ইলশেগুঁড়ি ই পত্রিকা ১১
ইলশেগুঁড়ি ই-পত্রিকা ১১
১৫ই সেপ্টেম্বর ২০২১
সুচিপত্র
আমার পুজো
বীরভূম জেলার লাভপুরের গ্রামীণ
দুর্গোৎসবের অভিজ্ঞতা কলমে- ডঃ রমলা মুখার্জী
দুর্গার ডাক - শীতল চট্টোপাধ্যায়
ভূবনজয়ী উৎসব - লালন চাঁদ হামিদুল
উৎসব - শান্তনু গুড়িয়া
ইয়াস ও দুর্ভোগ - স্নেহাশিস সামন্ত
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুজো - নীরেশ দেবনাথ
কবিতা
আনন্দের ইলশেগুঁড়ি - মুকুল সরকার
বন্ধু আনে সুখ - রঞ্জন ভাওয়াল
ই পত্রিকার দশম সংখ্যা প্রকাশিত হল। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে শারদ উৎসব আসছে। এ সময়ে বঙ্গ জনতা সব সমস্যাকে দূরে সরিয়ে হালকা পালকের মত সময় যাপন করতে চায়। ইলশেগুঁড়িও যাবতীয় গুরুগম্ভীর বিষয় এ ক'দিনের জন্য একটু দূরে রেখে এই সাতটি শারদ সংখ্যায় সুধী পাঠকদের সামনে উপস্থাপিত করছে শারদ অনুষঙ্গে কিছু স্বাদু লেখার সম্ভার। প্রিয় পাঠকরা তুষ্ট হলেই আমাদের এ প্রয়াস সার্থক হবে।
আ মা র পু জো
বীরভূম জেলার লাভপুরের গ্রামীণ দুর্গোৎসবের অভিজ্ঞতা
কলমে- ডঃ রমলা মুখার্জী
আমার বাড়ি হুগলী জেলার বৈঁচিতে, কিন্তু আমার বিয়ে হয়েছে বীরভূম জেলার লাভপুরে। লাভপুরের দুর্গাপুজোর রীতিনীতি আমাদের হুগলী জেলার থেকে পুরোপুরি আলাদা। এখানকার দুর্গাপুজোতে একটি প্রাচীন ভক্তিমণ্ডিত ভাবের সঙ্গে সমস্ত পুজোগুলির একত্রিত হবার সুন্দর একটি পরিকল্পনাও রয়েছে যা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
ষষ্ঠীর দিন বোধন যেমন হয় মন্দিরে মন্দিরে সেরূপই লাভপুরেও হয়। কিন্তু সপ্তমীর দিন থেকে সমস্ত পুজোগুলির মধ্যে একটি সমবেত প্রথা লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের সমস্ত পুরুষ ও ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন বস্ত্র পরিধান করে এসে প্রথমে জড়ো হয় আমার শ্বশুরবাড়ি বাবুপাড়ার পুজো “ওপর সদরে”। “ওপর সদরের” দুর্গাঠাকুরের পুজোর ঘট প্রথম ভরতে বের হবে এবং মন্দির থেকে ঘট নিয়ে পুন্যার্থীরা বের হয়ে প্রধান রাস্তায় অপেক্ষা করবে। ঘট ভরতে প্রত্যেক পূজা মণ্ডপ থেকেই দোলায় চেপে ঘট যায়, সর্বাগ্রে যায় “ওপর সদরের” দোলা, তারপর ক্রমান্বয়ে কুলীন পাড়া ও দত্ত পাড়ার দুটি দোলাও এসে হাজির হয়। সমস্ত বাজনদাররাও একসঙ্গে পিছনে বাজনা বাজাতে বাজাতে অগ্রসর হয় ও সব গ্রামের ছেলেমেয়েরাও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। কিছুটা অগ্রসর হবার পর ‘নবডাল সংঘের’ ঘট ভরতে যাওয়ার দোলাটিও ঐ শোভাযাত্রায় এসে যোগদান করে। এবার দলটি কয়েক গজ যাবার পর সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সন্নিকটস্থ দক্ষিণপাড়ার “নমো সদরের” দুর্গা মন্দিরের কাছে গেলে “নমো সদরের” দোলাটিও ঐ শোভাযাত্রায় যোগ দেয়। বাজনদাররা সবাই সমবেতভাবে বাজনা বাজাতে বাজাতে ও গ্রামের সবাই (মেয়েরা বাদে) শোভাযাত্রা করে স্টেশন সংলগ্ন লাইঘাটা পুকুরে ঘটে জল ভরতে যায়। বাদ্য হিসেবে থাকে ঢাক, ঢোল ও কাঁসর। এইসব বাজনদারদের পূর্বপুরুষরা জমিদারের আমল থেকেই জমি দিয়ে বহাল করা আছে। লাইঘাটা পুকুরে ঘট জলপূর্ণ করে আবার সবাই সমবেত ভাবে ফেরে। প্রত্যেকটি পুজোর মধ্যে আমি একটি সমবেত সংগীতের সুর লক্ষ্য করি, একটা একতা, একটা যেন মিলনমেলা। কোন প্রতিযোগিতা নয়, সবাই একসঙ্গে নির্মল আনন্দে মেতে ওঠে।
হুগলী জেলায় দুর্গাপূজায় সাধারণত বলিদান প্রথাটি নেই, কিন্তু লাভপুরের দুর্গাপূজায় বলিদান প্রথাটি মহা ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। তারও আবার নানান নিয়মকানুন আছে। অষ্টমীর দিন “ওপর সদর” ও “নমো সদরের” পুজোতে ধপধপে নিখুঁত সাদা রঙের "পাঁঠা" একটি করে বলিদান করা হয়। কোন কালো বা অন্য কোন রঙ যেন সেই সাদা ছাগশিশুটির গায়ে না থাকে। তবে পুজোকমিটিকে ছাগশিশু খুঁজতে হয় না, যার বাড়িতে এইরূপ ছাগশিশু জন্মলাভ করে সে স্বয়ং এসেই পুজোকমিটিকে অগ্রিম জানিয়ে দেয়। নবমীর দিন প্রচুর কালো পাঁঠা বলিদান করা হয়। মানতের পাঁঠাই বেশি থাকে, কিছু থাকে পুজো কমিটির। ওখানে পুজো কমিটিকে বলে "সরকারী"। এখানে লাভপুরে “ষোলকলা মানত” বলে একটি মানত বা পুজো দেবার প্রতিশ্রুতির প্রচলন আছে। একটি ছড়ায় ষোলোটি কলাই থাকবে এমন একটি কলার ছড়া, অন্যান্য ফল, এখানকার বিখ্যাত মন্ডা (একপ্রকার মিষ্টি) দিয়ে প্রধানত অষ্টমীর দিনই পুজো দেয় বৌ-মেয়েরা। তবে সব দিনই পুজো দিতে আসে সকালবেলায় সবাই। পুষ্পাঞ্জলি নারী ও পুরুষ উভয়ই দেয়। শাশুড়িমায়ের কাছে শুনেছি “ওপর সদর” ও “নমো সদরে”র পুজোতে দুটি দরজার প্রচলন ছিল। একটি ব্রাহ্মণ ও অপরটি অব্রাহ্মণদের পুজো দিতে আসার প্রবেশ পথ। কিন্তু ক্রমশ সে বর্ণবৈষম্য ঘুচে গিয়ে এখন সব বর্ণই মিলেমিশে পুজো দেয় মা দুর্গাকে।
অষ্টমীর দিন সকালে পুজো ও পুষ্পাঞ্জলির পর পাঁঠাবলির সময় মাটির সাজের প্রতিমা মুকুটে যে মাটির কলকা থাকে সেখানে পুরোহিত রাখেন পুষ্পসম্ভার। পাঁঠাবলির আগে শ্বেত-শুভ্র ছাগশিশুটিকে পুকুরে স্নান করিয়ে আনে তারাশঙ্করের গল্পে উল্লেখিত শশী ডোমের বংশধরেরা। অতঃপর ঐ ছাগশিশুটিকে সিঁদুর ও মালা পরানো হয়। পঞ্জিকায় উল্লেখিত বলিদানের সময় জেনে সেইসময় অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রাম থেকে বলিদান দেখার জন্য জনসমাগম হয় এবং তারা সমবেত হয় বলিদানের হাঁড়িকাঠ যে আটচালায় স্থাপন করা হয় সেই স্থানে। দর্শনপ্রার্থীরা সমবেত হয় “জয় মা জয় মা” ধ্বনি তোলে। এইভাবে কিছুক্ষণ ধ্বনি তোলার পর কোন অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে দুর্গামায়ের মুকুট থেকে একটি ফুল গড়িয়ে মাটিতে পড়ে, পুরোহিত মশাই “ফুল পড়েছে” বললেই সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে “ফুল পড়েছে” বলে। প্রধান পুরোহিত সেই ফুল দিয়ে ঐ শ্বেত ছাগশিশুটিকে উৎসর্গ করেন। এবার ছাগশিশুটিকে হাঁড়িকাঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং হাঁড়িকাঠে বেচারিকে আটকানো হয়। ঘাতক খর্গটি মন্দির থেকে নিয়ে এসে এককোপে ঐ ছাগশিশুটিকে বলি দেয়। বলিদান হওয়ার আগে পর্যন্ত কোন বাদ্য বাজানো নিষেধ। যখনই বলিদানের খর্গ ছাগটির শরীর স্পর্শ করবে তখনই ঢাকে কাঠি পড়বে ও সমস্ত বাজনদাররা বাজনা বাজাতে আরম্ভ করবে এবং ঠিক সেই মুহূর্তে ওদিকের কুলীন পাড়াতেও বলিদান আরম্ভ হবে এবং সেই কাজের জন্য রিলে ব্যবস্থার মত কিছু লোক মোতায়েন করা থাকত যারা খবরটি একে অপরকে “বাবুপাড়ায় লেগেছে রে” এই ধ্বনি তুলে হেঁকে হেঁকে মুহূর্তের মধ্যে খবরটি কুলীন পাড়াতে পৌঁছে দিত যাতে একই মুহূর্তে উক্ত দুই স্থানে বলিদান সম্পন্ন হতে পারে। বর্তমানে মোবাইলেই অবশ্য এই কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ঐ ঘাতক যাকে ওখানে ‘কামার’ বলে সে এবং বাজনদাররা এসে ‘কুলীন পাড়া’র বাজনদারদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং সবাই মিলিতভাবে “নমো সদরে” এসে উপস্থিত হয় ও ঠিক ঐ প্রক্রিয়াতেই বলিদান সম্পন্ন করে। অতঃপর ঐ শোভাযাত্রা "নবডাল সংঘে" এসে উপস্থিত হয় ও পুজা-অর্চনা করেন পুরোহিত। এখানে দুর্গার পটে বা ছবিতে পুজো হয়, বাকি সমস্ত জায়গার প্রতিমা হয় একচালে অর্থাৎ একসঙ্গে মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গনেশ থাকেন।
নবমীর দিন নবমীর পুজো-অর্চনার পর সব স্থানেই পুজোকমিটির গুটি কয়েক পাঁঠাবলির পর জনসাধারণের মানতে’র ছাগশিশু বলি আরম্ভ হয়। ছাগমুণ্ডগুলি ঠাকুরের কাছে নিবেদন করে ধড়টি বাড়ি নিয়ে গিয়ে পিঁয়াজ, রসুন ছাড়া ঘি ও মশলা দিয়ে রান্না করে ভক্তরা প্রসাদ খায়।
ওপর সদরের পুজোতে নবমীর দিন রাতে হয় ভোজ। তারজন্য ওপর সদরের শরিকদের পাড়ার পুকুর যার নাম “বাড়ি পুকুর” সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরা হয়। মাছের ঝোল, মুড়ির মাংস মানে ছাগশিশুর মস্তক অংশের মাংস (ঘাড় অঞ্চলে যেটুকু থাকে), সব্জি, আমড়ার চাটনি দিয়ে ওপর সদরের ভোজ হয়। কিন্তু ভোজের আগে সন্ধ্যেবেলা থেকে আরম্ভ হয় “কেষ্টযাত্রা”। গ্রামের লোকেরা ভাদ্রমাসের ভাদুপুজোর পর থেকেই মহড়া দিয়ে কেষ্টযাত্রার প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং ঐ নবমীর দিন সন্ধ্যেবেলায় সেটি ওপর সদরের আটচালাটিতে মঞ্চস্থ করে।
দশমীর দিন সকালে সবাই নতুন বস্ত্র পরিধান করে ফণীমনসার ডাল নিয়ে ঘট বিসর্জন করতে যায়। ঘট বিসর্জনের ঠিক আগে একটি পিতলের থালায় একটি একটাকার মুদ্রা, ধান, দুর্বা দিয়ে ঠাকুরের কাছে নিয়ে গিয়ে পুজো করাতে হয়, একে বলে ‘যাত্রা দেখানো’। যাত্রা দেখানোর পর ঘট বিসর্জন হয় আবার আগের মতই দোলায় চাপিয়ে, বাজনা বাজিয়ে। দোলা বহন করবে নতুন উপনয়ন হয়েছে এমন চারজন নবীন ব্রাহ্মণ সন্তান; তারা ধুতি, উত্তরীয় পরিধান করে থাকে। বিজয়া দশমীর দিন বড় মাছ খেতে হয়; পারিবারিক জেলে বা কেওটাকে দশমীর দিন কাপড়, নাড়ু ইত্যাদি দেওয়া হয় তার পরিবর্তে সে একটি ছোট পুঁটিমাছ ও বেশ বড় একটি কাতলা বা রুই মাছ দেয়। ছোট পুঁটিমাছটিকে সিঁদুর মাখিয়ে বাড়ির রান্নাঘরে রাখা হয় এবং সেই পুঁটিমাছটির পাশে এক বাটি দইও রাখা হয়। ঘট বিসর্জন করে ফিরে, মা দুর্গাকে প্রণাম করে বাড়ির রান্নাঘরে রাখা দই ও ঐ ছোট পুঁটিমাছটিকে দেখে প্রণাম করে তবেই সবাই গুরুজনদের প্রণাম করে। গুরুজনদের প্রণামের প্রচলন এখনও লাভপুরে বেশ আছে। লাভপুরের বিশেষত্ব হল নানারকমের নাড়ু বা ‘লাড়ু’ তৈরী করা হয় নানা উৎসবে। পুজোর সময় চিঁড়ে, খই, ছোলা, নারকেল, চোনা(বেসনের বোঁদের মত ছোট্ট ছোট্ট বড়া), সিঁড়ি(বেসনের লম্বা লম্বা ঝুড়ি ভাজার মত) ইত্যাদি দিয়ে গুড়ের পাক করে রকমারি নাড়ু বানানো হয়। দশমীর দিন সন্ধ্যায় ঠাকুর বিসর্জন বা ঘট বিসর্জনের পর থেকেই ছোটরা বড়দের বাড়ি গিয়ে প্রণাম করে এবং প্রত্যেককে বড়রা নাড়ু, মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে।
লাভপুরে সাঁওতাল গোষ্ঠীরও কিছু বাস আছে। লাভপুরে সাঁওতাল পুরুষকে বলে মাঝি ও সাঁওতাল স্ত্রীলোকদের বলে মেঝেন। একাদশীর দিন সকালে মাঝিরা মাথায় ময়ুরের পালক গুঁজে, মালকোচা মেরে ধুতি ও গেঞ্জি গায়ে মাদল বাজায় এবং মেঝেনরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে, মাথায় রঙিন ফুল গুঁজে ও গলায় রূপোর হাঁসুলি, খোঁপায় রূপোর ফুল, পায়ে রূপোর মল ও হাতে রূপোর মোটা বালা পরে মাদলের তালে তালে নেচে বাবুদের বাড়ি থেকে বকশিশ আদায় করে। ভদ্রলোকেরা চাল, আলু, টাকা দিয়ে এই নৃত্য বেশ উপভোগ করে।
লাভপুরে ষষ্ঠী থেকে একাদশী পর্যন্ত চলে দুর্গাপুজোর উৎসব ও এটি খুবই উপভোগ্য এবং আনন্দদায়ক এই মহামিলনের উৎসব। পুজো এলে মনে খুশির প্লাবন বয় সবার।
লাভপুরের ‘ফুল্লরা’ পীঠস্থানে রোজই সতীপুজো বা দুর্গাপুজো হয়, নিত্য ভোগ হয়। এখানে সতীমায়ের ফুল মানে গর্ভ প্লাসেন্টা পড়েছিল। তবে দুর্গাপুজোর সময় এখানেও ধুমধাম সহকারে ছাগবলি দিয়ে পুজো হয়। সেই বলির মাংস ছোট ছোট টুকরো করে কেটে মুসুর ডালের সাথে সেদ্ধ করে মাস-মুসুরি তৈরী করা হয় ও সেই প্রসাদ দর্শনার্থীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয় দশমীর দিন।
লাভপুরের দুর্গাপুজোর সব ভাল হলেও বলিদান প্রথাটি আমার ভাল লাগে না। এই বলিদান প্রথাটি যেন অবলুপ্ত হয় এটাই আমি মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করি।
দুর্গার ডাক
শীতল চট্টোপাধ্যায়
থমথমে ভয়, চারিদিকে ক্ষয় পাখিরা কিন্তু উড়ছে
থেমে আছে সব, থেমে নেই কাশ ফুটে শরতেই জুড়ছে ৷
শিউলি শাখাতে অভাব আসেনি ফুল সংসারও ফুটছে
পদ্ম বোঝেনি খারাপ সময় পুকুরেই জেগে উঠছে৷
ছোটরা মনের কষ্ট না-বুঝে দুর্গার আসা খুঁজছে
পুজোর হাওয়ার ডানা ছুঁয়েছে সব মনই এটা বুঝছে ৷
হোক মহামারী, মাঠভরা ধান সবুজ বয়সে দুলছে
রাংতা রোদেতে, হাওয়া ও শিশিরে, দুর্গার পথ খুলছে ৷
পায়ের শব্দ শুনেই বোধহয় মা-ও ,গিরিমাটি গুলছে
বড়বেলার সবাই নিজের ছোটবেলা ডেকে তুলছে ৷
দুর্গা 'চেয়েছে'শুনে মন্ডপে ছোটরাও সব ছুটছে
দুর্গার ডাক কানেতে যেতেই তাঁরই কাছে ওরা জুটছে৷
ভূবনজয়ী উৎসব
লালন চাঁদ হামিদুল
গুঁড়ি গুঁড়ি পাখনায় ভেসে যাচ্ছে ইলশেগুঁড়ি
ভেসে যাচ্ছে ইলশেগুঁড়ি মন
রৌদ্রজলে রিমঝিম
পূজো পূজো গন্ধে ভরে উঠছে পৃথিবীর সান্ধ্য উঠোন
মা আসছেন
মেঘের জাজিমে সাজানো ফুলের সুবাস
খুশির ইকির মিকির
বাতাসে ভাসছে অশ্বখুরের আওয়াজ
কাশবনে নীরব শিশির। মুখরিত পাখিদের আকাশ
সমুদ্র পাতায় কাগজের নৌকো
স্বপ্ন বাসর। মিলন উৎসব
রাতের শুকতারা হয়ে এখনো জেগে আছে
শিউলি ঝরা চাঁদ
বাবলা গাছ, শিরীষ ফুল
মা আসছেন। ঢাকে কাঠি। দামামা আতসবাজি
রিমঝিম ঝলমলে মণ্ডপ
যুদ্ধের কাড়া নাকাড়া। হেরে যাচ্ছে অশুভ শক্তি
উৎসব
শান্তনু গুড়িয়া
সিংহের থাবায় হিংসা, হিংসার গরিমা
যা দেবী সর্বভূতেষু, দেবী ত' মাটির প্রতিমা
প্রতিমাকে পূজা করি, নারীকে নির্যাতন
মহা ধুমধামে চলে উৎসব উদযাপন
আলোকসজ্জায় সেজেছে শহর, মন্ডপ দুর্গায়-অসুরে
হাই ডেসিবেলে বাজছে মাইক, হৃৎকম্প বিকট সুরে
আনন্দ স্বর্গীয় অনুভূতি, উল্লসিত মর্তবাসীগণ
কৌমার্য হারায় নারী, উৎসব চলে প্রতিক্ষণ |
ইয়াস ও দুর্ভোগ
স্নেহাশিস সামন্ত
হাওয়ার তোড়ে ভাঙল বাড়ি উড়ল ঘরের চাল,
ফুঁসছে নদী ক্ষিপ্র বেগে ভেঙেছে গাছের ডাল।
ভেঙেছে মন, ভেঙেছে হৃদয়,তলিয়ে গেছে তা জলের তলায়,
হাহাকার আর শোকের মাঝে কান্নাভেজা মর্মধ্বনি।
পাখির বাসা নেই সে এখন গেছে উড়ে কোন সে তলে,
ভিটে মাটি জলের তলায় নেই কোনও তার চিহ্নখানি।
দুর্যোগের এই দুঃসময়ে আর্জি শুধু বাঁচার,
প্রাণ টুকু আজ সঙ্গী করে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে ওরা
মুখে তুলতে দুমুঠো খাবার।
কি ছিল আর কি নেই তার হিসাব কষা বিলাসিতা,
বিভীষিকাময় 'ইয়াস' জানায় আমফান-আয়লার স্মৃতিকথা।
কুকুর, বিড়াল, গরু…
তারাও নেই হায় আর বেঁচে এখন,
জলের স্রোতে, ঝড়ের বেগে গেছে মৃত্যুর বন্ধ খোঁপে।
প্রকৃতির তান্ডবে আজ বড় অসহায় আমরা সকলে,
জানিনা কবে কাটবে দুর্ভোগ!নাকি যাবে সে ইতিহাস হয়ে একবিংশ শতাব্দীর অতলে।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুজো
নীরেশ দেবনাথ
আমার পুজো এই শব্দ যুগল শুনলেই আমার সবচেয়ে প্রথমেই মনে পরে ১৯৭১ সালের আমাদের পাড়ার বারোয়ারী দুর্গা পূজোর কথা।
সে বছর চতুর্দিকে ডামাডোল। রাজনৈতিক অস্থিরতা। পশ্চিমবঙ্গের আকাশে নকশালবাড়ির কালো মেঘ। তখন আমি মাত্র স্নাতক শ্রেণীর পরীক্ষা দিয়েছি। আমার মত সেই বয়সের ছেলেদের রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতেই বসে আছি।
আমাদের গ্রামের নাম তালবনা। পুরো গ্রাম জুড়ে অসংখ্য ছোট বড় হস্ত চালিত তাঁতে কাপড় বোনার কারখানা ও বড় বড় powerloom factory ছিল। আর সেগুলিতে প্রায় হাজার খানেক শ্রমিক কাজ করতো।
বর্ষাকালে এমনিতেই তাঁতের কাপড়ের বাজার মন্দা থাকে। আর সেবার শ্রাবণ মাসে একে জোর বর্ষা তায় আবার powerloom and handloom workers' association বোনাসের দাবিতে ধর্মঘট শুরু করলো। দীর্ঘ দিন দাবি দাওয়া না মেটায় গমগম করা গ্রামটি একেবারে নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। এই অবস্থায় বারোয়ারী পুজো হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিল। কারণ পুজোর জন্য খরচের টাকার সিংহ ভাগই আসে এই কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কাছ থেকে।
এই অবস্থায় বারোয়ারী পুজো কমিটির মিটিংয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারা যাচ্ছিল না পুজো হবে কী হবে না। শেষ পর্য্যন্ত বিদায়ী কমিটির সেক্রেটারী চিত্তবাবু প্রস্তাব দিলেন নীরেশ দেবনাথকে সেক্রেটারী করে একটা কমিটি তৈরি করা হোক। কারণ পূজো কোনো মতেই বন্ধ করা যাবে না। ডাক্তার বাবু বললেন, নীরেশ বাচ্চা ছেলে ও কী করবে?
চিত্তবাবু বললেন, নীরেশ আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারী, আবার কলেজের ছাত্র সংসদের একজন মেম্বারও ছিল। ও ঠিক সামলে নিতে পারবে। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাশ হয়ে গেলো আমার অবর্তমানেই। আমার মতামত ছাড়াই।
চিত্তবাবুই অনেক রাতে এসে আমাকে খবরটা দিলেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! বললাম, কী বলছেন? ক্লাব চালানো আর বারোয়ারীর পুজো পরিচালনা এক হলো? ক্লাবে সব ছোট ছোট ছেলেরা আছে, আর বারোয়ারিতে সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ। বড়রা আমার কথা শুনবেন কেন? তাছাড়া তাঁদের আমি কোনো কাজের কথাই বা বলবো কী করে?
চিত্তবাবু বললেন, তুই একটা ছোট্ট সাব কমিটি বানিয়ে নিবি। তাদের নিয়ে নিজের মতো কাজ করবি। যেমন সুকুমার, নেপাল, নিরাপদ এদের নিয়ে বা তোর যাকে যাকে নিলে সুবিধা হয় - বুঝলি না?
এরপর শুরু হলো কাজ। যাই হোক, ধীরে ধীরে সবই সুষ্ঠুভাবে চলতে লাগলো। পুজোর মন্ডপ তৈরি হলো, পাল মশাই প্রতিমা তৈরি করা শুরু করে দিলেন।
এরই মধ্যে পাওয়ার লুম ও হ্যান্ড লুমের মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে বোনাসের ব্যাপারে চুক্তি হয়ে যাওয়ায় আবার আগের মতই গ্রামের পরিবেশ গমগম করতে লাগলো।
দেখতে দেখতে মহালয়া এসে গেলো, তারপর ষষ্ঠী চলে এলো। সপ্তমী। ছেলে বুড়ো সবাই আনন্দে মেতে উঠলো। সন্ধ্যায় ধুনুচি নাচ প্রতিযোগিতা হয়ে পুরস্কার বিতরণ হয়ে গেলো। অষ্টমী। পুজো, পুষ্পাঞ্জলি হলো। পরে সন্ধি পুজো। সন্ধ্যায় আবৃত্তি ও কমিক প্রতিযোগিতা হয়ে পুরস্কার বিতরণ হয়ে গেলো।
পরের দিন নবমীর পুজোও ভালো ভাবেই শুরু হলো।
কিন্তু দুপুর হতে না হতেই ঘনিয়ে এলো দুর্যোগ। তখনকার দিনে টেলিভিশন তো ছিলই ন। গ্রামের দিকে ঘরে ঘরে রেডিও বা ট্রানজিস্টরও ছিল না। ফলে দুর্যোগ যে আসছে সেটা বোঝা যায় নি। অন্ধকার করে প্রথমে অল্প অল্প, পরে জোরে ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। বিকাল হতে না হতেই প্রচন্ড বেগে সাইক্লোন শুরু হয়ে গেলো। মাঝ রাত পর্যন্ত চললো তাণ্ডব। রাস্তা ঘাট জলে থৈ থৈ। মন্ডপের টিনের চালা উড়ে গিয়ে প্রায় একশ হাত দূরে গিয়ে পরে ছিল।
পরের দিন বিজয়া দশমী। রাস্তা ঘাট জলে জলাকার। অনেকের কাঁচা বাড়ি পড়েছে ভেঙে। বহু গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে রয়েছে। প্রায় দশটা নাগাদ অনেক কষ্ট করে সুকুমার , নেপাল , নিরাপদ এদের নিয়ে এসে শুভদার চায়ের দোকানে এসে জড়ো হলাম।
আমরা কথা বলছি এমন সময় কোথা থেকে ফণী দৌড়ে এসে আমাকে বললো, নীরুদা, নীরুদা, শিগগির পালাও; শিগগির পালাও! সব হাতে ছোটো আর পেটো নিয়ে তোমাদের বাড়িতে ঢুকেছে। কম সে কম পনোরো জন। আমি নিজে চোখে দেখলাম। দেখেই ছুট্টে এলাম তোমাকে বলতে। পালাও, শিগগির পালাও তুমি!
ফণীর ব্যাকুলতা আর ওর চোখ মুখের ভাব দেখে আমিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম।
নেপাল বললো, চল আমাদের বাড়ি লুকিয়ে থাকবি।
শুভদা জিজ্ঞেস করলো, কারা, কারা ঢুকলো রে ফোনে?
ফনী বললো, ওই কচিদা দলবল নিয়ে ঢুকেছে।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ও। তাহলে ঐ হিরু আর মদনাকে খুঁজতে গেছে বোধহয়।
শুভদা বললেন, তবু একটু সাবধানে থাকা ভালো। বরং ফনীই যাক। একটু আড় নিয়ে দেখিস। দেখে খবর দিস। নিরুর চিন্তা কী। ও নকশাল করে নাকি যে ভয় পাবে!
আমারও মনে একটু সাহস বাড়লো। মনে মনে ভাবলাম, তাইতো!
সেই সময় দুই বিবদমান রাজনৈতিক দল আর নকশাল যে যাকে সুযোগ পাচ্ছে খুন করছে। কে যে কার শত্রু, কে যে কার মিত্র বোঝা মুশকিল!
শুভদা বলে, জল ভেঙে কোথাও যেতে হবে না। চুপ করে বসে থাক। দেখি না কী করে!
ঘন্টা খানেক গ্রাম চষে বেরিয়ে কচির দলবল চার পাঁচ জনকে ধরে নিয়ে গেল আমাদেরই সামনের রাস্তা দিয়ে।
তার একটু পরে আমি বললাম, চল সুকু , ললিত বাবুর বাড়ি, দেখা করে আসি। ললিতবাবু বারোয়ারী পূজো কমিটির প্রেসিডেন্ট।
ললিত বাবুর বাড়ি গিয়ে জানলাম - কচিরা যে ছেলেগুলোকে ধরে নিয়ে গেছে তারা লালিতবাবু আর কাশী বাবুকে খুন করার ছক কষেছিল। ইয়াসিনের কাছে ছকের কাগজটা পাওয়া গেছে।
পরে সন্ধ্যা বেলায় জেনেছিলাম - রাসুমামা, ভানুদা,
ননী এবং আরো কয়েকজন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
এদিকে আমাদের পূজোর মন্ডপ তো ভেঙে গেছে। টিনের চালা উড়ে গেছে। পুরুত মশাইরা কো- অপারেটিভ- এর অফিস ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সন্ধ্যা বেলায় নমঃ নমঃ করে একটুখানি পূজো সারা হলো। রাস্তা ঘাট ভালো নয়। তাই বিসর্জন বাতিল করলাম।
একাদশীর দিন দুপুরে দুটো গরুর গাড়ী জোগাড় করে ভাঙ্গা গলা দুর্গা মায়ের প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা করলাম।
কিন্তু এত কষ্ট ও দুর্দশার মধ্যেও আমার আনন্দের সীমা রইল না এই দেখে যে আমার মাতৃ স্থানীয় সমস্ত মহিলাগণ বিসর্জনের এই মিছিলে যোগ দিয়ে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত সঙ্গে গিয়েছিলেন।
আজ একান্ন বছর পরেও যেন সেই দুর্গা পূজোর আদি অন্ত সব কিছু চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ভেসে উঠলো।
ভারতের বিভিন্ন শহরের দুর্গা পূজো দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে কিন্তু একান্ন বছর আগের সেই দুর্গা পূজোর ঘটনা আমার স্মৃতিপটে আজো অক্ষয় হয়ে আছে।
গ ল্প
অ-বলা কথা
নন্দা রায় পোড়েল
তখন কলেজে পড়ি। এক পয়লা বৈশাখের সকাল।বাকসাড়া বাজারের রেললাইন টপকে রিকশা নিলাম।যাব জিগাছায় এক বন্ধুর বাড়ি। উপলক্ষ্য বন্ধুর ভাইঝির জন্মদিন। বন্ধুর বাড়ির পাশেই আছে একটা ছোট্ট মাঠ। সেখানে পৌঁছে রিকশা থেকে নামতেই শুনতে পেলাম গরুর ডাক। সে ডাক উপেক্ষা করেই ঢুকে গেলাম বন্ধুর বাড়ি।
সারাদিন খুব হৈ হৈ করে কেটে গেল। মাঝে মধ্যে গরুর ডাকও কানে আসছিল। কিন্তু সারাদিন এত হৈ চৈ আর আনন্দে ছিলাম যে গরুর ডাক কানে আসলেও ভ্রুক্ষেপ করিনি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বেলা একটু গড়াতে সবাই মিলে ছাদে উঠলাম। পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে দেখি দিক চক্রবাল লাল করে রক্তিম দিনমনি ধীরে ধীরে কোন অজানা তিমিরে লীন হতে চলেছে। আর পূব আকাশটা সোনালী আভায় ভরে গেছে। একেই কি বলে গোধূলির স্বর্ণরাগ? জানি না! তবে আমার উদাসী বাউল মন কি যেন খুঁজে চলেছে দিক থেকে দিগন্তে! কী অপরূপ দৃশ্য! মুগ্ধ চোখে প্রকৃতির রূপ- রস আস্বাদন করছিলাম। সম্বিত ফিরল ত্রাহি স্বরে গরুর হাম্বা -হাম্বা রবে। মাঠের দিকে চোখ পড়তে দেখি সকালের সেই গরুটা আমাদের দিকে তাকিয়ে একই ভাবে হাম্বা হাম্বা করে ডেকে চলেছে। মনে খটকা লাগল সকাল থেকে এক ভাবে ডেকে চলেছে কেন? গরুটার কাছে যাব শুনে বন্ধু বলল---খবরদার যাস না। দেখছিস না এ দেশী গরু নয়? জার্সি গরু। শিং দুটো দেখেছিস? তাছাড়া গরুটা সাংঘাতিক! এ পাড়ার সবাই জানে গরুটা ভীষণ গুঁতোয়। তাই ওর ধারে কাছে কেউ যায় না। এমনকী ওর মালিকও ওকে সমঝে চলে।
কিন্তু গরুটার লম্ফঝম্ফ দেখে আমার খুব মায়া লাগল।সারাদিন একভাবে একই জায়গায় খুঁটিতে বাঁধা আছে।হয়তো ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। বেচারি অবলা প্রাণী! বন্ধুর মুখে শুনলাম গরুটাকে সকলে এত ভয় পায় যে ওর কাছে কেউ ঘেঁষে না। ওর মালিক সকালে মাঠে বের করে দিয়ে যায় আর সন্ধ্যেবেলায় অফিস থেকে ফিরে গোয়ালে ঢোকায়। সারাদিন ঠাঁ-ঠাঁ রোদে বেচারি দাঁড়িয়ে থাকে। অবলা জীবটার ওপর আমার ভীষণ মায়া লাগল। সকলের কথা অগ্রাহ্য করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম গরুটার দিকে। আমাকে দেখেই অত বড় জার্সি গরুটা এমন লম্ফ -ঝম্ফ শুরু করে দিল যা দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। হাম্বা হাম্বা করে এমন লাফাচ্ছে যেন মনে হচ্ছে খুঁটি শুদ্ধু উপড়ে ফেলে ওই বড় বড় শিং দুটো আমার পেটে ঢুকিয়ে দেবে। কী তেজী গরুরে বাবা! ভয়ে আমি আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসছি।তা দেখে গরুটা আরো লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।গরুটার মতলব বোঝার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।অদ্ভূত ব্যাপার! আমাকে দাঁড়াতে দেখে গরুটা কেমন শান্ত হয়ে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সাহস করে ওর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম। গরুটা ওর মাথাটাকে এমন ভাবে ওপর নীচে করে নাড়াচ্ছে যেন মনে হচ্ছে ও বলছে আয় আমার কাছে। এক প্রতিবেশী সাবধান করে দিলেন---ওই গরুটার কাছে যেওনা। বড্ড গুঁতোয়। আমি জীব-জন্তু ভীষণ ভালবাসি। তাই প্রতিবেশীর কথা উপেক্ষা করে দুরু দুরু বুকে দূর থেকে আলগোছে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। উপস্থিত সকলে হই হই রই রই করে উঠল। তেজী গরুটা নিমেষে শান্ত হয়ে গেল। সাহস করে আর একটু কাছে গিয়ে ওর গলায় হাত বোলাতে লাগলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও আমার বাঁ- চোখের নীচেটা গরম জিভ দিয়ে চাটছে আর ওর দুচোখ বেয়ে জল ঝরে পড়ছে। আমি চমকে উঠলাম। আনন্দে-দুঃখে-আবেগে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। মুংলি মুংলি তুই এখানে! তুইএত বড় হয়ে গেছিস মুংলি!মাঠে উপস্থিত লোকজন স্তম্ভিত হয়ে দেখল চার -চক্ষুর ফল্গুধারা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে একে একে আমরা সব গরুগুলোকেই বেচে দিতে বাধ্য হলাম। মুংলির যখন এক বছর বয়স তখন মুংলির মাকেও বাধ্য হলাম বিক্রি করে দিতে। সেদিন মুংলি সারাদিন মুখে কিছু তোলেনি। সর্বক্ষণ শুধু অস্থিরভাবে মাকে খুঁজেছে আর চিৎকার করেছে।এমনকী রাতে আমাদের কাউকে ঘুমোতে দেয়নি।বছরখানেক বাদে মুংলিকেও আমরা বেচে দিতে বাধ্য হলাম। প্রত্যেকবারই গরুগুলোকে আমরা বেচেছি আর ভয়ানক কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু মুংলিকে যখন নিতে এসেছে তখন আমরা প্রিয়জন হারানোর শোকে বেদনায় হাউ হাউ করে কাঁদছি। আর মুংলি? ও তখন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর বোবা চাউনিতে জল টস টস করে ঝরে পড়ছে। ওর নতুন মালিক ওকে মারতে মারতে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। ও কিছুতেই আমাদের ছেড়ে যাবে না। চার পায়ে শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।নতুন মালিক গলার দড়ি ধরে যখন টানছে তখন ও এক পা এগোচ্ছে আর দু পা পিছোচ্ছে। যখন দড়িতে জোরে টান পড়ছে ও পিছন ফিরে তাকাচ্ছে আর তারস্বরে হাম্বা হাম্বা করে চিৎকার করছে। যেন বলতে চাইছে---কষাইগুলো আমাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে আর তোমরা মুখ বুজে তা দেখছ? তোমরা কি বুঝতে পারছো না আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাইছি না? আমি যে তোমাদের বড্ড ভালোবাসি।
সেই মুংলি আজ বাছুর থেকে যুবতী গাভী। মা হতে চলেছে। ওকে অনেকক্ষণ ধরে আদর করলাম। মুংলিও জিভ দিয়ে চেটে চেটে আমাকে কত যে আদর করল!আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল।কাঁদতে কাঁদতে বললাম---কি করব বল মুংলি, তোকে ছেড়ে দিতে যে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম রে সোনা। ক্ষমা করিস। আমরা মানুষরা বড় বিশ্বাসঘাতক বেইমান!আমরা ভালবাসার মর্যাদা দিতে জানিনা রে। আমাদের মুখে ভাষা আছে কিন্তু হৃদয়ে তোদের প্রতি বোধ নেই।আর তোরা বোবা অবলা? অথচ তোদের হৃদয় এত বড়!
ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চলেছি। শাড়ির আঁচলে টান পড়তেই ফিরে দেখি মুংলি মুখে করে আমার আঁচল ধরে টানছে। তখনও ওর চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ছে। ছুটে গিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললাম---এমন করিসনা মুংলি। আমি কতদূর যাব বলতো? সন্ধ্যে হয়ে আসছে না? বলেই আঁচলটা সামনে টেনে ফিরে চলেছি।দিক-দিগন্ত কাঁপিয়ে ও হাম্বা হাম্বা করে ডেকে চলেছে।পিছন ফিরে দেখি ও এমন লম্ফঝম্ফ করছে মনে হচ্ছে খুঁটিটাই উপড়ে ফেলবে। আবার দৌড়লাম ওর কাছে।জড়িয়ে ধরে বললাম---এমন মায়ার বাঁধনে আর টানিস নারে মুংলি! আমি তোরই মত অসহায়। আমার সাধ্য নেই তোকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাবার। লক্ষ্মী সোনা তুই আমাকে আর পিছু ডাকিস না। কথা দিলাম মাঝে-মধ্যে আমি তোর কাছে আসব। তারপর মন শক্ত করে ফিরে চললাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। দূর থেকে শুনতে পাচ্ছি ওর হাম্বা হাম্বা ডাক আর লম্ফঝম্ফ!যেন ত্রিভুবনেশ্বরের কাছে ও কৈফিয়ত চাইছে---কেন, কেন দিলে এ পরাধীন জীবন? প্রাণই যদি দিলে তবে এমন শিকল বাঁধা প্রাণ কেন?
পরের দিন ট্রেনে করে কলেজ যাবার পথে দেখলাম একটা গরু লাইনে কাটা পড়েছে।কলেজে গিয়ে সেই বন্ধুর মুখে শুনলাম আমি চলে আসার পর মুংলি খুঁটি উপড়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসছিল। লাইন পার হতে গিয়ে অবলা মুংলি...
ক বি তা
আনন্দের ইলশেগুঁড়ি
মুকুল সরকার
শরতের ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিসাথে কতশত নবীন সৃষ্টি Iমন ভরে ওঠে শারদ সুরেইলশেগুঁড়ি ছড়িয়ে পড়েনিকট থেকে সুদূরে Iবৃষ্টি, সাথে রোদের বলয়,বন্ধ ঘরে আশায় থাকিযদি পাই শীতল মলয় Iবর্ণিল স্বপ্ন রচে ইলশেগুঁড়ি,তাই কাজ সেরে তাড়াতাড়িবৃষ্টির জগতে প্রবেশ করি Iইলশে গুঁড়ির মায়াবী পথেনির্মল আনন্দের ছড়াছড়ি II
বন্ধু আনে সুখ
রঞ্জন ভাওয়াল
বন্ধু হলো দুঃখের সাথী
তাহার সাথে সুখে মাতি
বিপদ কালে পাশে,
এক সাথেতে খেলা করি
মধুর সুখে হৃদয় ভরি
মনে শান্তি ভাসে।
ব্যাধি , জড়া আসে যখন
বন্ধু পাশে আসে তখন
বসে সেবা করে,
সাহস জোগায় ব্যথা বুকে
সুস্থ করে হাসি মুখে
আশায় বুক ভরে।
ধরায় বন্ধু আসে বলে
খুশিতে এই জীবন চলে
প্রাণেতে সুখ রহে,
বন্ধুর মত দোসর য়ে নাই
তাঁর কাছে শান্তি যে পাই
সুখের বন্যা বহে।
প্রকাশ আসন্ন
No comments