Header Ads

Header ADS

ইলশেগুঁড়ি অনলাইন পত্রিকা ১৮






ছবি ঋন - আর্ন্তজাল

মানবেতর জীবন আখ্যান

সৌমেন দেবনাথ


এই না হলে বস্তী? ভোরের কিঞ্চিৎ আলো উঁকি মারার পূর্বেই বড়রা কাজ সেরে মোটামুটি নিশ্চিন্ত। ছোটরা এবার ব্যস্ত। সারি দিয়ে ট্রেন রাস্তার পাশে বসে পায়খানা করছে। পেছনে দু চারটে কুকুর অপেক্ষায়। 
    লুঙ্গি জামা কোনো রকমে পরে বদরুল বললো, আইজ্জা ফিররা যদি হুনছি তুই কাইজ্জা করছত, তয় তোর  মাথার চুলডি ছিররা শাক রাইন্দা খামু।
    বৌ নীরব থাকার না। জবাব দেয় বলেই মার খায়৷ সারাদিন কান্না করে, যাকে পায় তাকেই স্বামীর নিষ্ঠুরতার কথা শুনায়। আজ অবশ্য কিছু বললো না। শুধু বললো, দেইখা শুইনা রিসকা চালায়েন।
    বদরুল রিক্সা নিয়ে বাজারে গেলো। আরো দশ পনেরটা রিক্সা চলে এসেছে। সেই তুলনায় যাত্রী নেই। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিক্সা নিয়ে ওরা। রিক্সাগুলো দেখতে সুন্দর ও রঙিন হলেও রিক্সাওয়ালাদের জীবন সুন্দর ও রঙিন নয়। ভরদিন হাড়ভাঙা খাটুনি। এই একটা পেশা যেখানে ফাঁকি চলে না। গন্তব্যে যাত্রী না পৌঁছে দেয়া অবধি কোনো বিশ্রাম চলে না। শহর আলীর পঞ্চাশটার বেশি রিক্সা আছে। তাঁরই কাছ থেকে বদরুল রিক্সা ভাড়া নিয়েছে। দৈনিক দুইশত টাকা ভাড়া দিতে হয়। এক যাত্রী বদরুলকে হাত ইশারা করে ডাকলেন, যাবি?
    বদরুল বললো, যামু। তয় আপনি আমারে তুই কইয়া ডাক পাড়লেন?
    যাত্রী রেগে বললেন, খাস তো রিক্সা টেনে। আবার সম্মান চাস? 
    বদরুল কথা না বাড়িয়ে বললো, কই যাইবেন?
    যাত্রী বললেন, নৈচাপুর।
    বদরুল বললো, তিরিশ ট্যাকা লাগবো। তেল চাইলের দাম বাড়ছে। 
    যাত্রী বদরুলকে ঠাস করে এক চড় মেরে বললেন, আমার বেতন বেড়েছে?
বদরুলের মুখটা অন্ধকারে ভরে গেলো। রিক্সা চালায় বলে ও যেন মানুষই না। অন্যের হাতে মারও খায়। মুখ নিচু করে যাত্রীর দুটি ব্যাগ রিক্সায় তুললো আর বললো, কুলির কামও কইরা দেওয়ন লাগে, দুইডা ট্যাকা ধইরা দ্যান?
    যাত্রী বললেন, অভাবে তোর স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। মুখ বন্ধ করে রিক্সা চালা।
    নৈচাপুর এসে গামছা দিয়ে মুখ মুছলো বদরুল। নাক ঝাড়লো। হাফ ধরে গেছে। ঘৃণায় যাত্রী ওর মুখের দিকে তাকালেনই না। বিশ টাকার একটা নোট বের করে দিলেন। টাকাটা ছেঁড়া। বদরুল বললো, বাই, ট্যাকাটা বদলাইয়া দ্যান।
    যাত্রী রেগে গেলেন। বললেন, ভাই বললি কেন? আমাকে কি তোর ভাইয়ের মতো মনে হচ্ছে? প্যান্ট, টাই, কোট দেখছিস না?
    বদরুল মুখ নিচু করে থাকলো। লোকটি চলে গেলেন। সেখানে পরিচিত দু তিন জন রিক্সাওয়ালা ছিলো। তারা কথা বলছে। বদরুল শুনছে। টিপু বললো, কত হইলো নায়ক বাই?
    রাজ্জাক বললো, পাইচিলাম এক বেক্কল পাচেনজার, বিশ ট্যাকার জায়গায় আশি ট্যাকা লইচি।
    আব্বাস বললো, মারছত। গলা কাটছত তার। তোগো লইগা বেবাক রিকসাওয়ালাগোর বদনাম রটে। হারাম খাইসনারে। আক্কাস, তোর খবর কি?
    আক্কাস বললো, শৈলডা ভালা না। বল নাই রিসকা টাননের। গাছতলাত ঘুমাইচি। 
    চুপ করে বদরুল সব শুনলো। সন্ধ্যা বেলা ঘরে ফিরে এলো। পাখিদের মতো কিচিরমিচির করছে বস্তীর বাচ্চাগুলো। জরিমন বললো, আপনের বড় পোলারে আইজ্জা নইজা বুড়া মারছে। খেত থেইক্যা বলে কি চুরি করতাছিলো।
    বদরুল রেগে বললো, মাইরা ফালাই না ক্যান? চিন্তা কমতো।
    ছোট ছেলেটা গুড়গুড় করে মায়ের কোলে ঠেলে উঠে নিজের উদর ভর্তির সন্ধান করে। ছোটর বড়টাও কাছে এসে বায়না ধরে। মা বলে, বড় হইছত, খেলগা।
    এমন সময় ওদের মাঝে নছিমন বিবি এলো। মনের জমিন বর্গা দিতে দিতে চেহারায় আর সেই আগের জৌলুস ভাব নেই। তাতে কি! সূর্য যতই আলো বিলাক তার কি আলোর ঘাটতি পড়ে! শারীরিক ছলাকলা দেখিয়ে দেখিয়ে প্রচুর কামাই রোজগার করছে৷ বদরুল একবার তাকিয়ে নজর ফিরিয়ে আবার তাকালো। অগ্নি দাহ্য বস্তুর অভাবে প্রজ্জ্বলিত হতে পারে না, নছিমন বিবি যেন বদরুলের সামনে দাহ্য বস্তুই। তার বিকশিত সৌন্দর্য বদরুলের চোখ, নাক, কান, গালে দুলে দুলে যেন ছোবল মারলো। পান খাওয়া লাল ঠোঁট-জিহ্বা থেকে কথা বের হচ্ছে না, যেন অমৃত ঝরছে। বুকের বসন ঠিক নেই, ঠিক রাখেও না ও। এত কামগন্ধময় আর কামনাময় হয়ে নিজেকে প্রকাশ করছে যে কারোরই রক্ত তার সংস্পর্শে টগবগ করবে।
    নিজেকে সংবরণ করে বদরুল বললো, কিত্তে আইছত, বাইর হ।
সে কথাতে কর্ণপাত না করে নছিমন বিবি বললো, শুকনা বৌয়ের দেহে কি সুখ পাস? যে গাছ দিনের পর দিন ফুল ফল দিতাছে তার মাঝে কি সৌন্দর্য আছে?
    জরিমন ক্ষেপে গিয়ে বললো, তুই গেলি সামনে থেইক্কা?
    নছিমন বিবি বললো, রাগোস ক্যান? কত পোলাপান পেটে ধরবি আর?
    জরিমন বললো, যে আমার পেটের ভাত জোগায় তার সন্তান পেটে ধরি, তোর কি তাতে?
    নছিমন বিবি হেসে বললো, মাইয়া দুইডা তো ডাগর হইয়া উঠছে, নজরে পড়ে। শাড়ি পরা শিখাবি না? দিয়া দে, লগে নিয়া যাই।
    বদরুল দম করে দাঁড়িয়ে উঠে নছিমনকে বললো, বাইর হ বেশ্যা বেডি। বাইর হ।
    নছিমন বিবি উঠতে উঠতে বললো, শুকনা বৌয়ের হাড্ডির গুতায় মরবি, যাইস আমার কাছে, রসের কথা কমু।
    জরিমন বললো, ঝাটা হাতে নিয়া বেহায়াডারে পিডায়ে দ্যান।
    বদরুলকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে নছিমন চলে গেলো, দর কষাকষি লাগবো না, উপযুক্ত কড়িও দেওন লাগবো না। যাইস, বুকের জমিন দিমু, জল খাবার দিমু। কাঁথার তলে গরম চা খাওয়ামু।
    বলেই একগাল হাসি দিতে দিতে চলে গেলো। ওষ্ঠপ্রান্তের ও হাসিতে কোন মায়াবী ভাব নেই, চাতুরীতে ভরা।
    পরদিন বদরুল রিক্সা নিয়ে বাজারে গেলো। কত শৌখিন মানুষ তার রিক্সায় উঠে, অথচ তার জীবন কত অবহেলার। একজন যাত্রী এলো। তিনজন রিক্সাওয়ালা তাকে ডাকছে। যাত্রী পড়ে গেছে বিপদে। শেষে বদরুলের রিক্সায় এসে উঠলো। বদরুল কেতুনগরের উদ্দেশ্য রিক্সার প্যাডেল মারতে শুরু করলো। যাত্রী বললো, আপনার জামাটা তো ছিঁড়ে গেছে।
    বদরুল বললো, শরীলডা হুদা ঘামে। কোনো জামা টিকে না। ট্যাকা নাই গাইটে। ছয় ছয়ডা পোলাপান। বাইত চাইল লইয়া গেলে তারা খাইবো।
    যাত্রী বললো, এতো বাচ্চা নিয়েছেন কেন?
    বদরুল চুপ থাকে। যাত্রী নামলেন। পঞ্চাশ টাকার নোট বের করেছেন। বদরুল বোকার মতো চেয়ে বললো, ভাংতি নাই, বাই।
    যাত্রী ভাঙিয়ে দেবে বলে ভিড়ের মধ্যে এক দোকানে গেলো, কিন্তু আর ফিরে এলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বদরুল বললো, আমার পেটে লাত্থি মারলেন এমনে?
    মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো বদরুলের। গাছতলায় বেশ কিছুক্ষণ মনমরা হয়ে ও বসে থাকলো।
    সন্ধ্যায় এক যাত্রী জুটলো। বস্তীতে আসবে। ঘরে ফেরার সময় হয়ে গেছে তাই এই যাত্রীকে পেয়ে খুব খুশী হলো বদরুল। বদরুল বললো, বস্তীতে আমার ঘর। আপনারে তো চিনলাম না!
যাত্রী ইতস্তত করলো কিছুক্ষণ। বুঝে গেছে বদরুল। বললো, নছিমনের কাছে যাইতাছেন? মাইনসে জানলে কলঙ্ক লাগবো না?
    যাত্রী বললো, কাঁঠাল খাইলে আঠা লাগবো। আঠার ভয়ে কাঁঠাল খাওয়ন বন্ধ করে কেউ?
    বদরুল আপন মনে রিক্সা টেনে চলে এলো। যাত্রী দুটো টাকা ধরে দিলো। বদরুল বললো, বেশি দ্যান কেন?
    যাত্রী বললো, কাউরে কইয়ো না, বাইত গিয়া বৌয়ের লগেও কওনের দরকার নাই।
    বদরুল মাথা নিচু করে ঘরে ফিরলো, পরিবেশটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারলো। ছেলে মেয়ে নিয়ে বসবাস করা কঠিন হয়ে উঠবে ভেবে চিন্তিত হলো।
    জরিমন খেতে দিলো। আর বললো, বস্তীতে নতুন নতুন বেডা মানুষ কোত্থেকে আয়ে?
বদরুল উত্তর না করে খাওয়া শেষ করতে ব্যস্ত হলো।
    ঐ মুহূর্তে মশিউরের বৌ মরিচ নিতে এলো। কিন্তু মরিচ থাকলেও জরিমন দিলো না। বললো, নাই।
    মশিউরের বৌ বললো, তোর ঘরে থাহে কি? রিক্সা চালাইলে কি সংসার চলে?
    বদরুল হিংস্র প্রাণীর মতো চেয়ে বললো, তোর হায় মশিউরে কি করে? চারকি?
    মশিউরের বৌর উত্তর করার আগেই জরিমন বললো, আমার হাইয়ে রিক্সা চালায়। রোজগার করে। তোর হাইয়ে তো তাস খেলে, গানজা খায়।
    মশিউরের বৌ বললো, আমার হায় রাজনীতি করে। তাই বন্ধুগো লগে তাস খেলে, গানজা খায়। আমার ঘরে চাইল আছে, ট্যাকা আছে। আছে তোর?
    জরিমন বললো, গরীব মাইনসের হক তোর হায়য়ে মাইরা কাইট্টা আনে। গোণ্ডাগিরি করে, মেম্বর সাবের চামচা।
    মশিউরের বৌ বললো, বরো মাইনসোগো লগে মিশশা থাকলে হেইডা চামচা হয়রে হিংসুইটা?
বদরুল জরিমনকে থামতে বললো, জরিমন থামলো না। জরিমন ক্ষিপ্ত হয়ে মশিউরের বৌকে বললো, এত সুকের সংসার, মরিচ নিতে আইচত ক্যান?
    মশিউরের বৌ বললো, বদু বাই, দেখচেন আপনের বৌ কেমনে আমার লগে কাইজ্জা করে?
    দরুল জরিমনকে চুপ থাকতে বললো, জরিমন সে কথায় কান না পেতে বললো, আমার হায়য়ের কাছো আবার নালিশ দ্যাস? এই মুখপোড়া বেডা, আপনের সামনে আপনার বৌরে যাচ্ছেতাই কইতাছে, হুনতাছেন না?
    বদরুল ভাত খাওয়া বন্ধ করে বৌর চুলের গোছা ধরে বললো, কাইজ্জা করস ক্যান? খাইয়া কি তর হুদা কাইজ্জা করনের কাম?
    মশিউরের বৌ বললো, বদু বাই, বেডির থোতাত মারেন। বেবাক মাইনসের লগে হেইতে লাগে। পোলাপানডির খোঁজ রাহে না।
    যতক্ষণ পারলো মরণপ্রায় বৌটাকে মারলো বদরুল। তখন নছিমন বিবি এলো। এসেই বললো, বুঝিরে বদু তোর মনের জ্বালা। তর যৌবন থাকতে তর বৌ হইয়া গেলো বুইরা। জানি তো কোন জ্বালাত মরস।
    বদরুল বললো, আমার ঘরে ক্যান আইছত? চইলা যা।
নছিমন বিবি মশিউরের বৌ আর বদরুলের বৌর দিকে তাকিয়ে বদরুলকে বললো, নিজ ঘরে তো অনেক খাইছত, একদিন আমার ঘরে খা। বাত্তি হইয়া গেছি? ডেগা লাগবো? আছে। 
    তারপর কৌণিক চোখে চেয়ে বললো, বাত্তি ফলে মাছি উড়ে বেশি কিন্তু! তুই দেকি বড্ড বোকা!
    বলেই একগাল হাসলো নছিমন বিবি। মশিউরের বৌ বললো, বদু বাই, এই বেডি শেষ কইরা দিলো বস্তিটারে।
    বদরুল কিছু বলতে যাচ্ছিলো। নছিমন বিবি থামিয়ে দিয়ে বললো, রোজগার তো কম করলি না। সঞ্চয় কিছু করছত? আমার ঘরে যাইস। পুষ্পশয্যায় শুয়াইয়া সুক ঢাইলা দিমু। এত লজ্জা করস ক্যান? কত বড় বড় ব্যবসায়ী আহে, তুই তো কিয়ের রিক্সাচালক। তোরে যে ডাহি, এই তোর কপাল।
    বদরুলের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলো। এমন আহ্বানে যেকোন পুরুষই কাবু হয়ে যাবে। জরিমন আর মশিউরের বৌ মিলে নছিমন বিবিকে তাড়িয়ে দিলো, ঠিক যেভাবে কুকুর তাড়ায়।
মশিউরের বৌ বললো, জরি, মিলমিশ করে না থাকলে আমাগো বেডাগো সামলাইতে পারমু না কিন্তু। বস্তি থেইকা এই বেশ্যারে তাড়াইতে হইবো।
    বদরুল ঘরে যেয়ে ঘুমালো। যে আগুন নছিমন বিবি জ্বেলে গেছে তাকে তা অস্থির করে রেখেছে। বৌ ঘরে ঢুকতেই বাজপাখি হলো সে।
    এভাবে চলতে থাকলো জীবন। দুটো স্কুল ছাত্রীকে নিয়ে বদরুল রিক্সা ছেড়েছে। সে নিজের থেকেই বললো, আমারও দুইডা মাইয়া আছে। ইশকুলে দেবার পারি নাই। পেটের ভাত দিতে পারি না, ইশকুলে কেমনে দিমু?
    এক ছাত্রী বললো, আপনাদের মতো রিক্সাওয়ালাদের দুঃখে আর ব্যথিত হবো না। এমন কথা বলে বলে দুটো টাকা বেশি নিতে চান।
    বদরুল বললো, মাগো, ইশকুলে যারা পরে তাগো কাছ থেইকা আমি দু এক ট্যাকা কমই লই। কিন্তু যারা চারকি করেন তাঁরা তো আমাগো দু এক ট্যাকা বেশি দ্যান না! মাগো, দুক্কের কপাল নিয়া জন্মাইছি। আমাগো ঘৃণায় করো।
    ছাত্রী দুটি আর কোনো কথা বললো না। ওরা যা ভাড়া তা দিয়ে নেমে চলে গেলো। দুটি কবুতরের বাচ্চার দিকে বদরুল চেয়ে থাকলো। আর নিজের অভাগী দু মেয়ের কথা ভাবতে লাগলো। 
    রিক্সা টানলে শরীরে আর শক্তি থাকে না। খালি রিক্সা তাও টেনে নিয়ে যাওয়া ওর জন্য অনেক কষ্টের। তখন এক যাত্রী বললেন, এই যাবি?
    বদরুল না সূচক মাথা ঝাঁকালো। তখন গলা বাজিয়ে যাত্রী সাহেব বললেন, যাবি না কেন? তেল জমে গেছে? কাঁচা টাকা ইনকাম তো! যা বের হ।
    এমন কথা শুনে শুনে সব সয়ে গেছে। বদরুল কান্না করতে চায়, কান্না করতে পারে না। বড় হলে এই সমস্যা।
    উঁকুন বাছা বিকেল বেলায় মশিউরের বৌ বদরুলের বৌর মাথার উঁকুন বেছে দেচ্ছে। ট্রেনের নিচে সেজ ছেলেটা পড়তে যেয়েও পড়েনি। দৌঁড়ে এসে মায়ের কোলে লুকায়। বুকটা তার ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। বদরুল বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ সেই যাত্রীর সাথে দেখা। আজও সে নছিমনের কাছে আসবে। বদরুলের রিক্সায় উঠলো। বদরুল বললো, বিয়া করেন না ক্যান?
যাত্রী বললো, অল্প ট্যাকাত অনেক মজা। 
    বদরুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, পাপের বোঝা ভারি করতাছেন ক্যান?
    যাত্রী বললো, নিষ্পাপ কেডা?
    বদরুল চুপ করে রিক্সা টানতে লাগলো। আজও ভেবেছিলো বাড়তি টাকা সে পাবে। পেলো না। বরং হুমকি পেলো। যাত্রী বললো, কাউরে জানাইবেন না। কেউ যদি জাইন্না যায় তবে বস্তীতে রটাইয়া দিমু আপনে আমারে ঠিকানা দিছেন। আপনে দালাল।
বদরুল দাঁতে জিহ্বা কেটে চুপ হয়ে গেলো। ঘরে এলো। সেজ ছেলের বিপদের কথা শুনামাত্রই বৌকে বকলো, করছ কি বাইত? পোলাপানডি দেখস না কেন? গতর দেখস? গতরে তোর মরিচ গুঁড়া দিমু। 
    মুখ বুঝে থাকে জরিমন। মরার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ছেলেকে বুকে করে বসে থাকে বদরুল। বাচ্চাদের প্রতি এত দরদ জরিমন আজ তা প্রথম দেখলো। ভাত দিয়ে জরিমন বললো, লন, ভাতডি খান।
    একটি কুকুর এসে দাঁড়িয়ে আছে। জরিমনকে গরম দিয়ে বদরুল বললো, কুত্তাডারে খেদাস না ক্যান?
    ছেলেমেয়েদের মুখেও তুলে তুলে খাওয়ায়ে দিলো। বড় মেয়েটা বললো, বাজান, রূপকথার গল্প হুনাইবা? নছিমন কাকী আমারে কোলে বসাইয়া রূপকথার গল্প শোনাইছে। নতুন জামা কিননা দিবো কইছে।
    ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিলো বদরুল। বললো, তুই নছিমনের ঘরে গেছিলি?
    আব্বার রাগ দেখে বড় মেয়ে চুপ হয়ে গেলো। জরিমনকে ডেকে বললো, তোর বড় মেয়ে নছিমনের ঘরে যায় কেমনে? দেইখা রাখস না ক্যান?
    জরিমন বললো, কইডারে আমি দেইখা রাখমু? সারাদিন পাগল হইয়া যাই পোলাপানের জ্বালায়।
    ছেলেমেয়েগুলোকে বোঝাতে লাগলো বদরুল। কারোর বাড়ি যেতে মানা করলো। মাকে সারাদিন কাজে সাহায্য করতে বললো। 
    মেজ মেয়ে বললো, তয় আমাগো দুই বইনের দুইডা লাল জামা কিননা দিবা?
    মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বদরুল বললো, দিমু। ঈদ আয়ুক।
    ঈদ আসতে কত দেরি, তা শুনেই মেয়েদের মুখে হাসি ফুঁটলো। মনে মনে গুমড়ে কাদতে লাগলো বদরুল।
    পরের দিন নছিমন বিবি পান খেতে খেতে মশিউরের বৌর কাছে এলো। মশিউরের বৌ নছিমন বিবিকে তিরস্কার করে বললো, দূর হইয়া যা বদমাশ বেডি। তোর লইগা মেম্বর সাব আমাগো উচ্ছেদ কইরা ছাড়বো।
    নছিমন বিবি বললো, দূর দূর করতাছস ক্যান? তোর মর্দা তো আমার কুঁইড়াঘরে হান্দায় না।      তরুণ তরুণ যুবকরা আহে। এইডা একটা সমাঝ সেবা বুঝলি বেডি। সমাঝে ইভটিজিং, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ এডি হইবো না। মশিউরের বৌ বললো, দূরে কোথাও যাইয়া ব্যবসা খুল। আমাগো ভিটা ছাড়া করিস না।
    নছিমন বিবি বললো, মেম্বর ঘর ছাড়া করবো ক্যান? মেম্বর বকবোই বা কেন? তাঁর পোলাপান তো দিনে তাঁর পিছে, রাইতে আমার সামনে।
    তখন বদরুলের বৌ এলো, বললো, তোরে না কইছি এদিকে আইবি না?
    নছিমন বিবি সব কথার উত্তর না করে বললো, ও বেডি, তুই তো দেহি আবার পোয়াতি হইছস! এত বাচ্চা ন্যাস ক্যান? ছয়ডা বাচ্চারে তাই খাইতে দিতে পারস না। তোর হায়য়ে তো আচ্ছা পুরুষ! তোর দেহ থেইকা এত সুক ন্যায়?
    বদরুলের বৌ রেগে বললো, তুই দূর হবি সামনে থেইকা? ঝাঁটা দিয়া মুখ খুঁচায়া দিমু?
    নছিমন বিবি বললো, বেডি, এত রাগস ক্যান? তেজ কমে না ক্যান? আমি তো প্রতি রাইতে পুরুষের সময় দিই, আমার তো বাচ্চা বাঁধে না পেটে! বাচ্চা নিতে নিতে বস্তীডারে যে ভরাইয়া ফালালি। শরীর গরম হইলে তোর মর্দাডারে আমার কুঁইড়াঘর দেহায়া দিতে পারস না? মনের রস মিটাইতে গিয়া দেহডারে তো শেষ করলি। পোলাপানডিরে পালবি কেমনে? 
    মশিউরের বৌ বললো, যাবি, না ঝাঁটা নিমু?
    নছিমন বিবি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে হাসতে চলে গেলো। পথে মশিউরের সাথে দেখা। বললো, তোর বন্ধুরা তো আমার কুঁইড়াঘরে আয়ে যায়। যাস না কেন? ঘরে বৌ দেইক্কা?
    মশিউর বললো, নিজে দাওয়াত না দিয়া দুইডা দালাল লইয়া ল, বেশর্মা।
    নছিমন বললো, এক ডাল দিয়া কত দিন ভাত ভালো লাগে ক? তোরা এলাকার বেডা। তোরা গেলে বিক্রি হমু নামমাত্র মূল্যে। আইস, ভোগ যতই করস দেখবি উপভোগ শেষ হইব না।
মশিউর রেগে প্রস্থান করলো, নছিমন থেমে থাকলো না। শুনিয়ে বললো, আইস কিন্তু যে কোন দিন। কোন নির্দিষ্ট বার নাইগা আমার কাছে। প্রতিদিনই বেডা ছেলের স্পর্শ লই আমি। মাছের দামে পুকুর পাবি।
    নছিমন তারপর নিজ মনে বলতে বলতে চলে গেলো, যাওনের লইগা মন দৌঁড়ায়, বিবেকরে দোহায় দিয়া সাধু সাজে!
    ওরা কয়েকজন রিক্সাওয়ালা গল্প করছে। বদরুল নিশ্চুপ। আক্কাস বললো, চুপ ক্যান? 
বদরুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, বৌয়ের পেটে আবার বাচ্চা আইছে। 
    আব্বাস হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো, বৌ পোয়াতি হইছে? মিষ্টি খাওয়াবি না?
    বদরুল নির্লিপ্ত নয়নে বললো, ছয় ছয়ডা পোলাপান। সংসার চলে না। থাকনের জায়গা নাই।     আবার নতুন মুখ আসতাছে। গলায় দড়ি দিমু? মিষ্টি খাইতে কেমনে চাস? সুকের সন্তান? 
    রাজ্জাক বললো, মাগার, সন্তান নিস ক্যান? সারাদিন রিক্সা চালাস। রাইতে না ঘুমায়া বৌর পিছে লাগছ ক্যান?
    বদরুল দ্বিতীয় বার দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, কেমনে কি ঘইট্টা যায়, বুঝি না।
    আব্বাস বললো, তোর বৌর জমিটা উর্বর। ফসল ফলতেই আছে।
    বদরুল বললো, টিটকিরি কাটিস না। বুকটা ফাইট্টা যাইতাছে।
    টিপু বললো, তোগো বস্তীতে বলে কি কাহিনি হইতাছে রাইতে?
    বদরুল অস্বীকার করার চেষ্টা করলো, কি কস? কই পাস এ সব কথা? 
    টিপু বললো, দুইডা যাত্রী বেশি টানলেই তো রাইতের খরচা বারাইয়া যাইবো! 
    বদরুল বললো, যার মনে যা চায় করগা। চাঁদ মুখো চুমা দিবি, না সাপের মুখের বিষ নিবি যার যার ব্যাপার।
    টিপু হেসে বললো, দেখায়া পরিচয় করাইয়া দিবি? দিমুনে কিছু ট্যাকা।
    বদরুল রেগে গেলো, বললো, আমারে কি দালাল পাইছত? কমিশন দিতে চাস? যা যা ঠিকানা লইতে লইতে যা, বেশর্মা কাম করবি, শরম করে ক্যান? 
    বিড়ি বের করে বদরুল টানতে লাগলো। মাথা গরম হয়ে গেছে। ঐ সময় একটি ছেলে ও একটি মেয়ে এলো। ওরা পার্কে যাবে। ছেলেটি গরম দিয়ে বললো, মুক্ত খোলা বাতাসে বিড়ি টানছেন কেন?
    বদরুল বললো, বিড়ি টানলে একটু বল পাই বাজান। 
    বদরুল বিড়ি ফেলে দিয়ে যাত্রীদ্বয়কে নিয়ে পার্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো, বললো, পার্কে যাইবেন ক্যান? শুনছি হেনো খারাপ কাম হয়।
    যাত্রীদ্বয় পরস্পর পরস্পরের সাথে কথা বলছে। বদরুলের কথার উত্তর করার সময় নেই। বদরুল বুঝতে পারলো রিক্সাতে বসে তারা ভাল কাজ করছে না। রিক্সা থামিয়ে বললো, নামেন। যান। বেদ্দাব সব।
    মেয়েটির চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। বদরুল বললো, মা, লেকাপড়া শিখখা মানুষ হও। ইজ্জত বিলায়া দিও না। মানুষ যেইডা ভালা বলবো হেইডা কইরো। 
    ছেলেটি রেগে বললো, পেটে দুকানি বিদ্যে আছে? জ্ঞান দেন যে! 
    বদরুল বললো, ব-কলম আমি। তয় ইজ্জত রাইখা কাম করি। আল্লা তোমাগো মাফ করুক।
    ভাড়া না দিয়েই ওরা হাটতে হাটতে পার্কে চলে গেলো। বদরুল ভাবলো, লেকাপড়া শিখখা তো মানুষ বড় হয়। এ তো দেখি সব অমানুষ। আমার মাইয়া দুইডা লেকাপড়া শিখে নাই, তাই কি নষ্ট তো হয় নাই। যাও বাজান যাও পার্কে, কাঁধে সংসারের জোয়াল পড়লে সব মজা ছুটবো।
বাসি রুটি আর পঁচা কলা এই যোগে দুপুর পার। পেটে রোগ লেগেই থাকে।  যাত্রী নেই, সবাই বসে আছে যার যার রিক্সা ধরে। টিপু এক মহিলার দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে আছে। দেখে বদরুল বললো, মাইনসের বৌ-ঝির দিকে এমনে চাইয়া থাকোস ক্যান? 
    টিপু বললো, তুই না হয় বুইড়া হইছত, আমাগো বুইড়া হইতে দেরি আছে। ভালা কিছু দেখলে নজর পইড়া যায়।
    বদরুল বললো, ঘরে তোর মায়া-বৌ আছে। এত নিচে নামোস কেমনে?
    টিপু বললো, বৌয়ের বিষ নাই। আমি বেসামাল হইলে থামায় না কেউ। যে গতর নজর পোড়ায়তে জানে না, হেই নজর অন্য দিকে যাইবোই।
    বদরুল তীর্যক চোখে চেয়ে ওখান থেকে সরে পড়লো। 
    মেম্বারের কানে নিয়মিত ট্রেন রাস্তার বস্তীর খবর যায়। আজ নিজেই চলে এসেছেন নছিমন বিবির কাছে। মেম্বার সাহেব বললেন, কি সব শুনছি? সত্য?
নছিমন বিবি বললো, সইত্য। আপনেও আমার ঘরে আইসেন। সুক দিমু। নিম ফুলের মধু দিমু বিন্দু বিন্দু।
    প্রচণ্ড রেগে গেলেন মেম্বার। দাঁত কিটমিট করে বললেন, বেয়াদব মহিলা।
নছিমন বিবি বললো, রাইতে আইসেন। আপনের ঐ কোদাল দাঁতের কোপ বুকের মৃত্তিকায় নিঃসংকোচে নিমু।
    মেম্বার আরো রেগে গেলেন। মশিউর, রবিউল মেম্বার সাহেবের পিছন থেকে নছিমন বিবিকে দু হাত নেড়ে ইশারায় বোঝালো। যার অর্থ মেম্বারকে আমরা বোঝাব। নছিমন বিবি নিজেকে অনেকটা নির্ভার মনে করে মেম্বারের চোখে মুখে চেয়ে বললো, কি মেম্বর সাব, আমারে দেইখা কি আপনের চোখ টাটায় না? আইয়েন, যৌবনের দাবি পূরণ করমু। নিদ্রালু, তন্দ্রালু আলুথালু অঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেইলেন। গ্রাস হইয়া থাকমু, চোখ বুইজা থাকমু, যা পারেন কইরেন।
    মেম্বার সাহেব আর থাকতে পারলেন না। ফিরে চলে গেলেন। তজিমুদ্দিনের কুঁড়েঘরে গাঁজা খাওয়ার আসর বসে। তজিমুদ্দিনের চার সন্তান। একটিও বাবা মায়ের রং পায়নি। বস্তীর সবাই তাকেও ঘৃণা করে। 
    রবিউলের বৌটা এসে জরিমনকে বললো, ছাগলডা সারাদিন ডাকছে, ছুটছে, আর পাইতাছি না। 
    জরিমন বললো, দেহি নাই।
    মশিউরের বৌ এসে বললো, মন্টুর মা, আমাগো মর্দা হাসটারে দেখছোত?
    জরিমন বললো, না। দেখ তজিমুদ্দিনের গানজার আসরে, না হয় নছিমনের কুঁইড়াঘরে।
    মশিউরের বৌ জরিমনের উপর রাগ দেখিয়ে চলে গেলো। রবিউলের বৌ বললো, পোলার বাপ ওহন আমারে দাম দেয় না। রাইত কইরা ঘরে আহে।  ছাগলডার মতো হেইও কি আমার থেইক্কা ছুইট্টা গেলো?
    জরিমন বললো, বেডা মানুষ পিঁপড়ার লাহান। মিষ্টি যেই দিকে পাইবো, হেই দিকেই ছুটবো।
ওদিকে মশিউরকে নছিমন বিবির কুঁড়েঘরে আবিষ্কার করলো তার বৌ। বৌ বললো, শেষ পর্যন্ত আপনেও এই বেইজ্জতি বেডির ঘরে ঢুকছেন? লন, সুক লন। আমার ধারে আইলে আণ্ডা ছাইটা দিমু।
    মশিউর বললো, ক্ষেপছত ক্যান? খইয়ের লাহান ফুঁটতাছত ক্যান? তোরে তালাক দিমু।
    বৌ বললো, দে তালাক দে। ভালা হায় ধরুম।
    সন্ধ্যায় বদরুল ঘরে ফিরছে। টিপু নাছোড়বান্দা হয়ে দেখা দিলো। তাকে সাথে নিতেই হবে।     বদরুল রাগ দেখিয়ে বললো, রিক্সা চালাস, কোনো এলাকা তোর চিনতে বাকি? আমি লইয়া যাই কেমনে? আমার বদনাম রটবো।
    টিপু বললো, সব মাইনসের কাছে সব কথা জিগান যায়? ট্যাকা দিমু। মায়াগো লইগা জামা কিনতে পারবি।
    বদরুল বললো, আমার মায়াডি ছেঁড়া জামা পইরা থাকবো, তবুও হারামের ট্যাকা দিয়ে তাগো কিছু কিননা দিমু না।
    টিপু বদরুলের উপর ক্ষিপ্ত হলেও নিজেকে সামলে নিলো। বদরুলের সাথে না এলেও পিছু পিছু এসে নছিমন বিবির কুঁড়েঘরে যেয়ে উঠলো।
    পরের দিন মশিউরের বৌ কান্না করতে করতে চলে যাচ্ছে। জরিমনকে পেয়ে বললো, নছিমন আমার ঘর ভাঙলো। আল্লা তার উপর গজব দিবো।
    জরিমন বললো, দেখছোত পুরুষ মানুষ কিসে পাগল? 
    নছিমনকে গাল দিতে দিতে বৌটা চলে গেলো। আয়তনের স্বামী মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। অনেক কষ্টে দুই সন্তানকে মানুষ করছে। নছিমন বিবি তাকে একা পেয়ে বললো, বিয়া করবি না আর?
    আয়তন বললো, না। পুলা মায়া দুইডারে মানুষ করতে পারলে জীবন সার্থক হয়।
    নছিমন বিবি বললো, স্বামীর সোহাগ লইবি না?
    আয়তন দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, কপাল ভাঙছে আমার। সোহাগ পাওনের আশা আর করি না।
    নছিমন বিবি বললো, ভবিষ্যতে যদি বিয়া করনের লইগা মন চায় কি করবি? জানস তো, দীর্ঘদিন ক্ষেত পইরা থাকলে জঙ্গল বাঁধে। হেয় ক্ষেতে ফসল হয় না। রাতে রাতে আমার ঘরে আইবি? মেলা পুরুষ আহে। জমিডারে একটু চাষ দিয়া রাখলি এই আর কি!
    আয়তন ক্ষেপে গেলো, কি কইলি? তোর মতো বেশ্যারে আমি ঝাঁটা মারি? সমাঝ লইয়া থাহি। তুই হইলি হেয় সমাঝের কীট, উচ্ছিষ্ট। 
    নছিমন বিবি বললো, প্রতি রাতে নতুন নতুন পুরুষের ছোঁয়া লাগে শরীলে। এর যে কি মজা বুঝবি কেমনে! স্বাদের কথা ভুইলা গেছত?
    আয়তন বললো, তোর লজ্জা করে না?
    নছিমন বিবি বললো, পানিতে নামলে শাড়ি ভিজবোই, শাড়ি ভেজার ভয়ে কি রোজগারের লগে সুকও হারামু?
    নছিমন বিবি আয়তনকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেলো। সামনে বদরুলকে পেয়ে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হলো। বদরুল বললো, হাসোস ক্যান? মন রাঙাইতে চাস?
    নছিমন বিবি বললো, তুই আমার আদর খাইলি না, ভালা। কিন্তু প্রত্যেক দিন নতুন নতুন খদ্দের আইনা দেস, আমি কিন্তু দেহি। কত কইরা লস? 
    বদরুল আকাশ থেকে পড়লো। চোখ মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। নছিমন বিবি থেমে থাকলো না, বললো, তুই আমার হইয়া কাজ করতে পারোস। ট্যাকা আমিও দিমু।
    বদরুল হাত দিয়ে নিজের কান ঢেকে বললো, শেষ কইরা দিলি আমারে। আর কত ক্ষতি করবি, কত ইজ্জত লইয়া খেলবি? 
    নছিমন বিবি বললো, ব্যবসা করি আমি, বদনাম রটাস আমার। তলে তলে লাভ খাস তুই! বস্তীর সবারে জানায়া দিমু।
    বদরুল হাত জোড় করে বললো, মান সম্মান শেষ করিস না, তোর পায়ে পড়ি।
    নছিমন বললো, মাফ পাবি না। ক আমার হইয়া কাজ করবি? 
    বদরুল নিরুপায় হয়ে বললো, করুম।
    বদরুল বাড়ি এলো। নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে লাগলো। সিদ্ধান্ত নিলো যে কোন দিন এ বস্তী ছেড়ে দেবে। ওদিকে আয়তন মেম্বারকে সব কথা বলে দিয়েছে। মেম্বার পড়লেন চিন্তায়। নগ্নতার চর্চা? তিনি বড় সড় সিদ্ধান্ত নিলেন। বিকাল দুইটার দিকে এক ব্যক্তি এসে জানিয়ে দিয়ে গেলেন, কাল দশটার মধ্যে সকলকে চলে যেতে হবে। নতুবা উচ্ছেদ করা হবে। তা শুনে তজিমুদ্দিনের ঘরের গাঁজাখোরগুলো, রবিউল, মশিউর সবাই মেম্বারের কাছে গেলো। রবিউল বললো, মেম্বর সাব, থাকুম কই? যামু কই? 
    মেম্বার সাহেব বললেন, তা আমি জানি? তোদের নোংরামি সীমা লঙ্ঘন করেছে, আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
    মশিউর বললো, আপনের কাম কাজ কইরা দেই, অহন থাকনের জায়গা কাইড়া লইবেন?
মেম্বার সাহেব বললেন, তোরা কাজ মাগনা করে দিস না। কাজের বিনিময়ে টাকা দেই। তোরা এখন যা।
    মেম্বারের প্রতি সবার রাগ হয়ে গেলো। সবাই মন খারাপ করে ঘরে ফিরে এলো। একথা এখনো বদরুল জানতে পারেনি। বাড়িতে জরিমন চিন্তিত। রাত হয়ে গেছে। বদরুল ঘরে ফিরছিলো। তখন দুই যুবক বললো, পরমপুর যাবেন?
    বদরুল দেখলো অনেক ভাড়া। ও রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু পরমপুর অনেক দূর। অন্ধকার রাত ফিরবে কেমন করে? মাঝে মাঝে নির্জন পথ। লোকজনের চলাচল কম। বেশ ভূতুড়ে স্থানে যেতেই দুই যুবক ছুরি, পিস্তল বের করলো, আর বললো, চিল্লাবি না। চিল্লাইলে মুণ্ডু নিমু।     বদরুল চিৎকার করলো না। ওরা রিক্সাটা নিয়ে চলে গেলো। চেয়ে চেয়ে দেখলো বদরুল। এবার ও করবেটা কি? সোজা শহর আলীর কাছে গেলো, মামা, রিসকাটা খোয়া গেছে। 
    শহর আলী বললো, ভালা করছত। কিননা দিবি। নইলে জেলে হান্দায়া দিমু। 
    বদরুল দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, কেমনে কিনমু? কই পামু এত্ত ট্যাকা?
    শহর আলী চোখ গরম দিয়ে বললো, কেমনে কিনবি হেইডাও কইয়া দিমু? ব্যাংকো থেইক্কা     লোন নিগগা। অল্প অল্প কইরা শোধ দিবি। অহন রাইত হইছে, বাইত যা।
    বাড়ি ফেরার পথে আব্বাসের  সাথে দেখা। বদরুল বললো, আব্বাইসা, রিসকা ডাকাত নিছেগা। 
    আব্বাস হেসে বললো, ডাকাত তোরে পাইছিলো? তাও তো ভালা, ডাকাত দেখছোস। তাগো কি গোঁফ লম্বা লম্বা?
    রসিকতা করে আব্বাস চলে গেলো। নানা কিছু ভাবতে ভাবতে বদরুল বাড়ি ফিরলো না। বাচ্চাগুলো না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। জরিমন পথ চেয়ে আছে।
    সকাল বেলা কেউ কেউ মেম্বার সাহেবের বাড়ি যাচ্ছে কারণ মেম্বার সাহেবকে কারা নাকি গুলি করে মেরেছে। নছিমন বিবি বললো, বড়ো ভালা মানুষ আছিলো!
    আর কেউ কেউ রইচদের বাড়ি যাচ্ছে চোর দেখতে। গত রাতে ঐ বাড়ি এক চোর ধরা পড়েছে।


হাওয়া পাল্টে যায় 

ডঃ রমলা মুখার্জী


একটু একটু করে ঠাণ্ডা পড়তে আরম্ভ করেছে। ভোরের দিকে ঘন কুয়াশার চাদর। পর পর ক’দিন রাত্রে অনুষ্ঠান করে উপমার বেশ ঠাণ্ডা লেগে গেল। উত্তরের হাওয়া যত হু হু করে বাড়তে লাগল, উপমার জ্বরও বেড়ে চলল, গলা একদম বসে গেল। স্থানীয় এক ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে জ্বর সারল বটে কিন্তু গলার আওয়াজটা স্বাভাবিক হল না, স্বরভঙ্গ থেকেই গেল। উপমার স্বামী অর্চন চিন্তিত মুখে উপমাকে বললেন,  — "বেশ ক’দিন হয়ে গেল তোমার স্বরটা পরিষ্কার হচ্ছে না, চল একবার বড় ই.এন.টি. স্পেশালিষ্ট দেখিয়ে আসি।'’ 
— ‘'ওষুধ তো খাচ্ছি না কি? ডাক্তারবাবু তো বলেছেন সেই পুজো থেকে এই ক’মাস এক নাগাড়ে অনুষ্ঠানে গান করে ভোকাল কর্ডে চাপ পড়েছে, ও ক’দিন বিশ্রাম নিলেই দেখবে সেরে যাবে’', উপমা অর্চনের কথাটার আমল না দিয়ে বলে ওঠে।
    অর্চন নিজে গান না জানলেও সে গানের ভাল সমঝদার। তাই সে উপমাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়াতে, রেডিও, টি.ভি.তে অডিশন দেওয়াতে প্রায়ই নিয়ে যায়। লেগে থাকতে পারলে উপমার সামনে যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তা অর্চন বুঝতে পেরেছে। তাই সে একটুও সময় নষ্ট না করে বিখ্যাত এক নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করে উপমাকে দেখাতে নিয়ে গেল। বিশেষজ্ঞ উপমার গলা ভালভাবে পরীক্ষা করে বেশ চিন্তিত মুখে কিছু বিশেষ পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট-সহ পুনরায় আসার জন্য বলল। উপমা বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘ডাক্তারবাবু, আমি কি আবার গান গাইতে পারব?’’ বিশেষজ্ঞের স্পষ্টাস্পষ্টি উত্তর, ‘আগে তো প্রাণে বাঁচুন, তারপর গানের কথা ভাববেন।’ উপমা তো নিদারুণ ভাবে ভেঙে পড়ল। গানই তার প্রাণ। সেই গলাতেই কিনা গণ্ডগোল। প্রাণে বাঁচলেও গান কি আর সে কোনদিন গাইতে পারবে।
    চলতে লাগল বিভিন্ন রকম পরীক্ষা। উপমার ছেলে হিন্দোলের বয়স মোটে তিন। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। দেখছে মা কেবলই কাঁদছে, বাবার মুখও থমথমে — তার মোটেই ভাল লাগছে না। সব রিপোর্ট নিয়ে বিশেষজ্ঞের কাছে যেতেই তিনি বললেন, গলায় যে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড আছে, সেখানে টিউমার হয়েছে এবং টিউমারের প্রকৃতি ভাল নয় সেখানে ক্যান্সার হয়েছে। ক্যান্সার শুনেই তো আতঙ্কে সবাই অস্থির। উপমা তো ধরেই নিল যে সে আর বাঁচবে না। হিন্দোলের কি হবে। বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়িদেরই বা কে দেখাশোনা করবে। সেই এ সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী। অর্চন তো নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সংসারের সবকিছু পরিচালনা তো উপমাকেই করতে হয়। লোকজন কাজের আছে ঠিকই, কিন্তু একটু অসাবধান হলেই জিনিসপত্র উধাও। অর্চন কিন্তু ধৈর্য্য হারাল না; অফিসের কলিগের সাথে পরামর্শ করে সঙ্গে সঙ্গে উপমাকে নিয়ে উড়ে গেল মুম্বাই; সেখানে কিছু মাস হল অর্চনের ভাই তর্পণ একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে যোগ দিয়েছে, সেখানে উঠল উপমাকে নিয়ে। হিন্দোলকে দাদু-ঠাম্মার কাছে রেখে গেল। মাকে ছাড়া হিন্দোলের বড় একা একা লাগছে, কিন্তু উপায় তো নেই, তার মায়ের যে খুব বড় অসুখ করেছে। তাই তো তাকে ছেড়ে মা অনেক দূর যেতে বাধ্য হয়েছে। ঠাম্মার সাথে সেও ঠাকুরকে প্রার্থনা করতে লাগল যাতে তার মা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় আর বাড়ি ফিরে আগের মত আবার তাকে আদর করে। মফঃস্বল হলেও চুঁচুড়া জায়গাটা বেশ ভাল। সব সুযোগ সুবিধাই আছে। তবু অর্চন উপমার গানের ভবিষ্যতের কথা আর ছেলের আরও ভাল লেখাপড়ার জন্যে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনবে ভেবেছিল — কিন্তু উপমাই কিনতে দেয় নি। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে ছেড়ে উপমার কলকাতায় যেতে মন চায়নি। অর্চন ভাবল ভাগ্যিস সে অন্য জায়গায় যায় নি, যদি কিছু একটা হয়ে যায়, মা-বাবা তো তার মাথার ওপর রইলেন, হলেই বা বয়স্ক তবু তো হিন্দোলের সব থেকে বেশি বন্ধু ওনারাই।
   মুম্বাই-এর টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালে উপমাকে দেখানোর ব্যবস্থা তর্পণের সহযোগিতায় অর্চন শীঘ্রই করে ফেলল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা এখানে শুধু দেহের চিকিৎসাই করেন না, রুগীর মনের ওপরও যথেষ্ট নজর দেন। তারা সব রিপোর্ট ও স্লাইড পরীক্ষা করে উপমার মনে সাহস দিয়ে বললেন যে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ জায়গার ক্যান্সার অন্যান্য ক্যান্সারের মত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে না, আর সব থেকে বড় কথা এই ধরণের ক্যান্সার সেরে যায়। তবে অস্ত্রোপচার করে ঐ গ্ল্যান্ড দুটিই বাদ দিতে হবে। উপমার বয়স তো মোটে সাতাশ, তার পক্ষে এই জীবন যুদ্ধে জয়ী হবার সম্ভাবনা শতকরা একশো ভাগ। আবার উপমা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে লাগল। মৃত্যুর চিন্তায় সে তো প্রায় মরেই যাচ্ছিল। অর্চন-তর্পণও আশার আলোয় বুক বাঁধল। সঙ্গে সঙ্গেই বাবা-মাকে খবরটা জানিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত করল।
    মুম্বাই শহরটা চারদিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা, তাই শীত এখানে কম। খুব আরামদায়ক আবহাওয়া, কিন্তু এবারে এখানেও শীত ছোবল বসিয়েছে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অস্ত্রোপচারের দিন ধার্য্য হল। টানা ছ-ঘণ্টা ধরে চলল অপারেশন। তর্পণ সমানে তার দাদাকে সামলে চলছে। শীতের কাঁপুনি আর হৃদকম্পন মিলে অর্চনের অবস্থা তখন মর্মান্তিক। অস্ত্রোপচার ভালভাবেই হল, কিন্তু উপমার জ্ঞান আর ফেরে না, ব্লাড প্রেসারও খুব নামা-ওঠা করতে লাগল। সব ডাক্তাররাই ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়লেন। তর্পণও এবার ভেঙে পড়ল। তর্পণের চেয়ে উপমা মোটে একবছরের বড়। উপমার ভালবাসা তর্পণের দিদির অভাব ঘুচিয়েছিল। তর্পণরা দুই ভাই তাদের দিদি বা বোন নেই। যাও বা একজন দিদি পেয়েছিল তাকে কিনা অকালে হারাতে হবে। অর্চন তো ভীষণ কান্নাকাটি করতে লাগল। বাবা-মাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে। যাক্, সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে চোখ মেলল উপমা, কিছু বলতে গেল কিন্তু পারল না। অর্চন ভাবল, কথা বলুক না বলুক উপমা যে প্রাণে বেঁচেছে এই যথেষ্ট। ডাক্তারবাবু বললেন যে কিছুদিন পরেই উপমা কথা বলতে পারবে। দিন সাতেক পরে ছাড়া পেল উপমা। অল্প অল্প কথা বলতে পারছে। কিন্তু বেশি কথা বলা বারণ। এত যে বিশাল চিকিৎসা ব্যবস্থা অথচ খরচ সে তুলনায় সামান্যই, সাধারণের আয়ত্তের মধ্যেই। তবু অর্চনের আর্থিক চিন্তাটা কমল। কদিন তো ব্যবসা পত্তর সে দেখতেও পারে নি-আর বিরাট কিছু ব্যবসাও তার নয়-ছোটখাটো অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ।
    দেখতে দেখতে প্রায় তিন মাস কেটে গেল। শারীরিক উন্নতির সাথে সাথে উপমার স্বরতন্ত্রীরও উন্নতি ধীরে ধীরে হতে থাকল। ডাক্তারবাবুরা পরীক্ষা করে রায় দিলেন যে গলা সম্পূর্ণ ভাল, কোন ক্যান্সার কোষ নেই, স্বরতন্ত্রী একদম ঠিক আছে, সে আগের মতই আবার গান গাইতে পারবে, কিন্তু ছমাস অন্তর চেক্ আপ করাতে আসতে হবে। 
     উপমাকে নিয়ে অর্চন চুঁচুড়ায় ফিরল। বৃদ্ধ বাবাই ব্যবসাপত্তর যা পেরেছেন দেখাশোনা করেছেন। বৃদ্ধা মা হিন্দোলের পরিচর্যা করেছেন; তাঁরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বসন্তের দখিনা বাতাস নতুন জীবনকে স্বাগত জানাল, কুয়াশার কুহেলিকার অবসানে পরিষ্কার সকাল। আজ যে দোল। সব কলুষ-কালো ধুয়ে মুছে ফাগুয়ার রঙে রাঙিয়ে নেওয়ার দিন। গুরুজনের পায়ে আবীর দিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে শুভযাত্রায় এগিয়ে চলা। হিন্দোল মাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। উপমার সুরেলা কণ্ঠ গেয়ে ওঠে, ‘‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে,’’ সেই কণ্ঠে আগের মতই মধু ঝরে পড়ে।    

লড়াই

শম্পা সাহা


ট্রেনে যা ভিড়,পারলে লোকে ঘাড়ে উঠে দাঁড়ায়!লোকালগুলোর সব সময় এই হাল! তবে অফিস ফেরতা ভিড়টা দম আটকে দেয়। একদিকে মাথায়, কাঁধে, কাঁখে বড় বড় প্লাস্টিকের গামলা, বালতি, মগ নিয়ে পুরনো কাপড় কেনবার মাসিরা, অন‍্যদিকে গৃহসহায়িকা দিদিরা, কলেজ ফেরৎ স্মার্ট জিন্স পরিহিতা, সঙ্গে গলায় কানে ম‍্যাচিং দুল, সুন্দরী দিদিমণির দল! একেই বোধহয় বলে মহা মিলন ক্ষেত্র!
   তবু সব সময়ই লেডিস কম্পার্টমেন্ট আমার পছন্দের, কারণ এক তো টাইম পাস হয় সহজে, দ্বিতীয়ত পেছনে, সামনে একটু চিমটি বা অপছন্দের স্পর্শের ভয় নেই।হ‍্যাঁ, মারাত্মক স্পর্শ আছে। সে হয় পা মাড়িয়ে দেয়, কনুইয়ের গুঁতো দেয়, সেগুলো প্রত‍্যাশিত কিন্তু নোংরা ভাবনাটা দেয় না।
এই রকম এক মারকাটারি ভিড়ে বাড়ি ফিরব। সওয়ার হয়েছি কৃষ্ণনগর শিয়ালদহ ডাউন ট্রেনে। যথারীতি সিট পেয়ে, গুঁতোগাতা, কনুইয়ের খোঁচা খাঁমচা দিয়ে আমিও জায়গা করে নিয়েছি এক সিটের ধারঘেঁষে। আর মাঝে মাঝে গুঁতিয়েগাঁতিয়ে একটু একটু করে নিজের ভাগের জায়গা বাড়িয়ে নেবার তালে!
  রানাঘাট থেকে এক মহিলা উঠলেন। স্মার্ট, সুন্দরী, শাড়ি পরিহিতা,বয়স বোঝা যায় না !আন্দাজ পঁচিশ ছাব্বিশ। কানে হেডফোন, চোখ মোবাইল স্ক্রিনে, কাঁধের ব‍্যাগ সামনে নিয়ে ওই ভিড়েই দাঁড়িয়ে নির্বিকার। আজ দেখছি তেমন লাগ ভেলকি লাগ এন্টারটেইনমেন্ট এর ব‍্যবস্থা হলো না! এতোটা রাস্তা! দু বার ঘুমোবার চেষ্টা করলাম, দুবারই খোঁচা খেয়ে বাধ‍্য হলাম চোখ খুলেই রাখতে। তাই ওনাকেই স্টাডি করতে লাগলাম। মেয়ে হয়ে একজন মেয়েকে দেখলে দোষের আশা করি কিছু হবে না।
 মনযোগ দিয়ে দেখছি হলদে শাড়ি, আকাশি আঁচল,কানে ,গলায় অক্সিডাইজ গহনা, লাগছে বেশ!এত সুন্দরী অথচ আনম‍্যারেড!সিঁদুর টিদুর তো দেখছি না!উঁকি মারলাম হাতে,না!ওখানেও কিছু নেই।একবার বললাম,
-বসবেন?
-নাঃ!আমি সামনেই নাববো
বেশ মিষ্টি হেসে আবার ফোনে।আমি  স্টাডি করার নতুন টপিক খুঁজছি ,হঠাৎই একটা ফোন,না না,আমার নয় ,ওই ভদ্রমহিলার।শুনলাম বেশ হাসতে হাসতে বলছেন
-চলো,কল‍্যানী মেলায়,
-হোক রাত
-মা,আমি আর তিতলি
-আরে,আমি তো জন্মের ভবঘুরে
  এতো হাসতে হাসতে একজন মহিলা নিজেকে ভবঘুরে বলতে পারেন!ইন্টারেস্টিং।বাঁদরামি, বেয়াদবি আর অসামাজিকতায় আমি অনন‍্যা!যত অন‍্যায়, নিয়মকানুন বিরোধিতা,বরাবর আমিই সে সব করে অলক্ষ্মী, দজ্জাল এসব তকমা নিজের ব‍্যাগগত করেছি।আমার মত এরকমও কেউ থাকতে পারে?আহা!আহা!
  নিজে থেকেই গায়ে পড়ে আলাপ করলাম।
একজন মা,একজন লড়াকু মা।যিনি এক নামকরা স্কুলের দিদিমনি, একজন কলেজ পড়ুয়া মেয়ের মা।যে কোনো এক মানুষের মত দেখতে জীবের ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে,ক্রমাগত শাসন,শোষণ আর সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়েছেন!লড়াইটা সহজ ছিল না,বাধা এসেছে পদে পদে,কখনো দেগে দেওয়া হয়েছে আমার মতই ভালো ভালো পদবীতে,
-অসংসারী,উঢ়ণচন্ডী,ও ঘরের বৌ হবার মেয়ে নয়!ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি।
  প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নুইয়ে যেতে দেখতে দেখতে যে বুঝেছে, তার এই ন‍্যুব্জ মেরুদন্ড তার মেয়ের মেরুদন্ড প্রথম থেকেই বাঁকিয়ে দেবার জন‍্য যথেষ্ট।তাই আজ সব ছেড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সমাজের গালে একটা পাঁচ আঙুলের ছাপের মত!
যাকে পরিবার স্বতন্ত্রতা কেড়ে, মানসিক অবসাদের শিকার করে তুলতে চাইছিল সেই আজকে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করে বহু মানুষের বিষণ্ণতার রোগ দূর করে!
  মাথাটা নিজে থেকেই নুয়ে এল।ভাবতাম আমার লড়াই না জানি কত পাথুরে,কত কঠিন!কিন্তু ও বুঝিয়ে দিল,আমি একা নই,আমার মত হাজার হাজার মায়েরা পৃথিবীর নানা কোণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে মেরুদন্ড সোজা রাখবার জন‍্য।
ওহ্!ওর নামটাই তো আপনাদের বলা হয়নি।ওর নাম সুজাতা, সুজাতা রায়।
ঘোরের মধ্যে ছিলাম।হঠাৎ একটা ছোঁয়া
-এই আসছি!ভালো থেকো
একগাল মিষ্টি হেসে ,হলদে আকাশি শাড়িতে মূর্তিমান লড়াই নেমে গেল আমার সামনে দিয়ে এই কথাটাই আবার মনে করিয়ে
-এই লড়াইয়ে আমি একা নই,আমার সঙ্গে আছে আরো লক্ষ হাজার সুজাতারা!যারা লড়তে জানে হাসিমুখে, মাথা উঁচু করে।যতই ঝড় ঝাপটা আসুক, তাদের মুখের হাসিটা কখনো মিলিয়ে যায় না।

বড়দিন

বন্দনা কুন্ডু



          মেট্রো স্টেশনের গেটের বাইরেই মিও আমরে। আজ প্রচুর ভিড়। মস্ত এক সান্তাক্লজ আর রকমারি জিনিস দিয়ে সাজানো হ'য়েছে দোকানটা বড়দিন উপলক্ষ্যে। পাশের চায়ের দোকানের কাঁচের গ্লাসগুলো ধুতে ধুতে বিল্টু তাকিয়েছিল সান্তাক্লজটির দিকে। ও শুনেছে বড়দিনের রাতে সান্তা নাকি গিফ্ট দেয় সকলকে। কিন্তু বিল্টু তো কখনও গিফ্ট পায়নি।
          সকলে কেক খাচ্ছে। কিনে বাড়িও নিয়ে যাচ্ছে। নাহ্ বিল্টুর কেক খাবার সাধ মোটেও নেই। কাঁচের দরজার ফাঁক দিয়ে কেকের গায়ে লাগানো দামের স্টিকারগুলো দেখে, সে ইচ্ছা অনেকদিন আগেই তার হারিয়েছে। কিন্তু এবার শীতে একটা সোয়েটার যে বড় দরকার ওর। ভোর থেকে চায়ের দোকানে কাজ করে ও। খুব ঠাণ্ডা পড়েছে এবার। মালিকের ছেলের পুরানো সোয়েটারটা জোড়া তালি দিয়ে পাঁচবছর ধ’রে পরছে। সেটা আর চলছে না কোনোভাবেই। উলগুলো খুলে বেরিয়ে এসেছে চারিদিকে। 
           বিল্টুর মালিক অমলবাবু খারাপ মানুষ নন‌। ওকে স্নেহই করেন বেশ। কিন্তু ফুটপাতের চায়ের দোকানের রোজগারে নিজের বড় ফ্যামিলি চালাতে হিমসিম খেয়ে যান তিনি। তার উপর লকডাউনের পর থেকে দোকান সেভাবে চলেও না। কোনোমতে টিকে আছে। বিল্টুকে যা মাইনে দেন, তা ওর মাতাল বাবা সবই নিয়ে নেয়। বদলে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে দেয়। মাঝে মধ্যে অমলবাবু দোকান থেকে পাউরুটি, বিস্কুট খেতে দেয় ওকে। 
          লকডাউনের জন্য একটু তাড়াতাড়িই বন্ধ হয়ে গেলো মিও আমরে। মালিক গেটে তালা দিয়ে সান্তাক্লজের মূর্তিটা সাইড ক’রে গাড়ি চেপে বেড়িয়ে গেলেন। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে সব লক্ষ্য করে বিল্টু। ওদের দোকানও বন্ধ হবে এবার। কাঠের দোকানের ভিতরে সবকিছু গুছিয়ে টিনের পাল্লাগুলোতে তালা ঝুলিয়ে এগোলেন অমলবাবু। বিল্টু সান্তাক্লজটির কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখছে তার চুল, দাড়ি, গোঁফ।
           কিন্তু সান্তাক্লজের হাতে এটা কি? একটা কালো প্লাস্টিক প্যাকেট ঝুলছে সান্তাক্লজের মোজা পরা হাতে। বিল্টু প্লাস্টিকটা খুলে দেখলো রঙজ্বলা একটা পুরনো সোয়েটার আর ছোট্ট মিও আমরের বাক্সে একটুকরো পেস্টি কেক। আনন্দে প্যাকেটটা নিয়ে দৌড়ে বাড়ির পথে ছুটলো বিল্টু। সান্তাক্লজ ওকেও গিফ্ট দিয়েছে, সবাইকে দেখাতে হবে তো। 
           অমলবাবু অটোতে উঠে নিজের মনে মনে বললেন ... সমস্ত বাধা বিপত্তি অসুখ কাটিয়ে ঈশ্বর যদি সত্যি সত্যিই বড়দিন দেন, তাহলে নতুন একটা সোয়েটার কিনে দেব রে তোকে বিল্টু।।


দুগ্গারা

ঋত্বিক চক্রবর্ত্তী



    ‘কৈ রে দুগ্গা এলি নাকি?’
    ‘হ্যাঁ গো বৌদি।’
    দুগ্গা, এ লেখনীর নায়িকা। যদিও নায়িকা হলেও সে কোনো গল্পের নায়িকা নয়। এতে নেই কোনো উত্থান বা পতন, নেই কোনো ঘটনার চরম ঘনঘটা। বরং এ এক অঙ্ক বিশেষ, অংশ বিশেষ দুগ্গার জীবনের অবিচ্ছেদ্দ্য অধ্যায়ের। এ তথ্য, শুধু দুগ্গার দুর্গতিনাশের না, তার নিত্য বন্ধুর যাত্রা পথেরই। পুণ্যভূমি, দেবভূমি এ বাংলা তথা ভারতবর্ষে পুরাণ বা মহাকাব্যের ভূমিকা অবিচ্ছেদ্য ও অনস্বীকার্য। সেই কাব্যগাথা থেকেই উঠে আসা অগুন্তি চরিত্র মানুষের জীবনে ভয়-ভক্তি-শিক্ষারূপে স্থান পেয়েছে নিত্য। বর্ণপরিচয়ের মতোই দেবীপরিচয় হয় কতো অবশ্যম্ভাবী সহজতায় সাবলীল ভাবে। তৎমধ্যেই দেবী দুর্গার স্থান বাংলা ও বাঙালীর মনের মণিকোঠায়  দেবী মহাশক্তির উৎস। সমস্ত যা কিছু অশুভ, পাপ, রোগ, বিঘ্ন তার বিনাশ দেবীর হাতে । তিনি যেমন জননী সৃষ্টিকারিণী তেমনই ধ্বংসের কালীরূপী। তিনিই অদ্বিতীয়া। অবিনশ্বর তার বোধন বিসর্জনের গ্লানি মেটাতে। আমাদের মর্তের দুগ্গারাও যেন কালবিশেষে বহন করে চলেছে সে আখ্যানই। তাদের নিত্য বোধন আর বিসর্জনে।
    ‘আচ্ছা তোর ব্যাপারটা কি বলতো, পইপই করে তোকে বললাম পুজো কালের দিনে একটু তাড়াতাড়ি আসিস। তোর কাজ মিটলে তবে একটু সব দিক সামলে ঠাকুর দেখতে যাবো। তা না সেই তুই দেরি করলি।’
    ‘তোমরা তো সবাই বলেই খালাস গো বৌদি, আমি আর কোন দিকে যাই বলো। আমি নয় কোনো কলের ধারে গিয়ে বসি আর তোমরা সবাই সব বাড়ি থেকে কাপড় বাসন বোঝাই করে সেখানে এসো, আর আমি সেখানে বসে কাজ সারি।’
    ‘মুখে কথা এতো না চালিয়ে দুর্গার মতো দশটা হাত চালিয়ে কাজ গুলোতো তাড়াতাড়ি করতে পারিস।’
    ‘কি যে বলো, এই দু হাতের ভারই আর শরীর টানতে পারেনা গো, দশ হাত হলে আর যাই কোথায়।’
    ‘আর তর্ক না করে কাজটা করে উদ্ধার করর।’
    আবার কাজে লেগে পরে দুগ্গা। পাড়ার মাইকে ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ। পুজো কালের দিন, উৎসবের সময়। পথ চলা মানুষ, আনন্দের আনাগোনা, কোলাহলে সরবে জেগে থাকে শহর। আনমনেই দুগ্গার মনে পরে যায় পুরোনো দিনের কথাগুলো। খুব পুরোনো নয় যদিও, তাও রূঢ় বাস্তবের ঠেলায় আজ অধরাই বটে। আসলে তখন দুগ্গা হয়নি ও, তখনও ও নূর। আব্বাজান বড়ো সোহাগ করে রেখেছিলো নাম। বিটি ঘর আলো করে এসেছি লো যে। আদরে,  অভাবে চার ভাইবোন আম্মা আব্বার সংসারে চাঁদ বিটি হয়ে বড়ো হয় ও। শোয়েবের সাথে পিরিত করে ঘর বাধলে আব্বা দু হাতে আশীর্বাদ করে, দুয়া করে খোদার বান্দারা যেন সারা জীবন নূরের ঘর আলো করে রাখে। শোয়েবেও বুকে করে আগলে রাখে নূরকে। কানাকড়ির অভাব ছিল বটে, তবে ছিল না সোহাগের ভাঁটা। এখনকার মতো তখনো, সারা বছর খেত-জমি, রিক্শা টানা, জোগাড়ের কাজ করতো শোয়েব। তবে পুজোতে কলকাতায় ঢাক বাজাতে আসতো সে। এ এক পাওনা নূরের। আব্বার ঘর বা শোয়েবের, দুখানেই ছিল এক উন্মুক্ত ধর্ম বিশ্বাস। কোনো গোঁড়ামির আশ্রয়ে ছিল না সে কখনোই। এরকম পরিবেশ পাওয়া ছিল খোদারই আশীর্বাদ। বিয়ের পর এক দুবার ঢাক বাজানোর পুজোর প্যান্ডেল-এ নিয়ে গেছিলো নূরকে, শোয়েব। কি নাচতে নাচতেই না ঢাক বাজিয়েছিল শোয়েব, দুগ্গাকে দেখতে দেখতে। শহরের পুজো দেখা, মানুষের ঢল, উৎসবের রাশ সব দেখে নূরেরও যেন  তাক লেগে গেছিলো। গেঁয়ো চোখে শহুরে আলো ঠিকরে এসেছিলো। আস্তে আস্তে, দিন গেলো বছর গেলো, ছেলেমেয়ে হলো, অভাব বাড়লো। সংসারের প্রয়োজনে কাজে নামতে হলো তাকেও। বোধন হলো দুগ্গার, অবশ্যম্ভাবী বোধন। তবে এ বোধন অকাল বোধন নয়, কালের নিয়মেই চিরায়ত প্রাকত্ব। নূর নামে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না অনেক ক্ষেত্রেই, অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল শহুরে ঘরে।
সেই শহরেই আনাগোনা শুরু হলো, শুরু হলো রোজকার রোজগেরে জীবন। এরকমই আরো অনেক দুগ্গাকে ও চেনে। কেটে গেছে বছরগুলো। শোয়েব এখনো যায় ঢাক বাজাতে পুজোতে। বছরের আর বাকি পাঁচটা দিনের মতো মোটামুটি ভাবে কেটে যায় পুজোটাও। তবে পুজোর পর শোয়েব কিছু উপরি আয় করে ফিরলে একবার মাংস ভাত খায় সবাই মিলে। 
    বাসনের ঠুং-ঠাং আওয়াজে হঠাৎ আবার চাপা পরে যায় পাড়ার মাইকের ঢাকের কাঠির আওয়াজ। চলতে থাকে দুগ্গার দুহাত। এলোমেলো চুল, কাকভোরে জাগা চোখ আর হাড়ভাঙ্গা খাটনিতেই কেটে যায় পুজোটাও। আজ কথাটা একবার বলবে বৌদিকে। কিছু টাকার যে খুব প্রয়োজন ওর।
    ‘‘৫০০ টা টাকা ধার দিতে পারবে বৌদি?’’
    ‘‘কেনরে কি মতলব, দেখিস আবার। পুজোয় বোনাস নিলি আবার টাকাও চাইছিস। চম্পট দিবি নাতো আমার কাজটা ছেড়ে পুজোর পরে। তোদের কিন্তু ভরসা নেই।’’
    ‘‘এতো সাত পাঁচ ভেবে মতলব কি করবো গো বৌদি। টাকা যে কটা ছিল ঘরের চাল সারাইয়ে আর মহাজনের পাওনা মেটাতেই বেরিয়ে গেলো। গেলবার ঝড়ে মাথার ওপর কিছু ছিল না গো। কোমর সমান জল আর ফাঁকা হাঁড়ি নিয়ে ছেলে মেয়ে গুলোকে নিয়ে যে কিভাবে দিন কেটেছে, তা আমিই জানি। ছেলেমেয়েটার জন্যে পুজোতে  কিছু কিনতে পারিনি। আজ ফেরার পথে সোনারপুরের বাজার থেকে দুটো জামা কিনতাম ওদের জন্যে। তুমি মাসে মাসে কেটে নিও।
    ‘‘'সবইতো বুঝছি কিন্তু দিনকালের যা অবস্থা, পুজো কালের দিনে এখন কোথা থেকে দি বলতো ৫০০ টাকা। জানিসই তো দুদিন আগে Dining Room এর false ceiling লাগাতে কতোগুলো টাকা বেড়িয়ে গেল। ছেলেটার school এর খরচা tuition, গাড়ির তেল কি কি আর বলবো বল। আচ্ছা ওই ২০০ টা টাকা নিয়ে যাস খন।’’
    আর কথা বাড়ায় নি দুগ্গা। ও টাকাও আর নেয়নি। হঠাৎ বড়ো অভাবী লাগছিল বৌদিদের। সবচেয়ে বড়ো, দু হাত পেতে কিছু নিতে ভালো লাগে না যে তার। আত্মসম্মান আর সত্বার দৃঢ়তা বড় দামি তার কাছে। এমনি অহং তার।
    সব কাজ সেরে সে স্টেশনের দিকে এগোতে থাকে। পাড়ার মোড়ের কাছে দাসদের মাঠ আসতেই দশহাত দুরে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাটার দিকে চলে যায় চোখ। গা এলিয়ে সিটে বসে আছে মহেশ। দুচক্ষে দেখতে পারে না ওকে দুগ্গা। মিনসেটা সুবিধার নয়। এ পাড়াতেই রিক্সা টানে। নজরটা খুব নোঙরা। শোয়েবকে কিছু জানায়নি কখনো । তান্ডব লেগে যাবে তখনি। আজ যেন আরো নোংরা লাগছে লোকটাকে। কিছু না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল দুগ্গা।
    ‘‘কি রে পুজো কালের দিনেও দুটো কথা বলবি নি? বুকের ভিতরটা কেমন খাঁ খাঁ করে বুঝিস না।’’
    বিকেলেই দেশী মদে আকন্ঠ হয়ে আছে লোকটা। ওকে এড়িয়ে এগিয়ে যেতে গেলেই হাতটা ধরতে যায় মহেশ। নিজবিঘ্নবিনাশিনী দুগ্গার মহাশক্তিরূপিণী মূর্তি ধারণ যেন হল ক্ষণিকে। পরিশ্রান্ত শরীরে যেন যুদ্ধে উদ্যত এক আশীবিষ অসুরের সাথে। রক্তাভ চোখে তাকিয়ে হাত তুলে সিংহীর মতো বলে ওঠে, ‘আর যদি কখনো আমার সাথে কথা বলতে আসিস তো, তোকে আমি টুকরো টুকরো করে দেবো।’ টুঁ শব্দটা করে না মহেশ। নিমেষে সিঁটিয়ে যায় ভীষণ ভয়ে। আজ  মহাষ্টমী, রাতে সন্ধিপূজোর আয়োজন দিকে দিকে।
    ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দুগ্গা ষ্টেশনে এসে বসে। এসময় প্রতিদিনই হাজার খানেক দুগ্গারা বাড়ি ফেরে একসাথে, কামরা বোঝাই হয়ে। এভাবেই একভাবে চলে যায় বছরগুলো। পুজো আসে, নতুন বছর আসে, দোল আসে, ভোট আসে আর সাথে আসে সব দুগ্গারাও। আবার ফিরে যায় দিন শেষে। রোজকার এক চিরন্তন ব্যাপার। হঠাৎ ফটাশ-জলের ছিপি খোলার শব্দে আবার আনমনা দুগ্গা ফিরে আসে মর্ত্যে। হঠাৎ সামনে যা দেখে তাতে একটু চমকে যায় দুগ্গা। কাঁধে ঢাক ঝুলিয়ে আসছে শোয়েব। পুজোর পর দ্বাদশীর দিন ঘর ফেরে সে। এ সময় হঠাৎ এখানে, তাহলে, আবার কিছু নতুন বিপদ হলো কি?
    কাছে এসে ঢাকটা নামিয়ে দুগ্গার পাশে বসে শোয়েব, গলার গামছাটা দিয়ে মুখটা মুছে বলে, ‘‘জানতাম তোকে এখন এখানে পাবো। এসময়ই তো ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরিস এখান থেকে, তাই খানিক আগের ট্রেনে এসে বসে আছি। আজ একটা ...’ একটু আমতা আমতা করে বলে,’ যদি গাল না দিস সাহস করে বলি।’
    ‘বল।’ বলে দুগ্গা।
    ‘জানিস আজ মনটা বড়ো খারাপ করতেছিলো। সব পুরোনো কথা গুলো মনে পরে  যাচ্ছিলো হুরমুর করে। ঢাকের কাঠি লাগাম মানছিল না কিছুতেই। তোরে খুব দেখতে মন চাইছেল। তাই শালা আধবেলা বাজিয়ে এতদিনের পাওনা আর কিছু বাড়ি ঘুরে সাধাসাধি করে ওই যা কিছু বখশিশ হলো নিয়ে চলে এলাম। ভাবলাম তোর সাথে ফেরার পথে ছেলেমেয়ে গুলোর জন্যে দুটো জামা কিনে ফিরি। কি আর হবে বল দিকিনি নতুন করে? যা চলছিল তাই তো চলবে। দুটো পয়সা যা শালা আসবে কাল আবার কোনো গব্বে যাবে। আমরা কি শুধু কলির বলদ যে শুধু ঘানি টেনে যাব। শুধু লটকে থাকবো। দুদিন আর তুইও কাজে যাসনা। চল সবাই এবার পুজোতেই  কাল মাংস কিনে খাই। বিকালের দিকে নয় ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে চারখান ঠাকুর দেখে আসবো কাছে পিঠে। পুজো তো আমাদেরও বল দুগ্গা। তাই তো ছেল, তাই তো আছে এখোনো।’
    কিছু উত্তর দেয়না দুগ্গা, অল্প হেসে মাথা নারে শুধু। শোয়েবের কাঁধে মাথাটা রাখে আর চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পরে একচিলতে জল। গাল বেয়ে নামতে নামতেই যা শুকিয়ে যায়। কোলাহল, যাতায়াত সব ভুলে দুজন তাকিয়ে থাকে বেঁকে চলে যাওয়া ট্রেন লাইনটার দিকে। তারপর একসাথে সোনারপুরের বাজার থেকে ছেলেমেয়ের জন্যে দুটো জামা কেনে।হাতে হাত দিয়ে এ গলি ও গলি ঘোরে কিছুটা। সেই আগের মতো। তারপর আবার বাড়ির পথে যায়। বড়ো বোঝাহীন হালকা পালকের মতো লাগে নিজেকে দুগ্গার।
    দুগ্গার বাড়ির আগেই পরে তালতলার পুকুরটা। বাড়ি ঢোকার আগে শোয়েবকে বলে, ‘তুই যা আমি আসছি।’ পুকুরটায় একটা ডুব দেয় দুগ্গা। না এতো বিসর্জন নয়, এতো বোধনেরই পূর্বাভাস। মহাশক্তির উৎস যে হয় প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। সে যে একাধারে পালিকা, দুর্গতিনাশিনী , সংহারিনী। মর্তলোকের এ দুগ্গারা থাকে জাত্যন্ধ মানুষের অগোচরে। নিরলস যুদ্ধে বিসর্জন হয়না কখনোই। দুগ্গা জল গায়েই উঠে চলে আবার  ছেলে মেয়ে বর নিয়ে সংসার করতে।  এভাবেই ঘরে ফেরে আজ নূর দুগ্গা হয়ে, কালকের বোধনের আগে ।

জলপাই  রঙের  শাড়ি

তিথি মিত্র


সুজাতার ঘরে  তখন নতুন বিয়ের মৌতাত। ঘরে রজনীগন্ধার গন্ধ, বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন, হৈহৈ রৈরৈ কান্ড। সুজাতাকে ঘিরে সবাই বসে আছে। সুজাতার গলার কানের হাতের গয়না ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। সুজাতা বসে বসে ভাবছে সেই মানুষটা কখন আসবে! যার জন্য এতকিছু! সুজাতা নিজের ঘরের নতুন খাটে বসে আছে। ননদ, জা ফুলসজ্জার রাত নিয়ে খুনসুটি শুরু করেছে। হঠাৎ পিসি শাশুড়ি এসে বললো, আরে বৌভাতের গিফটগুলো খোলো, দেখি নতুন বৌমা কি কি পেলো। ব্যস গিফট খোলা শুরু। একে একে বেরিয়ে পড়লো নতুন মোড়কে মোড়া কাঁসা পিতলের বাসন, চাদর,শাড়ী, বাসনকোসন, আরও কত কি! আজ থেকে বছর চল্লিশ আগে এখনকার মতো মানুষ এত ভেবেচিন্তে উপহার দিতো না। তবে আর একটা চল ছিল। তা হলো উপহারটা যে দিচ্ছে তার নামটা উপহারের উপর লিখে দেওয়া। সুজাতা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে সব দেখছে। বাড়িতে আনন্দহিল্লোল। হঠাৎ সুজাতার চোখে পড়লো একটা ব্রাউন পেপারে মোড়া প্যাকেট। কিন্তু কোনো নাম লেখা নেই। সুজাতার মনে আছে সেই প্যাকেটটা খুলে তার ননদ রত্না নাক সিঁটকেছিল, ‘‘ম্যাগো বিয়েতে কেউ এই শাড়ী দেয়! বিয়েতে একটু লাল গোলাপী হলুদ শাড়ি দেয়। এসব কি নতুন বৌকে মানায়। বৌদি কত ফর্সা সুন্দর!’’ সুজাতা আড়চোখে দেখেছিলো,দরজায় হেলান দিয়ে তার পতিদেব মুচকি মুচকি হাসছে।
    কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও সুজাতার ঐ জলপাই রঙের শাড়ীটা পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। একঢালা শিফন জর্জেট। ভিতরে গাঢ় সবুজের সুক্ষ কাজ। সুজাতা ভাবছিল যে দিয়েছে তার রুচি আছে মানতেই হবে। লাল বা কালো ব্লাউস দিয়ে পড়লে দারুন লাগবে। সুজাতা হাত দিয়ে শাড়ীটা নিজের দিকে টানতেই তার শাশুড়ি বলে উঠলো, ‘‘বৌমা একটা বছর এই শাড়ী আর পড়ো না।পরে এসব পড়ার অঢেল সময় পাবে।’
    সুজাতা শাড়ীটা তুলে রেখে ছিল।
    সুজাতা যখন দ্বিরাগমন যাবে তখন শাড়িটা ব্যাগে ভরে ছিল। কিন্তু তার বর মুখ ফুলিয়ে বলেছিল, ‘‘এই শাড়িটা পড়ো না  প্লিস! তোমার তো কত শাড়ি আছে, এটা আমার ভালো লাগেনা।’’  সুজাতা  শাড়ীটা রেখে দিয়েছিল।
    বিয়ের পরপর প্রথম ঘুরতে যাওয়া ঠিক হলো। পুরীতে যাবে। কিন্তু সেখানে আবার স্বামী স্ত্রী যুগলে যাওয়া যাবে না পরিবারের সকলে মিলে যাবে। তখন তো এইসব হানিমুন টানিমুন ছিলনা। লোকজন এগুলোকে আদিখ্যেতা বলতো। তাই সেখানে গিয়েও যে নিভৃতে একটা  পছন্দ মতো শাড়ি পরবে তার উপায় ছিল না।
    পরে যখন কোনো অনুষ্ঠান এসেছে সুজাতা যতবার শাড়ীটা পরতে গেছে, সুজাতার বর বলতো, ‘‘লাল শাড়ীগুলো পড়ো।’’ একবার তো বলেই দিল. ‘‘... কেন আমি কি আর নেই যে এই জলপাই রঙের শাড়ীটা পড়তে হবে!’’
    সুজাতার জলপাই রঙের শাড়ীটা আলমারিতে ন্যাপথলিনের গন্ধে অতিযত্নে পরেই থাকে।
    দেওরের বিয়ের দিন সকালে ভাবলো হলুদ ব্লাউস দিয়ে পড়বে তাও হলো না। শাড়ী চেঞ্জ করার সময় পেলনা।
    আলমারি খুলে সুজাতা কতবার শাড়ীটা ছুঁয়ে হাত বুলিয়েছে। কতবার ভেবেছে জলপাই রঙের শাড়ি কাঁথা স্টিচের লাল ব্লাউজ, বড় টিপ, গলায় কানে ম্যাচিং সেট পড়ে সে বেরোবে, কিন্তু এবাড়ির বড় বৌ রাশভারী হবে। তার সাজসজ্জা হবে অন্যরকম। ভারী কানের ,গলার সাথে তসর কিংবা তাঁত। আভিজাত্যই আলাদা।
    এই তো সেদিন সুজাতার ছোড়দার মেয়ের জন্মদিনে ভেবেছিল জলপাই রঙের শাড়িটা পরবে কিন্তু তার বৌদির ওই শাড়িটা পছন্দ হওয়ায় সুজাতার আর পড়া হলো না। সুজাতা কি বলতে পারে, বৌদি তুমি শাড়িটা পড়ো না আমি শাড়ীটা পড়বো। না সুজাতা তেমন মেয়েই নয়। তারপর আবার কেঁচেধুঁয়ে শাড়িটা তুলে রাখা হলো আলমারিতে।
    তারপর একদিন পাশের বাড়ি টুসু লোক উৎসবে নাচ করবে তার একটা সবুজ রঙের শাড়ি চাই। সুজাতার কাছে এসে বলাতে সুজাতা অনেকগুলো সবুজ শাড়ি বের করে দিল। কিন্তু টুসু ওই জলপাই রঙের শাড়িটা নিয়ে গেল। পরে যখন ফেরত দিয়ে গেল তখন মুখ কাচুমাচু করে সুজাতাকে বলল, ‘‘কাকিমা শাড়ীটা পাড়ের কাছে একটু ছিঁড়ে গেছে। রিপু করিয়ে দিয়েছি অসুবিধা হবে না।’’
    শাড়িটা পড়ে রইল ঠিক যেভাবে নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েরা পড়ে থাকে শ্বশুরবাড়িতে। প্রথম প্রথম ভালো দেখতে হলে রূপের কদর পায়, তারপর সেটাও রান্নাঘরের অন্ধকারে  আস্তে আস্তে তলিয়ে যায়। আর গুণগুলো চলে যায় হাঁড়ির ভিতর।
    অবশেষে জলপাই রঙের শাড়ীটা  পরার  সুযোগ এলো সুজাতার মেয়ের স্কুলের ফাংশনের দিন। কিন্তু সেদিন আবার সব ছাত্রীর মায়েরা বললো সাদা লাল পার শাড়ী পড়বে।
    সুজাতার আলমারি তে শাড়ীটা পরেই রইলো। একটা সময় সুজাতার আর মনেই থাকলো না শাড়ীটার কথা।
    বাড়ীতে যেমন স্বামী সন্তান শ্বশুর শাশুড়ি সবার দেখভাল করে সুজাতা একটা কোনায় লেগে থাকে, শাড়ীটারও সেই দশা। শাড়ীটা আছে এইটুকুই। রূপ বা গুন যাচাইয়ের সময় বা ইচ্ছা কারও নেই।
    সকাল সন্ধ্যা হয় পৃথিবীর ভৌগোলিক নিয়মে। চুলে ,স্মৃতিতে মরচে ধরে বয়সের নিয়মে।মেয়ের কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে মেয়ে কি শাড়ী পরবে ভেবেই পারছে না। মায়ের আলমারি খুলে একটার পর একটা শাড়ি নামাতে শুরু করলো কোনটাই তার মন মতো হচ্ছে না। অবশেষে বেছে নিলো একটা ধনেখালি তাঁত সেটাও আবার নীলাম্বরী। তাই নিয়েই মেয়ে শান্ত হলো। পরে  রইল সেই জলপাই রঙের শাড়িটা যা অন্য সব শাড়ির সঙ্গে থেকেও কোনোদিন সমান মর্যাদা পেল না।
    একদিন সুজাতা ভেবেছিল শাড়িটা বাসনওয়ালীকে দিয়ে দেবে। কিন্তু যেই ভাবা সেই কাজ তো আর হয়না। সে ভেবেছিল কিন্তু প্রাণে ধরে দিতে পারেনি।
    সুজাতার এখন হাঁটুর ব্যথা। সেসব কাজ খুব তাড়াতাড়ি  করতে পারে না। আগে যেমনটা সে পারতো এখন আর ঠিক তেমনটা হয় না। এদিকে কর্তার আবার রিটারমেন্ট এর অনুষ্ঠান, সেখানে যেতে হবে। ঐদিন সুজাতা একটা লাল সাদার বোমকাই পড়েছে। সুজাতাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
    সুজাতা এখন ভুলেই গেছে তার একটা জলপাই রঙের শাড়ি আছে। শাড়ীটা কিন্তু থেকেও নেই । অনেকটা ঠিক  তার মূল্যবোধগুলোর মতোই। এভাবে কতকিছু থেকে গেল পাঁচজনের ইচ্ছে অনিচ্ছের চাপে। সুজাতার কবিতা লেখার সখ, ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে ,বই মেলায় কাটানো দিনগুলি, বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়া ... সবই যেন আজ স্মৃতি হয়ে গেলো। কি করে যে ওই জলপাই রঙের শাড়িটা আর সুজাতার ইচ্ছেগুলোর পরিণতি এক হয়ে গেছে সুজাতা টের পায়নি। বোধহয় কেউই টের পায়না। সুজাতা মাঝেমধ্যেই ভাবতো একটা জীবনের পর সবকিছুই কি নির্ভর করে অপরের চাহিদার উপর ! নিজের বলে কি কোন ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকতে নেই ! এ প্রশ্নগুলো সুজাতা এখন আর  নিজেকেও করে না। সে খুব সুখী। সকলে তার কথা মেনে নেয়। সত্যিই কি তাই! নাকি সকলকে সেই মানিয়ে নেয়। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার কোনো তফাৎ আজ আর সুজাতার কাছে নেই।
     কোন একদিন সকালে সুজাতার আর ঘুম ভাঙ্গে না। ঘুমের মধ্যেই সুজাতা চলে গেছে ঘুমের দেশে। সেদিনও বাড়ি ভর্তি লোক, সবার মুখে ঘুরে ফিরে সেই একই কথা ... সুজাতার কি ভাগ্য শাঁখা সিঁদুর নিয়ে স্বর্গে চলে গেল। এ ভাগ্য কয়জনের হয়? কেউ তো বলল ...দাও একটা নতুন শাড়ি সুজাতাকে বার করে দাও। একটু লাল রঙের দিও। সধবা মানুষ তো! সেই দিনও কেউ জলপাই রঙের শাড়িটা বার করে দিল না। কেউ তো জানলোই না বিয়ের পরদিন থেকে সুজাতার ইচ্ছে ছিল ওই জলপাই রঙের শাড়িটা পড়ার। মনের ভিতরে যত যন্ত্রণা শাড়ির ভাঁজে কি তত যন্ত্রনা রেখে গেলো সুজাতা! এ প্রশ্নের উত্তর শুধু  ন্যাপথলিন এর গন্ধে রাখা শাড়ীটা বোধহয় জানে।

তিলের নাড়ু

কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক )



    আশ্বিন মাস পড়ে গেছে। চারিদিকে কাশের চাদর, বাউল মাঝির গানের মেঠো সুর, টলটলে দীঘিতে শাপলার আদর, ঢাকের বোহেমিয়ান মাতাল করা বন্দিশ জানিয়ে দিচ্ছে মা উমা আসছেন।
    সামান্য বহুদিন পরে পুজোতে ঘুরতে যাচ্ছে। বন্ধুর দেশের বাড়ি। মালদার রতুয়াতে। সেখানে গোবরাহাটে বাড়ির পুজোতে বেশ ধুম। 
    আরও একটা কারণ আছে ওখানে যাবার। পুরানো ব্যথা, আবেগটা মাঝে মাঝেই নাড়া দেয়। ছাব্বিশ বছর পরে সেটা আবার নতুন করে টের পাচ্ছে।
    ‘‘কাল রওনা দিবি?’’ মা বলল।
    ‘‘হ্যাঁ। রাতের ট্রেনেই যাব।’’ সামান্য ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল।
    ‘‘সমু,  শিউলির সাথে দেখা করবি না? একবার খোঁজ নিস।’’
    ‘‘তুমি আবার শুরু করলে।’’
    সামান্য এড়ানোর চেষ্টা করলেও  মা প্রায়ই  প্রসঙ্গটা তোলে।  যাতে ছেলের সুমতি ফেরে। সংসারী হয়। 

                                                    ***************

    স্টেশন থেকে নেমে মোরামের রাস্তা ধরে বিবর্তনের বাড়ি অনেকটা পথ। পুরোটা হেঁটেই গেল। গ্রামের জ্যামিতি অনেকটাই চেঞ্জ হয়েছে। সেই সাথে মানুষের রুচিও।
    একটা দীঘির কাছে এসে একটু থেমে এদিক ওদিক ঘুরেই  আবার সামনে হাঁটতে শুরু করল। পুরানো কিছু হয়ত মনে পড়েছে। তাই ...
    শরৎকালের চেনা ছবিটা গ্রামে আসলেই ধরা পড়ে। ছবির মত সব কিছু যেন সাজানো।
    ‘‘সমু, এসেছিস বাবা। কতদিন পরে তোকে দেখলাম।"  ঠাকুরমা বুকে জড়িয়ে ধরল।
    ‘‘তোমাদের খবর সব ভাল তো?’’ সামান্য ঠাকুরমাকে প্রণাম করে।
    ‘‘আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো? বিবর্তন হাত ধরে টানতে টানতে সামান্যকে দুর্গাদালানে নিয়ে যায়।
    বাড়িতে সবাই  ব্যস্ত। শুধু  একজনের অনুপস্থিতি ভীষণভাবে সামান্যকে কষ্ট দিচ্ছে। 

                                                             **************

    ‘‘বাজলো তোমার 
      ...........,আলোর ......" 

    দুটো দিন কিভাবে কেটে গেছে। আজ অষ্টমী। অষ্টমী আসলেই বুকের ব্যথাটা টনটন করে। সারারাত ঘুমোতে পারেনি। একটা চাপা কষ্ট তাড়া করেছে ওকে।
    শিউলির কথা মনে পড়েছে। 
    বহু বছর আগে ক্লাস টেন পাশ করার পর এখানে এসেছিল। শিউলির সাথে তখন দেখা। বোবা কালো মেয়ে। বিবর্তনের বাড়িতে কাজ করত। শিউলিকে দেখেই সামান্যর ভাল গেছিল। বলতে পারেনি। 
    শিউলির বন্ধু বকুলও এ বাড়িতে কাজ করত।  শিউলির মতনই সুন্দরী। চটপটে। একদিন সামান্যকে একা পেয়ে বলে বসল, ‘‘আমাকে বিয়ে করবে।?’’
    সামান্য তখন বারো  ক্লাস পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। শুনে হেসেছিল।
    তারপর এখানে সেভাবে আসা হয়নি। পরে জেনেছিল বকুল একটা ভিন জাতের ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। পরে বকুলকে সবাই গ্রাম ছাড়া করে। ওর খবর কেউ জানেনা। 
    সামান্য আজ আদিনাতে এসেছে। মনটা খারাপ। তাই একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। শ্রাবণীর সাথেও একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল সেটাও ধরে রাখতে পারেনি।
    সন্ধ্যেতে বাসে উঠতেই একটা মেয়ের সাথে বাসের সীট নিয়ে বচসা বাঁধে। পরে দুজনেই মিটমাট করে নেয়।

                                                               **************

      দশমীতে বাড়ির সবাই লরি ভাড়া করে ফুলহার নদীতে গেছে ঠাকুর  ভাসানে। সামান্য যায়নি। ও দীঘির পাড়ে চুপ করে বসে সিগারেট টানছে। কোজাগরীর চাঁদটা দীঘির  জলে রূপালী অহংকার ছড়াচ্ছে।
    সন্ধ্যের একটু পরেই একটা হাত সামান্যর পিঠ স্পর্শ করল।
    ‘‘তিলের নাড়ু। খুব কষ্ট করে তোমারজন্যে বানিয়েছি। আর প্যাকেটটা বাড়ির জন্যে।’’  বলেই বকুল একটা নাড়ু সামান্যর মুখে গুঁজে দেয়।
    ‘‘সেই পুরানো স্বাদ!’’ সামান্যর চোখ ছলছল করে।
    আদিনাতে বাসে বকুলের সাথে সীট নিয়ে ঝগড়া হয়। পরে দুজন দুজনকে ঠিক চিনতে পারে। বকুল এখনও সামান্যকে ভালবাসে। আদিনার কাছেই থাকে। ও একটা ভুল করেছিল। পরে সেটা শুধরে নেয়।
    শিউলি এই দীঘিতেই স্নান করতে এসে সাপের কামড়ে  মারা যায়। অনেকদিন হল। খবরটা সবাই চেপে যায়। বকুলও  বলতে চায়নি।আজ  মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসে।
    ‘‘আমায় বিয়ে করবে তো?’’
    ‘‘করব। মাকে গিয়েই সব বলব।’’
    ‘‘নাড়ু তৈরীর পদ্ধতিটা শিউলির। বকুল ওর কাছে শিখেছে।’’
    আজ দশমী, বিসর্জন। সামান্যর ভালবাসার বিসর্জন হয়নি।
তিলের নাড়ুর স্বাদ দুজনের ভালবাসাকে আরো মধুর করল।
‘‘দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী ...’’ 

ভৌতিক গল্প

হাত

সঞ্জয় কুমার মুখোপাধ্যায়


    বেশ কয়েক বছর আগে, উদয় তথাগত'কে নিয়ে কিছু বন্ধুর সাথে ঘাটশিলা বেড়াতে গিয়েছিল। ওখানে ওদের দেশের পারিবারিক একটি পুরানো বাগান বাড়ি আছে। অনেকদিন ওটা একটা গেষ্টহাউস হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। সেখানে থাকে একজন মালি আর ওখানেই এক পাশের গ্ৰামের উদয়ের এক কাকার মেয়ে অরুণিমা। উদয় তাড়াতাড়ি এখানে আসবে সে কথা জানানো হয়ে ওঠেনি তাই যখন উদয় তথাগতকে নিয়ে সেখানে পৌঁছল, দেখলো ইতিমধ্যেই অন্যান্য কয়েকজন ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। অরুণিমা বয়সে উদয়ের চেয়ে প্রায় ছয় বছরের ছোট। অরুণিমা বলল—"কিছু মনে করো না দাদা, "আজ তোমরা ছোট গেস্ট রুমে ঘুমাতে পারো। আমরা ওটা ব্যবহার করি না, তোমাদের দুজনের এক রাতের জন্য ঠিক হয়ে যাবে।"
    উদয় আর তথাগত গুডনাইট বলে ঘরে ঢুকতে যাবে এই সময় অরুণিমা বলল—"ওহ, দাদা, একটা কথা। তুমি ঘুমাতে যাওয়ার ঘরের দরজাটি লক করে দিও, না হলে এটা নিজে থেকে খুলে যেতে পারে। 
    একটু অবাক হয়ে উদয় বলল—‘‘দরজার কব্জা কি খারাপ?’’ 
    অরুণিমা চুপ করে রইল, তেমন কিছু বলল না। উত্তর না পেয়ে উদয় বলল — ‘‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি বন্ধ করে দিচ্ছি।" এরপর উদয় আর তথাগত দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তথাগত ঘুমের ঔষধ খায় তাই ওর একটু পরেই  ঘুম এসে গেল। 
    কিন্তু রাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পরবার পরে হঠাৎ উদয়ের সারা শরীর আনচান করতে লাগলো। ও বুঝতে পারছিল না যে ও ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে। হঠাৎ উদয় বুঝতে পারল সে জেগে আছে, কারণ উদয়ের মনে হলো একটা হাত উদয়ের মুখটাকে খালি স্পর্শ করছে। উদয় প্রাণপণে হাতটা দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এবার উদয় হাতের কাছে আলোর সুইচ খুঁজে পেয়ে আলো জ্বালিয়ে দিল কিন্তু অদ্ভুত ভাবে দেখলো ঘরে কেউ নেই। উদয় মনে করতে লাগলো তাহলে সে স্বপ্ন দেখেছে। উদয় এবার আবার ঘুমাতে চেষ্টা করল তারপর আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠলে আরেকটা চমক পেল। দেখল ঘরের যে দরজা বন্ধ ছিল, সেটা খোলা! প্রাতঃরাশের সময়, উদয় আর তথাগত অরুণিমাকে সব বলল। বিশেষ করে মুখে হাত বোলানো আর খোলা দরজার কথা । 
অরুণিমা বলল — ‘‘তুমিও সেই একই কথা বলছো!’’ 
তথাগত আর উদয় একটু অবাক হল! অরুণিমা বলল — ‘‘আসলে আমি কাল রাতে ভাবছিলাম, ঘটনাটা আমি জানি দাদা। আমরা একটা বিশেষ কারণে ওই বেডরুমটি ব্যবহার করি না। কাল আসলে ঘর ভাড়া থাকায় আমার আর কোন কিছু করার ছিল না। আসলে এখানে একটি পরিবার ঘর ভাড়া নিয়েছিল!’’
    তথাগত বলল — ‘‘পরিবার ভাড়া নিয়েছিল তো তার সাথে এই ব্যাপারে কি সম্পর্ক?’’
   ‘‘উদয় একটু রেগে বলল — ‘‘তুমি সব জানো অথচ আমাদের বলো নি।’’
   অরুণিমা বলতে লাগলো — ‘‘আসলে অনেক বছর আগে, এখানে যারা ভাড়া নিয়ে বসবাস করত তাদের একটি মেয়ে ছিল যে অন্ধ ছিল। ওই ঘরটা ছিল তার শোবার ঘর। তার বয়স যখন ২৫ বছর তখন মেয়েটি হঠাৎ মারা যায়। তারপর থেকে, সে তার ঘরে ফিরে ফিরে আসতে থাকে। মেয়েটি সবসময় বিছানায় ওঠার আগে চাদর অনুভব করে। সেটা ভেবেই তোমার মুখে হাত বোলাচ্ছিল। বেশ কয়েকজনের ওই ঘরে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে ... কিন্তু মেয়েটি একজন সুন্দর স্বভাবের মেয়ে ছিল। তাই সে কখনো কারো অনিষ্ট করেনি।’’ হঠাৎ তথাগত অনুভব করল তার ঘাড়ের পিছনের চামড়া ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ... সেই থেকে, উদয় আর তথাগত সবসময় ভূত বিশ্বাস করে!

অণুগল্প


আলোকীয় লাজবন্তী

প্রদীপ দে 


আকাশের রঙ আজ লাল!
গোধূলির বেলা।
তাই কি এই লাল রঙের মাখামাখি?
তবে শীতল বাতাস বয়ে চলেছে -একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। 
প্রকৃতিতে এক মধুর সংগীতের মূর্ছনা সুর তাল লয়ের মিলিত প্রয়াসে আবদ্ধ।
দুটি নক্ষত্র জেগে ওঠে।
খসে পড়তে থাকে ভূমিতে। 
ভূমি ওদের স্বাগত জানায়।

নেমে আসে লাল পরী। লাল রঙ মাখানো তার শরীর। উজ্জ্বল বহির্লোক। নিরাভরণ দেহে এক জ্যোতির্ময়ী রূপসী! চোখ ধাঁধানো ঝিলিক -ঝিলিমিলি ডানাযুক্ত! তবুও যেন ডানাকাটা পরী!

শুভ্রবর্ণ অশ্বারোহী রাজকুমার লাগাম টানতে ব্যস্তবাগীশ! অশ্বযুগল উচ্চস্বরে লাফিয়ে ওঠে।
মোহগ্রস্থ  রাজকুমার অপলক দৃষ্টি ঘুরপাক খায় পরীর শরীর জুড়ে। নীলাকাশের নীলাম্বরী যে আজ লালচে লাজবন্তী, উন্মোচিত দেহেও।

সরু কটিদেশ, উন্নত নিতম্বের ভারী স্তনদ্বয় আর মোটা ঠোঁটের অধিকারিণী, সুগঠিত এবং সুগভীর নাভিমূলের সুগন্ধি রাজকুমারের কামনায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কামরূপ প্রেমের উদ্বেগে সে আত্মহারা  উন্মাদপ্রায়!

পরী ডানা মেলে। বাহুবন্ধনীতে জড়িয়ে পড়ে অশ্বিনীকুমারের। আনন্দের অলিন্দে মাতোয়ারা হয়। মিলনের চুম্বন দীর্ঘায়িত হয়!

রাজকুমারের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। কটিদেশ থেকে নির্গত তরবারি উন্মোচিত হয়। রাজকুমার উন্মাদের ন্যায় আঘাতের নিমিত্তে এগিয়ে যায়!

ততোক্ষণে দুজনার প্রেম মিলিত কামনার  উগ্রতায় এক আলোকীয় দুনিয়ায় পৌঁছে যায় যেথায় হিংস্রতা হার মানে।

আর তখনই এক উজ্জ্বল আলোকপাত ঘটে। পতিত দুই নক্ষত্ররাজি আলোকবর্ষে পুনরায় মিলিয়ে যায়! রয়ে যায় আলোকীয় অনুভূতি! 

বেওয়ারিশ

স্মরজিৎ ব্যানার্জি






হাওড়া- বর্ধমান লাইনের এই জায়গাটা বেশ জমজমাট, একপাশে প্লাটফর্ম অন্যদিকে কাঁচা বাজার আর অটো স্ট্যান্ড। অনেক রাত অবধি লোকজন থাকে এইদিকে, কদিন সকালে কয়েক জন ফেরিওয়ালা ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ্য করে রেল লাইনের ঠিক পাশেই কে যেন শুয়ে আছে । প্রথমে সবাই ভেবেছিল মাতাল -টাতাল হবে। অবশ্য একটু পরেই সবার ভুল ভাঙে পড়ে আছে একটা লাশ।

    একটু পরেই জায়গাটা লোকজনে ভরে ওঠে। অত্যুৎসাহী কয়েক জন উঁকি দিতে চায়। হঠাৎই শোনা গেল পুলিশ আসছে, ভিড় পাতলা হয়ে আসে, দূরে কয়েক জন পুলিশ আসতে দেখা যায়।  দারোগা লাশ দেখে  নাক কুঁচকে বলেন কে লোকটা কোত্থেকে এলো। সকলের মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়, কনস্টেবলরা ভিড় সরাতে ব্যস্ত হয়, স্টেশন মাস্টার এগিয়ে এসে বলেন—স্যার চলুন বিষয়টা অফিসে বসে ডিসকাস্ করবেন। পিছু ফেরেন তিনি। কনস্টেবলরা তাঁদের অনুসরণ করে, কয়েকটা কাক লাইনে নেমে আসে, ইঁদুরের দল এদিক ওদিকে উঁকি দেয়, আজ অনেক দিন পর একটা বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে ।


ধারাবাহিক উপন্যাস

কাগজের ফুল (পর্ব ৩)  

সুদীপ্ত পারিয়াল


(পূর্ব-কথন= বাপের বাড়ি এসে ঐন্দ্রীর(অপুর) ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে, ওদিকে তার এ হেন আগমনে তার বাবা কাকারা গভীর আলোচনায় রত। ছোট ভাই আনিকেতের বাঁশির টানে  মনকেমন ভাবে আচ্ছন্ন হয় অপু। বড়দি আর বানীর সাথে তাদের নিভৃত আলোচনা চলতে থাকে, কথা প্রসঙ্গে আসে ‘মাধব’-এর কথা, বড়দি বলে- ছেলেটা তোকে খুব ভালবাসত রে!)

(পর্ব-৩)

খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেছে অপুর। একাই শুতে হয়েছে তাকে। মৈনাক অনির ঘরে শুয়েছে। মামা ভাগ্নেতে অল্পসময়ের মধ্যেই ভাব হয়ে গেছে অনেক। রাতে ভাল ঘুম হয়নি অপুর। প্রথমত, নতুন জায়গা, দ্বিতীয়ত মানসিক চাপের এক তুমুল আন্দোলন, তৃতীয়ত, মানসিক অস্থিরতা বা মন খারাপ বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হবে। পনের বছরে এই প্রথম প্রায় পাঁচদিন হয়ে গেল, স্যামুয়েলকে ছেড়ে থাকা। এবং চতুর্থত, এবং সবথেকে বেশি যা পীড়া দিচ্ছে তা মাধবের কথা। বেলাপিসির ভাইপো মাধব। বয়সে অপুর থেকে কয়েক মাসের অথবা দিনের বড়। বেলাপিসির মা বাপ মরা একটা মাত্র ভাইপো মাধব।  সে এবাড়ির বাকি বাচ্চাদের মতোই একসাথে বড় হচ্ছিল। তবে মাধব যেন কেমন উল্টো প্রকৃতির। অথবা সেই হয়তো বিশ্বসংসারের পক্ষে একদম সঠিক মাপের। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার ভাবনা, তার ধারণা কোন কালে মিলত না। পদবী সিংহ হলেও এই বাড়ির মহামায়া সিংহবাহিনী নয়, ঘোটক বাহিনী। তবে এ বাড়ির পুজো বৈষ্ণব মতে হয় না। কোন মতে যে হয়, তা ও জানে না। তবে কাল যখন বড়দি মাধবের কথা তুলল, তখন সেই ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। মাধব নিজে হাতে দুর্গাঠাকুর বানিয়েছিল, সে কথা বেলাপিসি সকলকে সগর্বে বলে বেরিয়েছিল, তখন ঠাকুরদা বেঁচে। বেলাপিসি তাঁকে বলেছিল, কর্তাবাবা ছেলেটার হাতের পেত্থম ঠাকুর, দালানের এক কোনে যদি রাখতে দেন ...
     স্বভাবতই ঠাকুরদা বুঝিয়ে দেয় বেলাপিসির দাবি অমূলক, এক ঘটে দুই প্রতিমার পুজো হতে পারে না। অবশ্য ঈশ্বর যদি এক হয়, তবে প্রতিমার এত বিভেদ কেন? কোনকালে মাথায় ঢোকেনি অপুর।
ঠাকুরদার অনুমতি না মেলায় বেলাপিসির বাড়ির উঠোনে মাধব পুজো করেছিল। সে অপূর্ব পুজো, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রতিমার দিকে চেয়ে শুধু গান আর কান্না। সেই থেকে মাধবের নতুন বিশেষণ জুটল ‘ক্ষ্যাপা’। 
ঠাকুরদার জন্য অবশ্য বিনা অনুমতিতে পুজো করার জন্য পুলিশি ঝঞ্ঝাটে জড়াতে হয়নি বেলাপিসিকে। কাল বড়দির মুখে শুনল, মাধবক্ষ্যাপার পুজো নাকি এখন এই তল্লাটের সেরা পুজোগুলোর মধ্যে একটা। তবে তিথি নক্ষত্র মেনে সেই পুজো হয় না। মাধবের মর্জি হলে মা ভোগ পায়, নইলে সারা দিন উপোষী থাকে। বাড়িতে একটা দক্ষিণা কালীর মূর্তিও নাকি  স্থাপন করেছে মাধব। সে ঠাকুর খুব জাগ্রত। যে ঠাকুরদা মাধবের এই কর্মকান্ডের জন্য একদিন ওকে ‘ক্ষ্যাপা’ বিশেষণে বিশেষিত করেছিল, সেই ঠাকুরদারও  নাকি একবার কোন একটা পারিবারিক মামলা নিষ্পত্তির জন্য মাধব ক্ষ্যাপার সেই  ঠাকুরের কাছে মানত করে ফল পেয়েছিল। বিষয়টা মনে করে আপন মনে হাসতে লাগল অপু। ছেলেটা ক্ষ্যাপাটে জন্ম থেকেই। কিন্তু তা বলে ঠাকুরদাকে অবধি ঘোল  খাইয়ে  ছেড়েছে, এ কথা কল্পনা করলেই হাসি পায় বৈকি। মাধবের সঙ্গে অপুর খুব ভাব ছিল। অপুর কথাগুলো মাধব এমন ভাবে ব্যাখ্যা করত, যে মাঝে মধ্যে মনে হত এর চেয়ে সরল ব্যাখ্যা আর হয়না। আবার মাঝেমধ্যে এত জটিল করে কথা বলত,  যে মাথায় ঢোকা তো দূরে থাক। শুনলে রাগ ধরে যেত। কলকাতায় ঘুরতে আসা পঞ্চাশোর্ধ বিদেশি  প্রৌঢ়ের প্রেমে যখন হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন সেকথা প্রথম সে মাধবকেই  জানায়। তখন ও এতটা পাগল ছিল না। যদিও আসা  অবধি, তার দর্শন মেলেনি। তবে সে ক্ষ্যাপা ছিল তো বটেই। সে বলেছিল, প্রেমের রসে জীবন ঢেলে বৃথাই যাচ্ছে সময়তরী। তার চেয়ে চোখের চশমাখানা খুলে প্রেমের সাধনায় বস। দেখবি সিদ্ধিলাভ ঘটবেই। প্রেম কি অত সোজা রে! একি আমার পোষা চড়ুই? যে ফুরুৎ  করে উড়ে গেলেও দৌড়ে গিয়ে ধরে আনলুম। 
    সেদিন ওর কথার অর্থ বোঝেনি অপু, আজ বোধহয় একটু হলেও বোঝে। এই হেন মাধবক্ষ্যাপাকে একবার অপুর জন্য ছোটবেলায় বেধড়ক মার খেতে হয়েছিল।  যে ঘটনার কথা কাল বড়দি স্মরণ করিয়ে দিতে চাইল, তখন মাধবের ক্ষ্যাপামি ক্রমবর্ধমান। একদিন সকালে একটা ঘেয়ো নেড়ি কুকুরকে প্রায় ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় এই বাড়িতে এনেছিল মাধব। আসলে বেলাপিসি এখানে যতক্ষণ থাকত, ততক্ষন সে এখানে থাকত। মাধবকে বড় ভালোবাসে বাড়ির সকলে। আর যেখানে ভালোবাসার বসবাস, সেখানে শাসন করা বাঁধবে না, তাও কি হয়? তবে সেইবার কিন্তু পুরো দোষটাই ছিল অপুর। সে জানে এই বাড়িতে সাত পুরুষের শালগ্রাম শিলা আছে, তা সত্ত্বেও সে ঠাকুরদালানে এককোনে একটা কুকুরকে এনে রেখেছিল। ঘটনাখানা একটু পরিষ্কার করে খুলে বলা প্রয়োজন। আসলে পদবী না জুটলেও ক্ষ্যাপাটেপনা অপুরও  জন্মগত। সেই ছোট্টবেলা থেকে তাকে গান শোনাতে পুবদিকের সেই ছোট্ট ছাদে কত পাখি আসত, জানলা দিয়ে তারা কখনও কখনও  বারান্দার এ প্রান্তেও চলে আসত, অপু তাদের চোখ মেলে দেখত, মন দিয়ে তাদের গান শুনত। একটু যখন বড় হল একটা অর্ধমৃত  বিড়াল ছানাকে কোথা থেকে জোগাড় করেছিল। সে অর্ধমৃত বেড়ালছানাটি ওর কাছে মরতেই এসেছিল। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি অপু। সে  স্মৃতি অবশ্য খুব একটা মনে নেই। রোজই তো পৃথিবীর বুক থেকে কত সব প্রিয়রা খসে খসে পড়ে যায়, তাদের খোঁজ কে রাখে! তবে সেবারের মাধবের ঘটনাটা ওর স্পষ্ট মনে পড়ে গেছে কাল। কুকুরটাকে এ বাড়িতে আনার পর বাড়ির অনেকেই মাধবকে কটুকথা বলেছিল। ঠাকুরদা তখন মৃত্যুশয্যায়। এবাড়িতে নিত্য লোকজনের যাতায়াত লেগেই আছে। একসময় সেই কুকুর  গেল পাগল হয়ে। সেই সময়  মাধব রাতে বাড়ি যেত না। ওর কাছে পড়ে থাকত। সেই ঘেয়ো নেড়ি আনা কিন্তু অপুরই জেদে। অবশ্য অপু জেদ না ধরলেও মাধব তাকে আনতই। অবশ্য সরাসরি ঠাকুরদালানে হয়তো তার জায়গা হত না। অন্য কোন নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে  দিন যাপন করে, হয়তো আরও কিছুকাল পৃথিবীতে থেকে যেতে পারত সে। কিন্তু পৃথিবীর কপালে বোধহয় সেই সুখ সইবার নয়। সেই পাগল নেড়ি কুকুরকে বুক দিয়ে আগলে  রাখত সে সবসময়। একমাত্র ছোটকা ছাড়া কেউ  পাশে ছিল না। কিন্তু সেই নেড়ি  প্রথম ছোটকাকেই কামড়েছিল। ছোটকা বলেছিল, কাউকে বলিস না। কিন্তু এ যে ভারি সাংঘাতিক! বাড়াবাড়ি হলে রেবিজ বা জলাতঙ্ক অবধারিত। তাই সকলের অলক্ষ্যে ইঞ্জেকশন চলতে থাকল। এরপর সে রোজই এ  বাড়িতে কাউকে না কাউকে কামড়াতে যায়। অবলা জীব তাই বাড়ির সবাই ওকে আঘাত করতে পারে না। তবে তার থেকেও বড় কারণ বোধহয় মাধব। মাধবের জন্য কেউ ওর ধারে কাছে যেতে পারত না। কালের নিয়মে এল সেই দিন। যেদিন এই বাড়ির সকলে সেই নেড়ির  চির শান্তির ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সেই বিষ মেশানো দুধ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল মাধব। আর সেদিন মাধবকে বাড়ির সবাই যা নয় তাই  বলে তিরস্কার করল। মেজকাকা কঞ্চি দিয়ে ফালাফালা করে দিয়েছিল ওর পিঠ। অপু ইচ্ছে করলেও এক অজানা ভয়ে নীচে নামেনি। গোটা বাড়িতে তখন পাগলা কুকুরের কামড়ে দেওয়ার আতঙ্ক। বাড়ির ছোটদের নীচে নামার কড়া নিষেধ। বেলাপিসিও খুব মেরেছিল মাধবকে। তবুও সেই মূক মৃত্যুপথযাত্রীর কাছ থেকে একটুও সরেনি মাধব। দেওয়ালে মাথা ঠুকে মাধবের মাথা ফেটে গেছিল। সামনের দাঁতের খানিকটা অংশ ভেঙে গেছিল। তবু সে একটুও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেনি নিজেকে। যখন বেলাপিসি ওকে মারছিল, তখন অপু আর স্থির থাকতে পারেনি। নেমে এসেছিল নীচে। মাধবের মাথাটা ওর বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, সমস্ত ভয়, লজ্জা, বয়সের সীমারেখার রুচিবোধকে অগ্রাহ্য করে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল অপুর বুক। ছোটকাকাকে না জানিয়ে, বাড়ির বাকিরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলাবাহুল্য। ছোটকা এসে  ওর মাথায় সেলাই করাতে নিয়ে যায়। তখনও মাধব জানত না, ওর ফিরে আসার পর এবাড়ির দুই মৃত্যুপথযাত্রীর ছুটি হয়ে যাবে। সেদিনই মারা গেছিল অপুর ঠাকুরদা। সেইসাথে এই বাড়িতে মৃত্যুর আগে কটা দিন কাটাতে আসা সেই অবাঞ্ছিত অতিথির।
    চোখ বেয়ে জল নেমে এল। তবে এই অশ্রু কার জন্য বুঝতে পারছ না অপু! স্নান সেরে একটা ঘরোয়া প্লাজো আর কুর্তি পরে সে নীচে এল। ঠাকুরঘরের সামনে দাঁড়াল। অপুর একটাই পিসি, তবু যেহেতু বেলাপিসি বড়, তাই এই বাড়ির ছেলেমেয়েরা বেলাপিসিকেই বড় পিসি বলে মানে, আর শোভনাকে সবাই ছোটপিসি ডাকে। বেলাপিসি এখন ঠাকুর ঘর মুছে দালান মুছছে।  অনেক সুন্দর ঝকঝকে হয়ে গেছে এখনকার ঠাকুরদালান। দেখে  কেউ বলবে না, কোন এক কালে অপুর এক অদ্ভুত ছেলেমানুষীর জন্য একটা নিরীহ ছেলেকে কত মারই না খেতে হয়েছিল। এখানে অবশ্য সবাই ওর দোষই দেয়। সেদিনও দিয়েছিল, বেলাপিসি তো কাজ ছেড়ে দেবার কথাও তুলেছিল একবার। কিন্তু এই সমগ্র ঘটনায় কারোর কি কোনো দোষ আদৌ আছে? এই পৃথিবীর অসংখ্য অমীমাংসিত রহস্যের ফাইলে এই ঘটনার কথা কেউ কোনদিন লিখে রাখেনি। কাল বড়দি বলল, তোর জেদের জন্য বেচারা মাধবটাকে কত মারই না খেতে হয়েছিল! ওর জেদ? একটা মুমূর্ষু মূক  জীবকে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন নিজের কাছে এনে রাখা যদি জেদ হয়, তবে সেদিনের সেই জেদে নিজেকে শামিল করতে পেরে মনে মনে কিছুটা গর্ব হচ্ছে অপুর।  আবার বড়দি বলল, ছেলেটা তোকে খুব ভালোবাসত রে! 
    সেই সিদ্ধান্ত কে আবিষ্কার করল! ভালবাসাবাসির প্রসঙ্গটি উত্থিত হল কোথা থেকে? তবে কি মাধব সেদিন যা করেছিল সব অপুর জন্য! অপু তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল সে কারণে? ওর নিজের আত্মানুভূতি ছিল না! সে কথা তো মাধব বেশ ভালো বোঝে, তবে কেন সহ্য করে যখন কেউ বলে ওদের মধ্যে ভালবাসাবাসির সম্পর্ক! সব কিশোর কিশোরীর ঘন হওয়া সম্পর্ক কি প্রেম-ভালোবাসা! 
    —একি, বাইরে কেন দিদিভাই? ভেতরে আয়। ঠাকুমা ডাক দিল।
    অপু এখন বিধর্মী। ঠাকুর ঘরে শালগ্রাম শিলা আছে, প্রায় একশ বছরের পুরনো মা কালীর বিগ্রহ আছে। এসব ঠাকুমা কি বলছে! নাকি বয়সজনিত কারণে অপুর ধর্মান্তরনের কথা তার স্মরণে নেই। শোভনা বোধহয় অপুর মন পড়তে পেরেছে। সে বলল, অপু এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই আয়। আর পুরনো সেকেলে নিয়ম সব উঠে গেছে রে! আমাদের মায়ের কাছে আজকাল মোল্লাপাড়া থেকেও  লোকজন আসে। 
    -না ছোট পিসি তা নয়, আমি এখানে ঠিক আছি।
    -তুই না এলে কিন্তু ঠাকুরমশাই  রেগে  যাবে।  তুই ওই  ক্ষ্যাপা ঠাকুরকে আরও  ক্ষ্যাপাতে চাস? 
অপুর মরমে  যেন কেউ ঠান্ডা জল ঢেলে দিল। ক্ষ্যাপাঠাকুর মানে মাধব! তার সেই ছোটবেলার বন্ধু! সে নিশ্চয়ই অবাক হবে। ওকে চমকে দিয়ে ভারি মজা নেওয়া যাবে।বেলাপিসি ঠাকুমার উদ্দেশ্যে বলল, জানো মা, কাল যখন ঘরে ফিরে তোমাদের ক্ষ্যাপা ঠাকুরকে অপুদিদির কথা বললুম। তোমাদের ক্ষ্যাপা বামুন কি বলে জানো; বলে, বল কি পিসি!  বিসজ্জনের  দিন আবার বোধন। কালকে গিয়ে  তো আবার বোধনের মন্তর  পড়তে হবে গো! 
    -বেলাপিসি তুমি ওকে বললে কেন? আমি বেশ চমকে দিতাম!
    -কি করে জানব দিদি? তবে ও তোমার রূপখানা কি করে না দেখেই গড়গড়িয়ে বলে গেল  জানি নে বাপু!  বললে, দেখো পিসি, অপু যখন ঘরে ফিরল ওকে বাঁধে কারো সাধ্যি নাই। 
    -মানে? 
    -ও ক্ষ্যাপা ছেলের কথার মানে কি আমি অত বুঝি?
    -ও বেলাপিসি, তুমি কিন্তু বড্ড রোগা হয়ে গেছ! কত সুন্দর চুল ছিল তোমার। মনে আছে, আমরা তোমার পাকা চুল বেছে দিতাম? 
    -মনে থাকবে না আবার! যাও এবার ভেতরে যাও দিকিনি, ক্ষ্যাপা বামুনের কিন্তু আসার সময় হয়ে গ্যাছে। 
    -ও ঠাম্মা আমি ভেতরে গেলে যদি আবার কেউ রাগ করে? 
    -ও তুই চিন্তা করিস নে, মাধব ঠাকুরের উপর কথা বলে এমন সাধ্য এ বাড়ির কারুর নেই। তোর বাপেরও  নয়।
    কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি এমন একটা ঘটনা এত চকিতে ঘটে গেল যে ঠাহর করতে পারল না কেউই।  দুটো লম্বা লোমশ  হাত একটা গম্ভীর গলা সমেত ওর পা দুটোকে জড়িয়ে ধরল। অপু  এক লাফে ঠাকুর ঘরে ঢুকে মা কালীর ঘটের দিকে পিঠ করে বসে পড়ল। তখন হাত দুখানা  লম্বা শরীরটাকে পুরো ষষ্ঠাংগে সঁপে দিয়ে গম্ভীর গলায় অবিরত দুর্গাস্তব করে চলেছে। আরও একটা চমকে দেয়ার মতন বিষয়, এ ঘটনায় বাকিরা কেউই  রসিকতা, বদমাইশি বা ঠাট্টা  খুঁজে না পেয়ে প্রণাম করতে শুরু করেছে অপুকে। বেলাপিসির উলুধ্বনির টানে কেউ কেউ ছুটে এসেছে, আর সবাই প্রণাম করছে ওকে। কেউ একজন আবার শঙ্খ বাজাচ্ছে। মা পর্যন্ত এসে গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করছে অপুকে। ভণ্ডামির একটা সীমা থাকা দরকার। সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে লোকটা। সে এখন আর অবুঝ কিশোর নেই, একটা বদ্ধ উন্মাদ। ঠাকুরদা যাকে  ক্ষ্যাপা  বলেছিল, আবার শেষ বয়সে তারই  শরণাপন্ন হয়েছিল। আদৌ হয়েছিল কি? ঠাকুরদার শেষ সময়ে ও তো ছিল। ঠাকুরদা কখনোই এই বদ্ধ উন্মাদের  কাছে মাথানত করতে পারে না। 
    লোকটা এবার মুখ তুলেছে, কাঁদছে, অঝোর ধারায় কাঁদছে।

(ক্রমশ)

ধারাবাহিক 

প্রথম (পর্ব ৩)  




দোল

দেবব্রত ঘোষ মলয়


বাড়ির সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ, আসলে ফাঁকা জমি। তার চারপাশে নন্তে, বিশু, ঘন্টা, বাপি, বুল্টি, মিষ্টি, ইনু, সুলেখাদের বাড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাড়িগুলো - আসলে যেন একটাই পরিবার। সেসময়ে এরকমই হত। একজনের আনন্দ, সবাই খাবো তার বাড়ি, একজনের দুঃখ, সবাই চল তার বাড়ি। যাই হোক, তো সেই ফাঁকা মাঠের মাথায় এক নিকষ কালো ঝকঝকে আকাশ, তার কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, লক্ষ তারাদের নিয়ে দিব্যি বিরাজমান। সবার মাঝে মধ্যমনি এক বিশাল পূর্ণচন্দ্র, হাজারো বছরের পুরনো কিন্তু চির নতুন। তার নিচেই আমরা হাফপ্যান্ট আর ফ্রকরা ধেই ধেই করে নাচছি আর গাইছি - "আজ আমাদের ন্যারাপোড়া কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বল হরিবোল।" মাঠের মাঝে দাউদাউ করে জ্বলছে আমাদের ন্যাড়াপোড়া, যা গত তিনদিন ধরে আমরা তৈরি করেছি। একটা লম্বা পাকা বাঁশ বা শুকনো গাছের গুঁড়ি, তাকে এর বাগান, ওর মাঠ, তার ক্ষেত থেকে কুড়িয়ে আনা  বাঁশপাতা, শুকনো খড়, গাছের ডাল পাতা এইসব দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে খাড়া করানো হয়েছে। এখন সে জ্বলছে, তার ভিতরে আলু ছুড়ে দেওয়া হয়েছে, বুল্টি ঝালনুন এনেছে বাড়ি থেকে, আগুন নিভলেই হবে আলুকাবলি।
    তো সে সব হলো, মা বাবারাও শাসনের ছলে উৎসাহ দিলেন, বেশ রাতে যে যার বিছানায় ফিরলাম। শুলাম আর ঘুমিয়ে কাদা, তখন নিপাট আদুরে ঘুমন্ত মুখগুলো দেখে কে বলবে সারাদিন দস্যিপনা করেছে খুদেগুলো। দেখতে দেখতে সকালও হয়ে গেলো। আবার সাজ সাজ রব। আজ যে দোল। মা মা, জামা দাও। রঙ খেলার জন্য পুরোনো জামা প্যান্ট পরে, মুখে বোরোলিন মাখতাম সবাই, তাতে নাকি রঙ চেপে বসে না। এবার কাকা আর পিসিরা বড় বড় বালতিতে রঙ গুলতে লাগলো। দাদা আর বন্ধুরা বেলুন ভর্তি রঙ নিয়ে পাড়ায় ঘুরতে বেরিয়েছে। কিছুক্ষন পর আর কাউকেই চেনা যায় না, সব রঙ মেখে ভুত। ইতিমধ্যে চরকতলার পঞ্চানন মন্দিরের পাশে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের সবাই সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে খোল করতাল নিয়ে নগর কীর্তনে বেরিয়েছে। ওঁরা সবাইকে আবির দিচ্ছেন আর বাতাসা। মঠ। থেকে থেকে চারপাশ থেকে হোলি হে রব উঠছে। আকাশে উড়ছে আবির, নানা রংয়ের। রাস্তা, উঠোন সব রঙিন। কখন যে মাঝ দুপুর হয়ে গেল। মায়েদের টানাটানিতে কলতলায় বা পুকুরে। সে আরেক যুদ্ধ। গোটা গোটা সাবান শেষ, বাড়ি ফিরে দেখি রঙ যে কে সেই। খিদেতে পেট জ্বলছে সবার। একসাথে খেলাম বাড়ির সবাই। দুপুরে সামান্য বিশ্রাম আর তারপরই বিকেল হতে না হতেই মাঠে। এরপর সন্ধ্যা থেকে আমরা পাড়ায় সবার বাড়ি আবির নিয়ে চললাম। মা কাকিমা কাকু দাদুদের পায়ে আবীর দিয়ে প্রনাম। ওঁরাও কপালে আবির ছুঁইয়ে গাল টিপে বা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর জানান। তখন সবার বাবা মাই যেন নিজের লোক। ভালবাসার জন, কোন সংকোচ ছিল না। সব বাড়িতেই প্লেটে করে মঠ ফুটকড়াই আর মিষ্টি পেতাম আমরা। এখন ভাবলে অবাক লাগে, ওই কড়া চিনির তৈরি মঠ, তার নানা আকার, কোনটা মন্দির, কোনটা পাখী আবার কোনটা মেয়ে, আর চিনির আবরণে ঢাকা ছোলা বাদামের ফুটকড়াই খেতাম আগে, মিষ্টি ফেলে, কারণ ওই বস্তুদুটি বছরের এই এক-দুদিনই খেতাম আমরা। আবার রাত্রে বিছানায় যাবার আগে মন খারাপ করতাম , আবার কবে আসবে দোল।


ইলশেগুঁড়ি প্রকাশনের ছোটদের পত্রিকা 

‘‘কুঁড়ি’’ এখন পাওয়া যাচ্ছে।



ইলশেগুঁড়ির বই কিনুন, সুস্থ ও সুসাহিত্যের অংশীদার হন।



এবছর ইলশেগুঁড়ি সম্মান পেলেন প্রিয় সাহিত্যিক অজিতেশ নাগ। 





আজ বাংলা একাডেমি মেলার প্রথম দিনে ইলশেগুঁড়ি স্টলে উদ্বোধন হলো অত্যন্ত সুচারু গল্প সংকলন দুশো ৫৫। সঙ্গে আরো বেশ কয়েকটি বই। উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিকবৃন্দ। আজকেই ইলশেগুঁড়ি সম্মানে ভূষিত প্রিয় সাহিত্যিক অজিতেশ নাগ স্মারক ও পুষ্পস্তবক তুলে দিলেন সংকলন সম্পাদক পল্লববরণ পাল এর হাতে।





No comments

Theme images by luoman. Powered by Blogger.