্রিকা পাল্কিতে করে নিয়ে গিয়ে বড়পুকুরে মায়ের আবাহন করা হত। ভাবতাম বড় পুকুরের পদ্ম বনে গভীর কালো জলের তলায় মায়ের শ্বশুর বাড়ি। মা ওখান থেকে এসে আমাদের পাল্কিতে চেপে বসবেন। পুরোহিত মশাইয়ের উদাত্ত কন্ঠে সামবেদীয় মন্ত্র। মনটা ভরে যেত। সারা গ্রাম তথা অঞ্চলের নারীপুরুষে ভরে যেত পুকুর পাড়। সবাই এসেছে মাকে বরণ করে নিতে।     
    দেখতে দেখতে পূজোর দিনগুলি পেরিয়ে যেত। দিয়ে যেত একরাশ মনখারাপ। তবুও উঁচিয়ে থাকতাম, ত্রয়োদশীর রাতে যাত্রার জন্য। সকাল থেকে যাত্রা দেখার উন্মাদনা। গ্রামের লোকেরা অনেকে এতে অংশ নিত। সকাল থেকেই আমরা চন্ডীমন্ডপ চত্বরে বস্তা পেতে জায়গা রাখতাম। মাঝেমাঝে জায়গা নিয়ে মারামারি যে হত না, তা নয়। কিন্তু সব ভুলে যেতাম যাত্রা শুরু হলে।
    এবছর রয়েছি গ্রামের বাড়িতে। আমাদের পূজো এবছর ১০৮-এ পা দেবে। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেছে সেই উন্মাদনা। এখনকার ছেলেমেয়েরা যেন অনেক খানি পাল্টে গেছে। এদের শৈশব কে যেন কেড়ে নিয়েছে। সবাই কেমন যেন রোবট হয়ে গেছে। 
    বহু বছর পর আজ গেলাম দুর্গামন্দিরে। সেথায় আর সৃষ্টি কাকা নেই। প্রতিমার কাঠামোতে মাটি চাপাচ্ছে সৃষ্টি কাকার ছেলে ফটিক। যেতেই একখানা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, আসেন দাদাঠাকুর, বসেন কত্তা। 
    জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কাজ কেমন এগুচ্ছে ফটিক? 
    ফটিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দাদাঠাকুর আপনাদের বাড়ী এবছর ১০৮ বছরের পূজা। হামদের বাপ ঠাকুরদা পিতিমা তৈয়ার কইরছ্যে। তবে জানেন কি আঁইজ্ঞা, আর মায়ের মূর্তি বানাত্যে ভালট নাই লাগে। দিনকাল যা পঢ়্যেছে, চাইরদিকে মাইয়া মানুষের উপর অত্যাচার। মা ও ত মা, মাইয়া। কেমন কইরে আর মায়ের পিতিমা বানাব। কেউ ত উনাদের সম্মান দেই নাই। উমা মাইয়ের পুজা কইরে কি হবেক্? পিথিমি ট রসাতল গ্যাছে ...
    ফটিকের চোখে জল। একজন অশিক্ষিত কুমোর বংশ পরম্পরায় অনুভব করে এসেছে মাকে। আর আমরা শিক্ষিত হয়েও মায়ের পূজো করছি, মা কে না চিনে, না অনুভব করে। 
    পাল্টে গেছে মনুষ্যত্ববোধ, পাল্টে গেছে মায়ের পূজোর সেকাল-একাল।
 

আমার পুজো - কবিতা


দুর্গতিনাশিনী

অমিত চট্টোপাধ্যায়


তুমি এলে মাগো আলো ফিরে আসে
বহে আনন্দধারা
তুমি এলে মাগো হাওয়া খুলে দেয়
মনের বন্ধ কারা

তোমার আসার পথে চেয়ে থাকা
বছর বছর ধরে
কাশফুল গায় আগমনী গান
আশ্বিন মাসের ভোরে।

কতো দুখি মুখে হাসি ফুটে ওঠে
কতো খালি গায়ে জামা
ভোগের গন্ধ চারদিন ধরে
লেখে উৎসবনামা ।

চারিদিকে বাজে আনন্দগান
আলো ঝলমল বিশ্ব
তুমি এলে মাগো জাদুর ছোঁয়ায়
হাসি ফিরে পায় নিঃস্ব

চিরদিন তুমি এমনি করেই
সকলকে ভালোবেসো
মা দুর্গা তুমি একবার নয়
বছরে  দু’বার এসো।

আমার পুজো

সুব্রত দাস


আমার পুজো শিউলি খুশির -
পেঁজা তুলোর মেঘে,
শুভ্র কাশের চামর দোলায়
বাতাসি দোল বেগে!

আমার পুজো, টাকডুমা ডুম
ঢাকের বাদ্যি শুনে,
এক লহমায় ঘুরেই আসি
সিমলা-উটি-পুনে !

আমার পুজোর সময় কাটে
লিখেই গল্প ছড়া,
ছুটির দুপুর, কাব্য নূপুর
শারদীয়ার পড়া!

আমার পুজো, দুর্গাপুজো
স্বজন সুজন সাথে,
সুখের দুখের বুকের ভেতর
ছুটির মজায় মাতে !!

অ্যাবাউট এ দুর্গাপূজা

 শ্রাবণী ভৌমিক


      দীর্ঘ মহানগরীর পেরিয়ে এখনো ফিনফিনে অন্ধকার,
দুঃখের গানের মত শুয়ে থাকি।
দূর্গা পূজার দিন গুনে পরিকল্পনাগুলোকে আঁকি,
মনে ভাবি কবে আসবে সাদা চাঁদ।
মহামারী যে পেতে রেখেছে সকলের জন্য ফাঁদ।


সিংহ পিঠে মা দুর্গা যদি আসেন কাদামাটি পথে,
মহামারীর দীর্ঘ নৈরাজ্য অরাজকতা থেমে যাবে যাত্রা করবে ফিরে যাবার রথে।
তখন মাতৃ আরাধনার নিনাদ শুরু হবে,
মহামারীর মত দুঃস্বপ্ন দেখেও শান্তিতে রয়েছি।
মুছে ফেলেছি রক্তচোষা মহামারীর নৈশভোজের স্মৃতি,
শোনার অপেক্ষায় এখন মাতৃ আরাধনার ভক্তিগীতি।

গল্প 

কড়া দিদিমণি

শম্পা সাহা


    ‘‘ওই মেয়েছেলে নিয়ে আমি আর সংসার করতে পারবো না বাবু! তোরা বরং আলাদা হয়ে যা।’’

    মা, অবুঝের মত কথা বোলোনা তো! আমি আলাদা হলে তোমাকে কে দেখবে?’’

    ‘‘আমি ওসব জানি না। এ সংসারে হয় ও থাকবে নয় আমি! তখনই পই পই করে বারণ করেছিলুম। বিয়ে করিস না, করিস না। শুনলি না। ডিভোর্সি মেয়েছেলে কি আর সংসার করতে পারে রে...’’

    ‘‘মা, তুমি চুপ করো। কি যা তা বলছো!’’

    ‘‘ঠিকই বলছি। ওসব ঘর জ্বালানি, পর ভালানি মেয়েছেলে যদি অতই ভালো হতো তো ওই বর কি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদেয় করে দিতো?’’

    ‘‘মা, ও নিজে চলে এসেছে ওখান থেকে। তুমি সবটাই জানো। জেনে এসব বলছো কেন?"

    ‘‘জানলে কি বলতুম রে...। ওর মুখে বিষ! আমি ওর সঙ্গে ঘর করবো না, এই বলে দিলুম!’’

    বেশ অনেকক্ষণ ধরে ঋতজার বর আর শ্বাশুড়ির মধ‍্যে কথাকাটাকাটি চলছে। কারণটা ঋতজা নিজে। যদিও তাতে ঋতজার মোটেই কোনো লজ্জা বা আক্ষেপ নেই।

আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে দুটো অল্পবয়স্ক মেয়ে, নেহাতই কলেজ ছাত্রী তারা ঋতজার সঙ্গে একসাথেই বাস থেকে নামে। নামার সময় বাস কন্ডাক্টর ইচ্ছে ক‍রে একটি মেয়ের বুকে হাত দেয়।

    মেয়েটি প্রতিবাদ করায় কন্ডাক্টর দোষ তো স্বীকার করেই না উল্টে মেয়ে দুটো অসভ‍্যের মত গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল বলে উল্টো দোষারোপ করে।

    ব‍্যস! ঋতজা কয়েক পা এগিয়ে এসেছিল, ফিরে গিয়ে দু চড় সপাটে কন্ডাক্টর এর গালে।যদিও সে লোকটি, আমি গরীব, টরীব বলে সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঋতজা চিৎকার করে, ‘‘প্রায় দিনই বাসে আপনি এরকম করেন বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে। কেউ প্রতিবাদ করেনি, তাই আমিও কিছু বলিনি। কিন্তু আজ হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। এই চড় দুটো ওই বাচ্চা মেয়েগুলোর হয়ে আমার প্রতিবাদ!’’

    গণ ধোলাই হয়তো হতো, কিন্তু ঋতজা পুলিশে ফোন করে, সেই লোককে পুলিশের হাতে তুলে দেবার ব‍্যবস্থা করে।

    এই খবর লতায় পাতায় এ কান সে কান হয়ে যখন শ‍্যামলীদেবীর কানে পৌঁছায় ততক্ষণে সেটা তিল থেকে তাল হয়ে গেছে। লোকে ফোন করে করে জানছে! ছি,ছি লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে শ‍্যামলী দেবীর।

সেই নিয়ে দু কথা শোনাতে গেছিলেন বৌমাকে, ‘‘ঘরের বৌ, ও সব কি? একবার ঘর ভেঙেছে, এবার তো একটু সমঝে চলা উচিৎ!’’ 

ও বাবা, কার কি? কথায় বলে না, চোরায় না শোনে ধর্মের কথা! উল্টে ঋতজা সাফ জানিয়ে দিয়েছ,’’ এরকম আবার দেখলে, আবার চড় কষাবো!’’

শ‍্যামলীদেবী মোটেই এই বৌ নিয়ে সংসার করতে পারবেন না। একে তো ডিভোর্সি। বাবু যে কি দেখলো ওই বুড়িটার মধ‍্যে কে জানে? ভেবে পান না শ‍্যামলী দেবী। ও কি বৌ না আগুনের খাপড়া! একে ডিভোর্সি, আমার বাবু দয়া করে বিয়ে করেছে, কোথায় মাথা নিচু করে থাকবি!ওর দয়াতেই তো আবার মাথায় সিঁদুর পরতে পারছিস! তা নয়! বাবা গো বাবা!  কি মুখ!

ভয়ংকর বিদ্রোহী শ‍্যামলী দেবী। হয় এসপার নয় ওসপার!

সেই দিনের ঘটনার পর থেকে আর শাশুড়ি বৌমাতে কথা নেই। শ‍্যামলী দেবী যদিও ঠারেঠোরে অনেক কথাই শোনান তা বৌমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় কিনা শাশুড়ির সন্দেহ কারণ ঋতজার কোনো হেলদোল নেই। সে যেন এক অন‍্য রকম মানুষ।

প্রথম বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ডিভোর্স। প্রথম স্বামী চায়নি ঋতজা তার বাবা মাকে তার মাইনের অর্ধেকটা দিক। কিন্তু ঋতজার এক কথা, ‘‘বাবা মা আমাকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। এটা আমার কর্তব্য!’’ 

এই নিয়ে রোজকার অশান্তি শেষে ডিভোর্স। অরিন্দমকে বিয়ে করতে ঋতজা মোটেই রাজী ছিল না। কিন্তু অরিন্দম ঋতজার মধ্যে দেখতো এমন একজন কে, যে শুধু একজন মেয়ে নন, একজন সম্পূর্ণ মানুষ। ঋতজার এই অনমনীয় মনোভাবই অরিন্দমকে আকর্ষণ করে ওর প্রতি।

ঋতজাকে বোঝাতে না পেরে শেষে ওদের বাড়িতে হানা দেয় অরিন্দম। ওর বাবা মা মেয়ের জন্য যথেষ্ট চিন্তিত তাছাড়া মেয়ের ডিভোর্সের জন্য ওনারা মনে মনে নিজেদেরই দায়ী করতেন।

তাই অরিন্দমকে পেয়ে ওনারা যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। ব‍্যস ওদের বিয়েটা হয়ে গেল।

অরিন্দম কখনো ঋতজার রোজগার, মাইনে নিয়ে কিছু বলতো না। কিন্তু ঋতজা নিজে থেকেই সংসার চালানোর জন্য দশ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে অরিন্দমের হাতে দিত।অরিন্দম বার দুয়েক না করেছিল, কিন্তু ও শোনেনি। ওর সাফ কথা, ‘‘আমি চাকরি করি, আমার খরচ তুমি কেন চালাবে?’

ওরা দুজনেই সংসারে সমান খরচ দিত। উপহার বাদে আর কখনো ঋতজা অরিন্দমের থেকে কিছু চাইতো না। আবার নানা উৎসব উপলক্ষে শ‍্যামলীদেবী বা অরিন্দমের জন্য নিজে থেকেই কেনাকাটা করে আনতো।

কিন্তু যতই করুক, শ‍্যামলীদেবী কিছুতেই ঋতজাকে মেনে নিতে পারেননি। ডিভোর্সি ভাবলেই মনটা জ্বলে পুড়ে যেত শ‍্যামলীদেবীর। আইবুড়ো ছেলে কেন এক এঁটো মেয়েমানুষ বিয়ে করবে? এই মত থেকে শ‍্যামলীদেবী কোনোদিন সরে আসেননি।

সেই ঘটনার দিন পনেরো পরে, অরিন্দম অফিসের কাজে ব‍্যাঙ্গালোরে। ঋতজা নিজের কাজে ব‍্যস্ত। শাশুড়ির সঙ্গে তার কথাবার্তা বন্ধ থাকলেও দায়িত্বে কোনো ত্রুটি নেই আবার মন পাবার বাড়তি আদিখ্যেতাও না।

হঠাৎই মাঝরাতে টয়লেট যেতে গিয়ে শাশুড়ির ঘর থেকে একটা শব্দ পেয়ে ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে উঁকি মারে ঋতজা। একি শ‍্যামলীদেবী ওরকম করছেন কেন?

ঋতজা ছুটে যায় ঘরে, ‘‘মা আপনার কি হয়েছে, শরীর খারাপ করছে?’ শ‍্যামলীদেবীর ততক্ষণে কথা আটকে এসেছে, উনি কিছু একটা বলতে চান কিন্তু পারেন না, তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন বিছানায়।

ঋতজা তাড়াতাড়ি একটা উবের বুক করে, কোনোরকমে পোশাক পাল্টে, ড্রাইভারকে সঙ্গে করে শ‍্যামলীদেবীকে গাড়িতে তুলে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে নিয়ে যায়।

আ্যাম্বুলেন্সেও ফোন করেছিল, কিন্তু পায়নি। গাড়িতে যেতে যেতে অরিন্দম, পরিচিত বন্ধু যাদের দরকার লাগতে পারে সবাইকে ফোন করে।

হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে পৌঁছলে, সঙ্গে সঙ্গেই চেকাপ করে ভর্তি করা হয়। যদিও ওরা যখন হাসপাতালে পৌঁছায় তখন ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার কেউ ছিল না।

ঋতজা রীতিমতো চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। সেই হই হট্টগোলের মধ্যেই  দুয়েকজন বন্ধু চলে আসেন। ফলে শ‍্যামলীদেবীর চিকিৎসা প্রায় সময় মতোই শুরু হয়।

পরদিন সকালের ফ্লাইটেই অরিন্দম ফিরে আসে। দুদিন সেন্সলেস থাকার পর জ্ঞান ফেরে শ‍্যামলীদেবীর। ম‍্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন। সময় মতো চিকিৎসা শুরু না হলে কি হতো বলা মুশকিল!

 জ্ঞান ফিরেই শ‍্যামলীদেবী ছেলেকে দেখতে পান কিন্তু ঋতজা, সে কোথায়? 

ঋতজা কে খোঁজ করতে দেখেন বৌমা এসে আয়াকে বকা ঝকা করছে, কেন ওনার টেবিলটা এতো নোংরা, পরিস্কার করা হয়নি?পেশেন্টের এটুকু যত্ন না রাখলে ওদের কাজ কি?

শ‍্যামলীদেবী অস্ফুটে বৌমাকে কাছে ডাকেন। ঋতজার বিশ্বাস হয় না। সে ভাবে মনের ভুল।

কিন্তু আবার ডাকেন, ‘‘বৌমা’’, অরিন্দম মায়ের কথা বুঝতে পেরে বলেন, ‘‘মা তোমাকে ডাকছে।’’

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ঋতজা গুটি গুটি পায়ে শাশুড়ির কাছে আসলে, শ‍্যামলীদেবী ছলছল চোখে বলেন, ‘‘তুই এরকমই থাকবি কড়া দিদিমণি, কেমন?’’

ঋতজা ধমকে ওঠে, ‘‘থামুন, একদম কথা বলবেন না। ডাক্তার আপনাকে কথা বলতে বারণ করেছে!’’

বৌমার কথা শুনে এই প্রথমবার শাশুড়ি, শ‍্যামলীদেবী চুপ করে যান।


হঠাৎ 

অঞ্জলি দে নন্দী, মম


সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর মাত্র তিন দিন কেটেছে। বউয়ের বাবার দেওয়া গয়না যা তার বাবারই দেওয়া আলমারীর লকারে ছিল। চাবি ছোট ননদ নিজের কাছে রেখেছিল। হঠাৎ এক সকালে বাথরুম থেকে স্নান করে ঐ ঘরে ঢুকে দেখলো যে আলমারী ও লকার খোলা, একটিও গয়না নেই। প্রায় ত্রিশ ভরির গয়না ছিল। ছুটে গিয়ে স্বামীকে বলল। সে বলল, ‘‘ওসব আমার ছোট বোন পরবে। তোমার নয় আর।’’ অবাক হয়ে বউটি তাকিয়েই রইল। ন যযৌ ন  তস্থৌ। এও হয় সে জানতোই না আগে কখনও। 
    এরপর অষ্টমঙ্গলায় জোড়ে গেল, পতিপত্নী। বাবার বাড়ি গিয়ে কন্যাটি তার মাকে এই ব্যাপারটি জানালো। মা তখন বাবাকে জানালো। শ্বশুর তখন জামাইকে বলল, ‘‘জামাই বাবা জীবন! ওই গয়না তোমরা আমার মেয়েকেই পরতে দিও। ক্যানো না ওগুলি তো ওর নামেই গড়ানো, ওগুলো পরেই তো ওর বিয়ে হয়েছে। তাই। আমি আলাদা গয়না তোমার বোনকে দিচ্ছি।’’ এরপর এখান থেকে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় জামাইয়ের হাতে শ্বাশুড়ী পঞ্চাশ ভরি সোনার গয়না তুলে দিল। হ্যাঁ, মেয়ে এখানে প্রায় পনেরো দিন ছিল। আর জামাইও। পনেরো দিনে তাই নতূন গয়না অনায়াসেই গড়ানো হয়ে গেল।
    যখন ওরা ঢুকলো, তখন, একটু পরে, ছেলেটি তার বোনকে ঐ গয়না দিল ও বলল, ‘‘এ সব নতূন গয়নাগুলি তোর। এবার তুই তোর বৌদির ওই পুরোনো গয়নাগুলি ওকে ফেরত দিয়ে দে!  কিন্তু ননদ বলল, ‘‘ওগুলিও আমার, আর এগুলোও আমারই।’’
    বউটি অবাক হল। কিন্তু কিছু বলল না। কারণ সে বহু উচ্চ মনের মানুষ ছিল। কিন্তু সে মেনে নিলেও ঈশ্বর মেনে নিল না। কারণ বউটি যে জন্ম সূত্রে ঈশ্বরের আশিস ধন্যা। ঈশ্বর তার হয়ে উচিৎ স্টেপ নিল। 
         প্রায় এক বছর পর ছোট ননদটির বিয়ের দিন স্থির হল। আগে থেকেই এ বাড়িতে পাত্রের আসাযাওয়া, থাকা, মেলামেশা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ছিলই। শুধু ও বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। এ ছোট থেকেই এ বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন পড়তে আসতো। আবার পাত্র ননদের দাদার ক্লাস মেটও ছিল। যাক তা হল কী? বিয়ের রাতে যখন বাসর ঘরে বসে আছে। হ্যাঁ, বৌদির বাবার দেওয়া শাল কাঠের খাটের ওপরের বিছানায় বাসরের আসর হচ্ছিল। আর বউটি ছাদে মশার কামড় খেয়ে, একটি মাদুর পেতে, খালি মাথায়, বালিশ ছাড়াই রাত কাটাচ্ছিল। আর বর সে তো মায়ের বিছানায়। ফ্যানের হাওয়ায় ঘুমোচ্ছে। হ্যাঁ, হঠাৎ এক দল ডাকাত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে ছোট ননদের গায়ের প্রায় আশি ভরি সোনার গয়না কেড়ে নিয়ে চলে গেল। হ্যাঁ এ সবই তো বৌদির ছিল না। পরের দিন শূন্য গায়ে ছোট ননদ তার স্বামীর সঙ্গে বধূ হয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল। 
    গিয়ে ঢোকার সময় থেকেই শুরু হল ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের নির্যাতন। খালি অঙ্গে গয়না ছাড়া ঠকিয়ে ছেলেকে বগলদাবা করে নিল। নিজের দাদার বিয়েতে তো অঢেল নিলো। ঠগ বাপের ঠগ মেয়ে। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
        এর এক বছর পর ছোট ননদটির ব্রেন ডিফেক্ট হল। শোনা গেল যে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কিছু লুকিয়ে খাইয়ে দিয়ে পাগলী বানিয়ে দিয়েছে। এরপর তারা এই বউকে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে দিল। আর ছেলের আবার দেখেশুনে দ্বিতীয়বার বিয়ে দিল। 
    আর অকারণ এদিকে বৌদির ওপরে তার দাদা ও ফ্যামিলির সবাই শোধ নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের করে দিল। যদিও তার কোনোই দোষ ছিল না, তবুও। তা শাপে বর হল। বউটি নিজের যোগ্যতায় এক প্রকাশনা সংস্থায় লেখিকার চাকরী পেয়ে গেল। আরও অনেক পরে সে লেখিকার পুরষ্কার পেয়ে জগৎ বিখ্যাত হল।
      আজও ধর্মের কল বাতাসে নড়ে...

সন্তান

সৌতম

    ভদ্রমহিলার বয়স পঁয়ষট্টির আশেপাশে। খুব কম বয়সেই তিনি বিধবা হন, যখন তাঁর ছেলের বয়স বছর চারেক হবে। বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে, বিভিন্ন মানুষের থেকে সাহায্য বা সহযোগিতা নিয়ে তিনি ছেলেকে মানুষ করেছেন। ছেলে এখন শহরে থাকে। সময়াভাবে মায়ের কাছে আসতে পারে না, কিন্তু মায়ের থাকার জন্য ছোট্ট একটি ঘর-বারান্দাসহ পাকা বাড়ি তৈরী করে দিয়েছে, অবশ্য সবই ফোনের মাধ্যমে কথাবার্তা বলে এবং ব্যাঙ্কের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে, যাতে তার মায়ের থাকতে কোন অসুবিধা না হয়। 
    প্রতি মাসে মায়ের প্রয়োজনমতো টাকা তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। যদিও মাকে দেখতে আসার মতো সময় তার নেই, আর বহুদিন দেশের বাড়িতে না আসার ফলে মায়ের মুখটাই বোধহয় সে ভুলতে বসেছে। আগে যদিওবা ফোন করলে একটু আধটু ধরতো, বিগত কয়েক বছর তো ফোনে রিং হয়ে গেলেও ধরার সময় পায় না বা পরে উল্টে ফোন করেও না, হয়তো খুব ব্যস্ত। এখন যেহেতু বয়স বাড়ছে, তাই তাঁর চিন্তাও একটু বাড়ছে, শরীর আর আগের মতো সায় দেয় না, চেহারাও ভেঙে গিয়ে আগের থেকে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। নিজের রান্নাটুকুও ঠিকমতো করে উঠতে পারেন না। 
    ক’দিন ধরে শরীরটা একদমই ভালো যাচ্ছে না। তাই একজন প্রতিবেশী যুবককে ডেকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। প্রতিবেশী যুবকটি তাঁকে নিয়ে স্থানীয় একজন ডাক্তারকে দেখাতে গেলে তিনি কলকাতার একজন বিশিষ্ট চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সহৃদয় প্রতিবেশী যুবকটি ডাক্তারবাবুর চেম্বারের রিসেপশনে কথা বলে ওনাকে নিয়ে কলকাতায় যাওয়ার সব ব্যবস্থাও করে ফেললো। 
    নির্দিষ্ট দিনে খুব ভোরে ঐ যুবকের সঙ্গে ভদ্রমহিলা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। চেম্বারে যখন পৌঁছলেন তখন ডাক্তারবাবু রোগী দেখা শুরু করে দিয়েছেন। প্রচুর ভীড়, যদিও আগে থেকেই অনলাইনে নাম এন্ট্রি করা ছিল, তবুও সিরিয়াল নাম্বার হয়েছে একুশ। গাড়িতে যেতে যেতেই অসহযোগি রাস্তায় জার্নির ধকল নিতে তিনি অপারগ ছিলেন। তাই সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেই তিনি আরও দুর্বল হয়ে একেবারে নেতিয়ে পড়লেন। যদিও বারবার রিসেপশনে বলা সত্ত্বেও তাড়াতাড়ি দেখানোর কোন ব্যবস্থা করা যায় নি, কারণ তাদের বক্তব্য, আগে যে সকল রোগী আছে তারা আপত্তি জানাবে। তবুও যখন সতেরো নম্বর চলছে তখন অন্যান্য রোগীদেরকে অনুরোধ করে ভদ্রমহিলাকে নিয়ে চেম্বারে ঢোকার সহযোগিতা পাওয়া গেল। 
    ঝাঁ চকচকে, খুব সাজানো গোছানো, একটা সুগন্ধির সুবাস নাকে এগিয়ে আসছে, এইরকম একটা অত্যাধুনিক সাজানো-গোছানো চেম্বারে যুবকটি ভদ্রমহিলাকে পাঁজাকোলা করে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারবাবু হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘মা, কেমন আছেন? বলুন আপনার কি সমস্যা? চিন্তার কিছু নেই, আপনি ঠি-ক সুস্থ হয়ে উঠবেন। ঐখানে শুইয়ে দিন।’’ যুবকটি ভদ্রমহিলাকে বেডে শুইয়ে দিল। ডাক্তারবাবু বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখলেন, চেম্বারে যে সকল পরীক্ষা করা সম্ভব, যেমন ই সি জি, প্রেশার চেক ইত্যাদি পরীক্ষা করে চেয়ারে বসলেন। এদিকে ভদ্রমহিলার শরীর ধীরে ধীরে আরও নিস্তেজ হয়ে আসছে। যুবকটি তখন বলল, ‘‘ডাক্তারবাবু, উনি তো বোধহয় শরীর ছেড়ে দিচ্ছেন...’’, ডাক্তারবাবু তখন অতি তাড়াতাড়ি প্রেশক্রিপশন করতে শুরু করলেন। সেখানে প্রয়োজনীয় তথ্য এবং ঔষধের নাম লেখার পরে
—আচ্ছা ওনার নাম বলুন।
—অহল্যাদেবী চৌধুরী।
শুনেই ডাক্তারবাবুর কলমটা থেমে গেল। নাম লেখার আগেই আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘বাড়ি কোথায়?’’
যুবকটি বললো, ‘‘সাহেবপুর’’।
সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। 
‘‘মা আ আ ... ’’ বলে চিৎকার করে বেডের কাছে চলে গেলেন। ততক্ষণে ভদ্রমহিলা দেহ ছেড়ে দিয়ে ওপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। ডাক্তারবাবু আবার ‘‘মাআআআ —’’ বলে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করলেন। তাঁর সেই চিৎকারে সমগ্র চেম্বার এবং তার বহির্বিভাগ মুখরিত হয়ে উঠলো। সকল রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়রা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। সকলেই সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, কিন্তু কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছেন না। 
    ডাক্তারবাবুর আবার একইরকমভাবে চিৎকার...‘‘মা, মা, আমি তোমার সেই কুলাঙ্গার ছেলে, যে ছেলে তোমার কষ্ট করে উপার্জন করা টাকায়, তোমার অতি যত্নে, অতি স্নেহে, অতি ভালোবাসায়, অতি মমতামাখা আদরে আজকে শহরের একজন নামকরা ডাক্তার হতে পেরেছি, কিন্তু মা, আমি ‘মানুষ’ হতে পারি নি। তোমার প্রয়োজনমতো সব টাকা আমি তোমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিই, কিন্তু তোমার প্রতি ভালোবাসা, তোমার প্রতি আমি কোনরকম শ্রদ্ধা দেখাতে পারি নি। যার জন্য আজ তোমাকে বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে হলো। মা ... তুমি কোনদিন আমাকে যেন ক্ষমা কোরো না, আমি ক্ষমা চাই না মা, যে অন্যায় আমি করেছি তার কোন ক্ষমা হয় না, আর আমি ক্ষমা চাইবোও না, কারণ আমার মতো অপরাধী পৃথিবীতে আর একটাও নেই, আমি কুলাঙ্গার, আমি একজন সুমাতার একটা অপদার্থ সন্তান। মা...তুমি বেঁচে থাকতে আমি যে কাজ করতে পারি নি, ভবিষ্যতে মানুষের সেবার মাধ্যমে সেই কাজ করার চেষ্টা করবো। তুমি আমাকে সেই কাজ করার সুযোগ দিও, তুমি আমাকে সেই কাজ করার শক্তি দিও মা...’’
    প্রচণ্ড হাহাকারে আরও একবার চারিদিক মুখরিত ও আন্দোলিত হয়ে উঠলো, আর ছেলের মাথা মায়ের বুক ঠেকিয়ে চোখের জলে ভেসে যেতে লাগল।




      এই সংখ্যায় অনিবার্য কারণে ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হবে না।




এবারও ইলশেগুঁড়ির মুদ্রিত শারদ সংখ্যা
সাহিত্য সংখ্যা হিসাবে প্রকাশিত হবে পুজোর অনেক আগেই






প্রকাশের পথে গোয়েন্দা উপন্যাস 

ইলশেগুঁড়ি প্রকাশনের প্রথম কবিতা সংকলন সাজি এখন পাওয়া যাচ্ছে।





ইলশেগুঁড়ি-র একরাশ শুভেচ্ছা 

বসিরহাট থেকে প্রকাশিত

বিবস্বান পত্রিকার ২৫ বছরে পদার্পনে।




প্রকাশিত হল ইলশেগুঁড়ি প্রকাশনের প্রথম ই-বুক




প্রিয় পাঠক, আপনার মতামত আমাদের কাছে মূল্যবান।

ilseguripatrika@gmail.com

4 comments:

  1. নিঃসন্দেহে অসাধারণ এক ই পত্রিকা। অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইল। এত সুন্দর চিন্তা ভাবনা যাদের,তাঁরা কেন শুধু ই পত্রিকায় সীমাবদ্ধ থাকবেন। মুদ্রিত আকারে কি প্রকাশ করা যায় না?ধন্যবাদ সহ,,,,,,

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আপনাকে। ইলশেগুঁড়ি মুদ্রিত পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যাতেই মুদ্রিত শারদ সংখ্যার বিজ্ঞাপন রয়েছে। ভাল থাকবেন।

      Delete
  2. Khub khub valo. Kobita, golpo prottekti osadharon.

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ সুধী পাঠক। সঙ্গে থাকুন।

      Delete

Theme images by luoman. Powered by Blogger.