Header Ads

Header ADS

ই পত্রিকা ১০



৮ই সেপ্টেম্বর ২০২১

সুচিপত্র

আমার পুজো 

আমার পুজো - দেবব্রত ঘোষ মলয়
মাটির মেয়ে ও আমি - সুদীপ্ত পারিয়াল 
উৎসবে অনটনে - মানসী গাঙ্গুলী 
পুজো মানে - গোবিন্দ মোদক  
কবিতার এক ডজন বান্ধবী- অসিত কুমার পাল

কবিতা 

আকার - সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
উদাসীন সঙ্গম - জয়ীতা চ্যাটার্জী
নীরব ভালোবাসা - অমিতাভ মাইতি

গ ল্প  

বর্ষা - সুস্মিতা শীল
হাড়গিলের দিনলিপি - সুদীপ পাঠক 
উইকেন্ড - সুমন দে

আমার পুজো

দেবব্রত ঘোষ মলয়


একটা শিউলি গাছ পুঁতেছি নিঃসঙ্গ বাগানে
বুকভরে গন্ধ নিলাম দু হাতের আঁজলা ভরে
কি আশ্চর্য, সেই পুজো পুজো শিশির আদর
দূরে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ ...

সেবার, শিউলি তলায় টুকি, সাদা টেপ ফ্রক
কি বায়না, সব ফুল পেড়ে দিতে হবে
দিতেই কি খুশি, মুঠো খুলে নারকোল নাড়ু
ওর সাথে ভেসে আসে সবুজ ধানের খেত ...

আরো একবার, তখন একটু বড় দিদিদের সাথে
নবমীর নিশি রাত, হ্যাজাক আলোয় মায়া
সিরাজের তরবারি আমার দুচোখ জোড়া ঘুম
দিদির বন্ধু বুকে মাথা চেপে ধরে ... মিষ্টি গন্ধ এক ...

শিউলি ফুটলে গ্রাম ঝলমলে হাসি
মহালয়া পলকেই বিজয়ার রাত
রাতেও স্বপ্নে ভাসে অষ্টমী অঞ্জলি
প্রথম শাড়ির ওই ঝলমলে হাসি ...

আজও কি গন্ধ থাকে শিউলির রঙে
ঢাকিকাকা আসে তবু বাজনা কোথায়
পুজো সংখ্যার সেই রাতজাগা রং
ভোররাতে বাড়ি ফেরা স্বপ্ন অতীত

এখন নিদ্রা শুধু ঘুমহীন চোখে ...



মাটির মেয়ে ও আমি

সুদীপ্ত পারিয়াল 


গতবছর মহালয়ার আগের রাতে আমি সারারাত ঘুমাইনি। না, মহালয়া শোনার উৎসাহের জন্য নয়। সেবার কোনও একটা ইউটিউব চ্যানেলের প্রযোজনায় প্রথমবার একটা বড় কাজ করেছিলাম। মহালয়ার সকালে সেটার শুভমুক্তি ছিল। এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ সারারাত আমায় আদর করেছে। প্রতিটা মুহূর্তে কত সহস্র অনুরণন যে অন্তরমহলের বিরাট প্রান্তরখানা দিয়ে ছুটে বেরাচ্ছিল তার ইয়ত্তা নেই। সব থেকে বড় কথা, কাজটা কতটা সাফল্য পাবে সেই চিন্তা ছিলনা। ছিলনা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির কোনও ভাবনাও। ছিল শুধু এক অনাবিল আনন্দ, নির্মোহ কৌতূহল, আমার কাজ  অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই। শুধু তাই নয় তাদের ভাললাগা, মন্দলাগা, ভুল ত্রুটি পর্যবেক্ষণ আমার আগামী দিনের পথকে সুনিপুণ করতে সহায়তা করবে।
শুরুতেই একটু অন্য কথা বলায় পাঠক হয়তো বিভ্রান্ত হবে; আসলে যে শিরোনামে লিখতে বসা, তার জন্য এতটুকু গৌরচন্দ্রিকা না করলেই নয়। ফিরে যাই আমার প্রথম জ্ঞানবেলায়, একান্নবর্তী বাড়ি না হলেও আমাদের বাড়িতে ছিল নানা জনের সমাহার। তাই আমার পুজো বললেই আমার সেই দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়, 
মহালয়ার খুব ভোরে বিরুপাক্ষের কণ্ঠে আপামর বাঙালীর মতন আমাদেরও ঘুম ভাঙত। ঘুম চোখে দাদুর ঘরে গিয়ে মেঝেতে মাদুর পেতে আমরা বসতাম, দাদুর কাঠের টেবিলটার ওপরে রাখা ছোট্ট রেডিওটায় কেমন করে কে জানে সুপ্রীতি ঘোষ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়রা ঢুকে পড়ত। আর সেই অনুষ্ঠান চলাকালীনই কখন যেন পুজো পুজো গন্ধ লেগে যেত আমাদের সকলের গায়ে। বছরের ওই একটা দিনই রেডিও যেন সকলের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। মায়ের মুখে গল্প শুনেছি আমার দাদামশাই নাকি মহালয়ার দিন খুব ভোরে উঠে রেডিওটা মালা দিয়ে সাজাতেন। মায়েরা সবাই মিলে শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনত, সেইসব দিন সত্যিই যেন কোনও রূপকথার গল্পের মতই সুন্দর। আমাদের বাড়িতেও সেই সময় একটা শিউলি গাছ ছিল। প্রতি শরতপ্রভাতে সে তার পুষ্পবৃষ্টির মাধ্যমে নতুন দিনকে স্বাগত জানাত। আর ঠিক এখানেই দেবীপক্ষের সূচনা, নতুন দিনের আগমন, পূর্ব পুরুষদের তর্পণ সবকিছু মিলিয়ে ঝুলিয়ে যেন প্রতি বছরই নতুন মনে হত বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ। এক নতুন শিহরণে প্রতিবছর আমাদের শারদ আবাহন নতুন মাত্রায় উন্নীত হত। আরেকটু বড় হয়ে দূরদর্শনে এক জীবন্ত দুর্গাকে দেখতাম, আর আমার শিশুমন মনে মনে কল্পনা করে নিত এতদিন রেডিওতে যে নারীমূর্তিকে কল্পনা করে এসেছি এই বুঝি সেই মহামায়ার মেয়েটির  রক্তমাংস রূপ, কয়েকদিন পরেই পাড়ার প্যান্ডেলে একচালায় সপরিবারে তাকে দেখতে পাবো। প্রতি বছর পঞ্চমীর সকালে আমাদের পাড়ার ঠাকুর দেখা যেত, আগের দিন অনেক রাতে ঠাকুর নিয়ে আসত পাড়ার ছেলেরা। তাই ভোরে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে হলেও একবার সেই মাটির মেয়েকে দেখে আসার প্রবল টানকে কখনই উপেক্ষা করতে পারিনি। আমি পুজো মানেই সকলের কাছে শুনতাম আনন্দ, একসাথে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, নতুন নাটক দেখা, নামি দামী শারদ সংখ্যা সংগ্রহ, অনেককে তো  পুজোর সময় শহর  ছেড়ে বাইরে যেতেও দেখতাম; কিন্তু সত্যি বললে কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা। সেই মাটির মেয়েটা প্রতি বছর আমার জন্য একরাশ মন খারাপ নিয়ে আসত, পাড়ার পুজোটা বলতে গেলে আমাদের বাড়ির পুজোর মতনই। তবুও সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতা! মাইকে কখনো কিশোর কুমার-আশা ভোঁসলে, কখনো মান্না দে’র বিরহ, কখনো বা সানাইয়ের করুণ বিষাদসুখ আমায় আচ্ছন্ন করে রাখত। এসব ভাবনা শুনে পাঠক আমায় পাগল ভাবতেই পারেন। কিন্তু এই আচ্ছন্নতা যত বড় হয়েছি ততই যেন প্রকট হয়েছে। একাকীত্ব যদি কোনও রোগ হয়, তবে আমি তার ভুক্তভোগী, আর তার প্রমাণ পুজো এলেই আমি টের পেতাম। তথাকথিত বন্ধুমহল সেইভাবে আমার কোনও কালে গড়ে ওঠেনি; আর ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে বাইরে যাওয়ার অনুমতিও ছিলনা। তাই আমার পুজো  আমার আমির সাথে নিভৃত যাপনে কাটত। সবার আগে মন কাড়ত ঢাকিভাইয়ের সাথে আসা একটা ছোট বাচ্ছা ছেলে। বয়স হয়তো আমার থেকেও কম। শুধু আমাদের প্যান্ডেল বলেই নয় সব পুজো মণ্ডপেই এমন করুণ মুখগুলোকে করুণ অভিব্যাক্তি নিয়ে কাঁসি বাজাতে আমাকে দেখতে হত। অনেকে আমার মন ঠিক করার জন্য বলত, আরে ওরা তো পয়সা পাবে, তাই আসছে। আমার এহেন তীব্র ঘটনার এমন সরলীকরণ মোটেই ভাল লাগত না। আমার এক পিসির ছেলে আমার থেকে মাত্র একদিনের ছোট। পুজোয় প্রতিবার ওরা আসত। আমার কাছে পুজো বলতে সেই ভাইয়ের আসাটা এক অন্যরকম ভাললাগা ছিল। তবে সেই মাটির মেয়ে এখানেও আমার জন্য মন খারাপ লিখে রাখল, একটু বড় হওয়ার পর তারাও আসত খুবই কম। যখন আমি একটু বড় হলাম, আমার মধ্যে এক অন্য আমিকে আবিষ্কার করলাম। সেটা হল শিশুপ্রীতি, আমি বরাবরই ছোটদের সাথে মিশতে খুবই পছন্দ করতাম এবং করি। পাড়ার পুজোয় ক’দিন আমার মনে তাই এক অন্যরকম আবেশ কাজ করত, মাটির মেয়েকে এক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা আবশ্য কোনকালেই জানানো হয়নি। কিছুকাল পরে বুঝলাম না জানিয়ে বোধহয় ভালোই করেছি। কারণ আমার পরিচিত সেই ছোটদের মহল আমার অজান্তেই কখন যেন বদলে গেছে। তাদের নিজস্ব গভীর গোপন জগৎ তৈরি হয়েছে। তারা তাদের চারদিকে এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে বারবার বোঝাতে চাইল, আমি বড়ো বেমানান।
আমার কাছে পুজোর একাল সেকাল বলতে সত্যি কোনও কিছু মনে হয়না। কারণ পরম্পরার একটা ঐতিহ্য থাকলেও তার একটা সুনিপুণ পরিমার্জন প্রয়োজন। নইলে এই প্রবহমানতা থমকে যাবে। আমার এই ধারণার সাথে বোধহয় বাস্তবিক জীবনে আমি স্ববিরোধী। তাই তো প্রতি বছর আমার জন্য সেই মাটির মেয়ে নতুন নতুন মনখারাপ ও মনকেমন নিয়ে আসে। কতবার ভেবেছি নতুন করে নিজেকে আর বিলিয়ে দেব না। কিন্তু আমার সেই মাটির মেয়ে যেন আমাকে বারেবারে বোঝাতে চায় জীবন পরিবর্তনশীল। তাকে মেনে নিতে না পারলে পিছিয়ে পড়তে হবে।আমি যেন সত্যিই তাই এক পিছিয়ে পড়া ছায়ামূর্তি। আজকাল আর মণ্ডপে গিয়েও বসতে ইচ্ছা করেনা। শুধু দূর থেকে আমার ছেলেবেলার মাটির মেয়েকে দেখি আর ভাবি, ক্রমশ কত দূরে সরে যাচ্ছি আমি ওর থেকে; আমার এই বড় হতে শেখা মন বিজ্ঞান, পুরাণ, দর্শন, অর্থনীতির খিচুড়ি জেনে বুঝে আমাকে যেন ওর কাছ থেকে টেনে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। আজ অকালবোধনের সেই মেয়েটাকে ইচ্ছা করলেই মুঠোফোনে আঙুল চালিয়ে যখন তখন দেখতে পাওয়া যায়, ইচ্ছা হলেই মাঝ-দুপুরেও শুনতে পাওয়া যায় সেই ঘুম ভাঙানিয়া বিরুপাক্ষকে।
তবে সেই মাটির মেয়ের রহস্য প্রতিবছর আমার কাছে নতুন লাগে। আমার জন্য গুছিয়ে নিয়ে আসা মনকেমনগুলো দুঃখবিলাসীর মতন সারাবছর আমি সাজিয়ে রাখি। ইচ্ছা হলেই প্রিয় অলঙ্কারের মতন তাদের পরি। মন চাইলেও অবহেলা করতে পারিনা। সে যে আমার আজীবনের বন্ধু ও অরিও বটে, প্রয়োজনে যেমন তার কাছে প্রাণ খুলে কথা বলি। রেগে গেলে গালমন্দ করতেও ছাড়িনা। তখন সত্যি আমি ভুলে যাই ওইসব  বিজ্ঞান, পুরাণ, দর্শন, অর্থনীতির কচকচানি। এসব নিয়ে ভালোই আছি আমি আমার মন কেমনের আলমারি আর আমার সেই ছেলেবেলার মাটির মেয়ে। শুধু বিগত সময়ের স্মৃতিরা খুব বিব্রত করে যখন তখন। চোখে আঙুল ডলে বার করে আনে অশ্রুকে। তখন সেই মাটির মেয়েই কাঁধে হাত রাখে, আমি সব ভোলার অভিনয় করে আবার এগিয়ে যাই সামনের দিকে।

উৎসবে অনটনে

মানসী গাঙ্গুলী 


       পঞ্চমীর সন্ধ্যা, ঢাকীরা এসে হাজির পাড়ায় পাড়ায়। ঢ্যাংকুরাকুর ঢাক বাজিয়ে জানান দিতে থাকে তারা। আমরা ছোটরা সব সদলবলে বেরিয়ে পড়ি বাড়ী থেকে, ঢাকের বাদ্যি শুনে। খানিক বাদে ক্লাবের ছেলেরা লরীতে করে ঢাকীদের নিয়ে ঠাকুর আনতে যাবে। মা দুগ্গা আসবেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে মহাসমারোহে, ঢাকের বাদ্যির সাথে, মুখ ঢেকে। ষষ্ঠীর আগে মায়ের মুখ দেখা যাবে না। ক'দিন আগে থেকেই আমরা ছেলেপিলের দল প্যান্ডেলের বাঁশ ধরে ঝুলে কত খেলাই না করলাম। পুজোর আনন্দে আমাদের চোখমুখের ভাষা গেছে পালটে। রোজই সবাই দিন গুনি, আর কতদিন। নিজের শৈশবের এই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে আমার।
      আজ আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে, তারা চাকরীসূত্রে দূরে, কাছছাড়া, পুজোয় আসতেও পারে না। তাই পুজো এখন আমাকে নতুন কোনো আনন্দ দেয় না। বয়স বেড়েছে, শরীরও অক্ষম হচ্ছে, ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার উৎসাহও তত নেই যদিও একটু-আধটু ইচ্ছে করে। কিন্তু গাড়ী নিয়ে চলাফেরা করার উপায় নেই। রাস্তায় যেমন ভিড়, পার্কিং পাওয়া যায় না, তাই সেটুকু ইচ্ছেও মনের মাঝেই চুপসে যায়। শৈশবের স্মৃতিচারণ করেই পুজোটা কাটে। তখন শৈশব জীবনটা ছিল অন্যরকম, এখনকার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।
         ছোটবেলায় ঢাকীরা এসে গেলেই বুকের ভেতরেও যেন ঢাক পিটত আমার। ঢাকীদের আশপাশেই সেক'টাদিন ঘুরে বেড়াতাম। ছোট্ট ছেলেটা কাঁসর বাজাত, সে আমারই বয়সী। আধময়লা কোঁচকানো জামা পরনে, তার সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। ঢাকীদের বাজনার তালে তালে আমিও নাচতাম পাড়ার অন্যান্য ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। সে বড় আনন্দের দিন ছিল। ঘুম ভাঙ্গত ঢাকের কাঠির আওয়াজে, বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে। কখন প্যান্ডেলে ছুটব সেটাই একমাত্র চিন্তা। বইপত্তর সব ক'দিনের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছে। সে উৎসব বড় আনন্দের। আজ এত সমারোহ চারিদিকে তবু মনে আমার সে আনন্দ নেই।
      বারোয়ারী পুজো ঘিরেই ছিল আনন্দ উত্তেজনা। সে পুজোয় পাড়া-পড়শী সকলে সানন্দে অংশগ্রহণ করতেন, সেটাই তখন ছিল সবার বাড়ীর পুজোর মতই। ছেলেরা সব দোকান-বাজার বাইরের কাজ করতেন আর মেয়েরা ফুল তোলা, পুজোর জোগাড়, ভোগ রান্না। ছেলেরা সেই ভোগ বয়ে নিয়ে আসতেন পুজো মন্ডপে। প্রসাদ বিতরণ করতেন। এইভাবে মিলেমিশে নিজেদের বাড়ীর পুজোর মতই ব্যস্ত থাকতেন। তখন এত বাহ্যাড়ম্বর ছিল না, সাবেকী মূর্তিরই পুজো হত মন্ডপে মন্ডপে। এখনকার মত থিমের পুজো শুরু হয়নি তখন, ছিল না বারোয়ারীদের মধ্যে রেষারেষি, উৎসবটাই সবাই উপভোগ করত। এত বড় বড় বাজেটের পুজো তখন ছিল না বরং প্রায় সব বারোয়ারীই একদিন দরিদ্রনারায়ণ সেবার ব্যবস্থা করত, এখনও অনেক জায়গায় হয় যদিও। নিজেদের পাড়ার ঠাকুর ছাড়াও লোকে আশপাশের ঠাকুর দেখতে যেত এখনকার মতই, তবে এখন যা ভিড় হয় সুস্থভাবে ঠাকুর দেখারই উপায় থাকে না। যুদ্ধ করতে পারো তো যাও ঠাকুর দেখতে। এখন কোথাও কোথাও বিশাল বিশাল ঠাকুর হয় যা আগে ছিল না, খুবই সাধারণ মানের ঠাকুর হত তখন। এখনকার মত থিমের ঠাকুরের ধারণাও তখন ছিল না। ইদানীং তো আবার থিমের সঙ্গে ম্যাচ করে আবহ সঙ্গীত হচ্ছে, বিখ্যাত সব সুরকার তাতে সুরও দিচ্ছেন। এলাহী ব্যাপার। এক একটা পুজোর বাজেট এখন লাখ ছাড়িয়ে কোটির ঘরে। কোথাও সোনার শাড়ী পরা মা দুর্গা, কখনও বা তিনি হিরের মুকুট পরেন, বিখ্যাত ডিজাইনার দিয়ে সেসব শাড়ীর ডিজাইন হচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সোনার পাতের ওপর ডিজাইন হচ্ছে, সব কলকাতায় এনে অ্যাসেম্বল করে তৈরী হচ্ছে মায়ের শাড়ী। কোথাও বা মন্ডপ সজ্জায় বিখ্যাত ডিজাইনার আর ভিড় সামলাতে কলকাতা পুলিশের হিমসিম অবস্থা। মফস্বলে এতটা না হলেও কিছু কিছু ঠাকুরের মন্ডপে ঢোকার উপায় থাকে না।
       আগের পুজোয় যেন প্রাণের সাড়া পাওয়া যেত, আজ এত হৈ চৈ, আলোর রোশনাই, লাখ লাখ টাকা খরচ করেও যেন সে আনন্দ মেলে না। তবুও কাশফুল ফোটে আগের মতই, সকালে সোনা রোদ্দুর পুজোর গন্ধ নিয়ে রোজ হাজিরা দেয়, জানান দেয় পুজো এসে গেছে। এত আড়ম্বর চারিদিকে তবু পথশিশু ছেঁড়া জামা গায়ে, রুক্ষ মাথায় হাত পেতে ঘুরে বেড়ায়। এই বৈষম্য যে বড় পীড়া দেয় আমায়। অবশ্য বিভিন্ন সংস্থা এখন ওদের জন্য ভাবছে। কতটুকুই বা সে ভাবনা, হয়তো পুজোয় একটা নতুন জামা বা একবেলা ভরপেট খাওয়া। তারপর তো আবার তারা পথেই পড়ে থাকবে, আবার পুজো আসতে আসতে সে জামাও হবে শতচ্ছিন্ন।
        সেকালে প্রতিটি পাড়ায় কিছু অবস্থাপন্ন ব্যক্তি গরীব দুঃখীদের পুজোয় বস্ত্রদান করতেন। এখন আর তেমন দেখি না, সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। মানুষ এখন বড় স্বার্থপর হয়ে গেছে। যা করে আজকাল, কিছু সংস্থা। তখন পাড়ায় বাঁশের প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হলেই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সেই বাঁশ ধরে ঝুলে দোল খেত, তাদের যে পুজো তখনই শুরু হয়ে যেত। আজ বাচ্চারা আর বাড়ীর বাইরে খেলতে পায় কোথায়, খেলা তো সব কম্পিউটারে, মোবাইলে। যুগ বদলেছে, মানুষের মানসিকতা বদলেছে, এই নিয়েই মানুষ এখন খুশী। আমাদেরও সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে।
       এখন ঠাকুর উদ্বোধনেও কত ঘটা, বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের দিয়ে উদ্বোধন হচ্ছে, কোথাও বা মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করছেন। সবই আজকাল দেখনদারি। আগে পুজো সংখ্যার গানের বই বেরত, পাড়ায় পাড়ায় সেই গান বাজত। নতুন সে গান শোনার কত আগ্রহ ছিল আমাদের ছোটবেলায়। সে ছিল অমলিন আনন্দের দিন। আর সাহিত্য পত্রিকা তো ছিলই তবে এখন কদর অনেক কম। ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে বাংলা পড়ায় আগ্রহ কমে গেছে। তাছাড়া বিসর্জনেও এখন কত আড়ম্বর, সবই অত্যন্ত জাঁকজমক পূর্ণ। আগে বিসর্জনে সিদ্ধি খাবার চল ছিল, এখন মদ্যপান করে পা টলমল করতে করতে ঠাকুর বিজয়া করা হয়। বিজয়াদশমীতে কলাপাতায় সিঁদুরগোলা দিয়ে খাগের কলমে করে শ্রীঁ শ্রীঁ দুর্গা সহায়, তিনবার করে লিখে তবে গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম আমরা ছোটরা। গুরুজনেরা মাথায় হাত রেখে গায়ত্রী জপ করে দিতেন।
       যখন বড় হয়েছি, বুঝতে শিখেছি, দেখেছি কত বৈষম্য চারিদিকে। এত আড়ম্বর চারপাশে, সবাই যখন নতুন জামা গায়ে পুজোমন্ডপে, ঢাকীদের গায়ে পুরনো জামা। ছোট থেকেই এটা আমাকে বেদনা দিত। ওদের কাছেই শুনেছি, সারাবছর এই একটা মাসই ওরা কাজ পায় এই পুজোর মরশুমে। দূর গ্রামে ওদের বাড়ী, যেখানে কাজের তেমন অবকাশ নেই। বাড়ীর মেয়েরাও যে পরের বাড়ী কাজ করবে, তেমন ধনী বাড়ীও গ্রামে দু'তিন ঘর। তা অত দরিদ্র পরিবারের অত মহিলা, ওই দু'তিনটে বাড়ীতে কতজন আর কাজ করবে! পেটভরা খাবারও রোজ সবার জোটে না। পরের জমিতে কাজ করে সামান্য যা পায়, তাইতে কোনোরকমে নুন ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা হয়। ছোট থেকেই এসব শুনে আমার ওদের প্রতি খুব মায়া।
        প্রতিবছর পুজোর নবমীর দিন ঢাকীদের ব্যানার্জী বাড়ী, মানে আমার বাপের বাড়ী খাবার ব্যবস্থা হত। অন্যান্যদিন অন্য বাড়ী। ঠাকুমা কত কি আয়োজন করতেন। সুক্তো, ডাল, বেগুনী, তরকারী, ছ্যাঁচড়া, মাছ, মাংস, চাটনী, পাঁপড়, দই, মিষ্টি যেন বিয়েবাড়ীর ভোজ। ঢাকীদের মধ্যেও ওইদিনের খাওয়াটা বিশেষ আনন্দের ছিল। ঠাকুমাও খুব যত্ন করে ওদের খাওয়াতেন। ঠাকুমা সবাইকে পরিবেশন করে খাওয়াতে ভালবাসতেন। ঢাকীদের খেতে বসার ব্যবস্থা হয়েছে রান্নাঘরের কোলে দালানে আর আমাদের ভাইবোনেদের ঘরে খাবার টেবিলে। দালান ঢোকার সময় ঢাকীদের চোখে পড়েছে ঘরে খাবার টেবিলে আমাদের থালায় মুঠো পরিমাণ ভাত। তাই দেখে প্রথম দফা ভাত খাবার পর তারা বলে, "পেট ভরে গেছে"। ঠাকুমা অভিজ্ঞ চোখে ঠিক দেখে ফেলেছেন আর বুঝে নিয়েছেন যে ওরা ভাত নিতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই ওদের বললেন, "ওরে তোরা ছেলেপিলেদের থালার দিকে তাকাসনি, পেট ভরে খা। ওরা অতটুকু খাবে আর একটু পরেই লাফাতে লাফাতে আসবে খিদে পেয়েছে বলে। তোরা তৃপ্তি করে খা"। ওদের পরিতৃপ্তি করে খাইয়ে ঠাকুমাও যে কি পরিমাণ তৃপ্তি পেতেন সেটা দেখেছি তখন। একাদশীর দিন চলে যাবার আগে যখন ওরা আসত, ঠাকুমা পুরনো জামাকাপড় তো দিতেনই, সাথে ওদের বউদের জন্য নতুন শাড়ী ও বেশ কিছু টাকা দিতেন ওদের হাতে। এটা ওদের বাড়তি পাওনা ছিল। ঠাকুমা আগে থেকে কিনে গুছিয়ে রাখতেন ওদের জন্য, বলতেন, "ওদের বড় কষ্ট রে"। সেইকথাগুলো আমাকে বরাবর নাড়া দিয়েছে। ওরা কবে যেন আমাদের নিজের লোক হয়ে গেছে। বিয়ের পরও যখনই পুজোয় বাপের বাড়ী গেছি, ঢাকীদের টাকা দিয়েছি। ওরা বংশপরম্পরায় বাপের বাড়ীর পাড়ায় আসে। সেদিনের সেই ছোট ছেলেটি আমার সাথে সাথে বেড়ে উঠেছে। তার মেয়ের বিয়ের জন্য আমার কাছে আবদার করে টাকা নিয়ে গেছে। আমি খুশী হয়ে দিয়েছে।
        আজ জীবনের এতবছর কেটে যাবার পরও আমার  মনকে বড় বেশী নাড়া দিচ্ছে এই ঢাকীরা। চারিদিকে আলোর রোশনাই, বক্সের আওয়াজে কান পাতা দায়, রাস্তায় জনসমুদ্র, কিন্তু প্রাণটাই যেন নেই। ভাবি মনে, কি জানি, আজ ওদের কি অবস্থা! রাস্তায় বেরলে কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায় লাইন দিয়ে ঢাক নিয়ে সব বসে থাকে, কি জানি সবাই কাজ পায় কিনা! 
      মনে পড়ে, নবমীর রাতে ঢাকীদের সে কি নাচ। এত অনটনে বাঁচে তবু উৎসবে মাতে। সে ছেড়ে কারো বাড়ী ফিরতে ইচ্ছে করত না। বাড়ী ফেরার সময় মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত, আবার একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে। সবই আজ স্মৃতি। পুজো কাটে এখন ঘরে, কেবল একবার অঞ্জলি দিতে বেরনো। আর গতবছর থেকে তো কথাই নেই বেরনোর। করোনা ভাইরাসের দাপটে সবাই আজ গৃহবন্দী। গত পুজোতে পুরোহিত মশাই মন্ত্র পড়লেন, মাইকে তা সম্প্রচারিত হল  আমরা যে যার বাড়ির ঠাকুরঘরে বসে মন্ত্র উচ্চারণ করলাম তাই শুনে। ঠাকুরের আসনে মা দুর্গার উদ্দেশ্যে সেই ফুল অর্পণ করলাম। এবারেও তেমনই হবে আশা করি। জানি না আবার কবে মানুষ মেতে উঠতে পারবে, বাঙালীর প্রধান উৎসব এই দুর্গাপুজোয়। যে পুজোর জন্য বাঙালী সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে।



পুজো মানে

গোবিন্দ মোদক  


পুজো মানে  নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, 
পুজো মানে  নদীর ধারে কাশের বনের দোলা !
পুজো মানে  ভোরের বেলা শিশির ঘাসে ঘাসে, 
পুজো মানে  সূর্যের আলো সোনার রঙে হাসে ! 
পুজো মানে  খালে-বিলে শাপলা-শালুক ফুল, 
পুজো মানে  পদ্ম-কুঁড়ি হাওয়ায় দোদুল দুল !
পুজো মানে  ভোরের বেলা শিউলি ফুলের রাশি,  
পুজো মানে  জবা, টগর, স্থলপদ্মের হাসি !
পুজো মানে  কুমোর পাড়া ব্যস্ত ভীষণ কাজে,  
পুজো মানে  প্রকৃতিটা নতুন রকম সাজে !
পুজো মানে  বাতাস জুড়ে ঈষৎ হিমের ছোঁয়া,  
পুজো মানে  বেড়াতে যাওয়া সিমলা, উটি, গোয়া !
পুজো মানে  শারদ-সংখ্যার ছড়া-কবিতা-গল্প, 
পুজো মানে  নতুন গান -- সংখ্যাটা নয় অল্প !
পুজো মানে  বুড়ি বোষ্টমীর গাওয়া 'উমার গান', 
পুজো মানে  পঞ্চমী-তে কলাবউয়ের স্নান !
পুজো মানে  ষষ্ঠী এলেই 'বোধন' মনে পড়ে ,
পুজো মানে  খুশির খুশি সবার ঘরে ঘরে !
পুজো মানে  নতুন পোশাক, দেদার খাওয়া-দাওয়া, 
পুজো মানে  দল বেঁধে সব ঠাকুর দেখতে যাওয়া !
পুজো মানে  ঢাকের তালে ধুনুচি নাচের চেষ্টা ,
পুজো মানে  দশমী এলেই আসে দুঃখের রেশ-টা !
পুজো মানে  মুক্তি ক'দিন কাজের জগৎ থেকে, 
পুজো মানে  আত্মশুদ্ধি, রেশটা যে যায় রেখে !!

কবিতার এক ডজন বান্ধবী
অসিত কুমার পাল

পড়েছি কি মুশকিলে ভাই করি কি যে হায় 
এক ডজন বান্ধবী আর কেউ যেন না পায় ।
সকলেই চায় পুজোর সময় ঘুরি তারই সঙ্গে 
সেলফি তুলে রাখবে তারা, নতুন পোশাক অঙ্গে ।
অনেক  ভাবনা চিন্তা করে, প্ল্যান করলাম শেষে
সবাই কে দেব আলাদা সময়, নিত্য নতুন বেশে ।

শ্যামলীর সাথে বেরোতে হবে পঞ্চমীর রাতে
সুরুচি সংঘের ঠাকুর দেখে ঘুরব এক সাথে ।
ষষ্ঠীর দিন সকাল বেলায় বিধান নগর যাব
পারমিতার সঙ্গে সেথায় চিলি চিকেন খাবো ।
রমার সাথে সন্ধ্যে বেলায় যেতে পারি টালায়
ঠাকুর দেখব ফুচকা খাবো প্রাণটা যত চায় ।

সপ্তমীর ভোরে রুবিকে নিয়ে যাব গঙ্গার ঘাট
কলা বউ এর স্নান দেখব খাব পাপড়ি  চাট ।
বিকেল বেলায় বাগবাজারে গেলেই ভাল হয়
অরুনিমাই থাকবে সাথে আর তো কেউ নয় ।
অষ্টমীর সকালে দেখব ঠাকুর লেক টাউনে গিয়ে
লাইন সেথায় দিতে হবে সূচরিতাকে সঙ্গে নিয়ে ।

রাতের বেলায় যাব না আর কোথাও বেশি দূরে
প্রজাতার সঙ্গে কাটবে সময় আসেপাশে ঘুরে ।
অনিন্দিতাকে সময় দেব নবমীর দিন সকালে
তার সাথে প্রেমটা  নইলে ঝরে যাবে অকালে ।
নবমীতে রাতের বেলায় অনেক কিছুই করা যায়
মুদিয়ালীতে দেখব ঠাকুর, দেবলীনা সেটাই চায় ।

দশমীর সকালে ট্রেনে চেপে চলে যাব ব্যান্ডেলে
বীথিকে নিয়ে ঘুরব সেথায় প্যান্ডেল হতে প্যান্ডেলে ।
ওই দিন রাতে ক্ষমার সাথে বাবু ঘাটে গঙ্গার ধার
বিসর্জন টাও দেখার জিনিষ, পাবে না জুড়ি তার ।
অদ্রিজাকে পুজোর মধ্যে পারলাম না সময় দিতে
রেড রোডের কার্নিভালএ তাকেই সঙ্গে হবে নিতে ।

এক ডজন বান্ধবী নিয়ে হয়ে গেলাম নাজেহাল
একে যদি অন্যকে দেখে আমার জুটবে গালাগাল ।

ক বি তা 

আকার

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়


যা কিছু দেওয়ার ছিল 
নিটোল অন্ধকার 

ছড়ানো ছেটানো মন্থর প্রদীপের আলো
দীর্ঘতম নক্ষত্রের প্রতি অক্ষম অঙ্গীকার 

পরাজিত ছত্রাকের মত মাঝে মাঝে
আকাশ কে কাটাছেঁড়া করে 
বৃষ্টির অপেক্ষা 

বুনোহাঁসের পথে চলার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় 
শূন্য জীবন 
বরফ অসাড়

প্রকৃত দুর্যোগ 
ভাবতে ভাবতে নেমে আসে সন্ধ্যায় 

নির্বিকার কান্নার জলবিন্দু 
ধীরে ধীরে ধূসর ধুলোয় নেয় 

ক্ষীণ তরলের 
একমুখী বাষ্পের আকার...

উদাসীন সঙ্গম 

জয়ীতা চ্যাটার্জী


আজ শরীর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে চলে গেছে
আমার শরীরী শহর শিরার ধরনে করে দবদব
শরীরে ধুয়ে যায় বুক হৃদয়ের চোখ থেকে অশ্রুধারা বয় টপটপ
আমার নিঃশ্বাস পরে দ্রুত
শরীর বেয়ে ঘাম নামে
রক্তের ঝলক আমার মানচিত্রকে
আরও বেশি রক্তজবাময় করে তোলে
বছর কাটে
যুগ কাটে
তবুও সভ্যতা তেমনই বর্বর
ঠোঁটে রক্তফুল ফোটে
আমার পবিত্র শহরতলী অধিক পবিত্র হয় অন্তিম নিঃশ্বাসে
নদী গর্ভের মতো গভীরতা ঠান্ডা দেবদূত
বুকের ভেতর বোনা হয়ে যায় দুপুরের সুর
সে সুর সম্মোহনের
মৃত শহরের পাশে জেগে ওঠে বুক পেতে নিই
মুক্তিযোদ্ধাদের শনিতের ছাপ
পৃথিবীর মুক্তি চেয়ে নিঃশেষে নতজানু হয়ে বসি
মৃত্যুর গহ্বরে বিলীন হওয়ার দাগ
মুক্তি হোক হিম যুগের
উদাসীন সঙ্গমে শেষ সূর্যাস্তের আভা নিয়ে মেটাও
শরীরের ভাষ্য রংধনু দিয়ে।।

নীরব ভালোবাসা 

অমিতাভ মাইতি



পড়ন্ত বিকেলে গোধূলি বেলায় --
কফি হাউসের টেবিলে 
এক কাপ ধূমায়িত কফির উষ্ণ ধোঁয়া, 
অজস্র শব্দের ভিড়ে 
এলোমেলো হয়ে মিলিয়ে যায়।

উষ্ণ কফি আর জলন্ত সিগারেটের ধোঁয়ায় --
আলো আঁধারিতে ফুটে ওঠে তোমার অবয়ব।
তোমার শীতল চোখের আবছা চাহনি,
তোমার উষ্ণ ঠোঁটের নিঃশব্দ স্পর্শ
আমার হৃদয় কে করে স্পর্শ।

হাজার ভিড়ের মাঝে -- 
একবার তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে।
কি ছিল সেই নীল চোখের চাহনিতে?
শুধুই শূন্যতার নীরব চাহনি,
না কি নীরব ভালোবাসার ইঙ্গিত।

চোখ নাকি মনের কথা বলে --
তোমার চোখের গভীরতায়,
আমি নিজেকে ফেলি হারিয়ে।
তোমার চোখের অব্যক্ত ভাষায়,
আমি খুঁজে পাই নিজের মনের ভাষা।

হাজার কন্ঠের কোলাহলের মাঝে --
আমি খুঁজে ফিরি তোমার কন্ঠের আওয়াজ।
তোমার মধুর সুরেলা কন্ঠের আওয়াজ
বাজে আমার কানের মাঝে। 
তবুও আসো না তুমি আমার হৃদয়-মাঝে।

হাজার তারার ভিড়ের মাঝে,
আমি খুঁজি আমার প্রিয়াকে।
নীরবে যে ছুঁয়ে যায় আমার মন,
নীরবে যে এসে দাঁড়ায় আমার দ্বারে।
নীরবে যে ভালোবাসে শুধু আমারে।

ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে ভেসে ওঠে --
নীরবে রেখে যাওয়া তোমার 
হৃদয়ের স্পন্দন, জাগতিক প্রেম।
নীরবে বিলিয়ে দেওয়া তোমার 
বকুলের গন্ধ, শিউলির সুবাস।

সত্যিই কি, 
তুমি এসেছিলে আমার দ্বারে?
নাকি এ আমার, 
তীব্র কল্পনাশক্তির আবেগ মাত্র!
এ শুধু আমার ভালোবাসার আত্মপ্রকাশ।

আজও কফি হাউসের ধোঁয়ার কুন্ডলী--
আমায় অনুভব করায় 
তোমার ভালোবাসার উষ্ণ আলিঙ্গন,
তোমার ভালোবাসার উষ্ণ নিশ্বাস-প্রশ্বাস।
তুমি যে আমার কৈশোরের প্রথম প্রেম।

আজও দু'চোখ বুজলেই --
আমি স্পষ্ট তোমায় দেখতে পাই
আমার মনের মণিকোঠায়।
কিন্তু সব কিছুর মাঝে একটা ধোঁয়াশা?
তুমি সত্যিই মানবী না কল্পনা।

গ ল্প 

বর্ষা

সুস্মিতা শীল


 বর্ষার সময় হয়েছিল বলে রতন তার মেয়ের নাম রেখেছিল বর্ষা।রতন তার স্ত্রী আর প্রথম সন্তান বর্ষাকে নিয়ে বস্তিতে থাকে।দিনমজুর খাটা রতন  স্বপ্ন দেখে তার মেয়েকে বড় মানুষ করবে।ছোট থেকে সেই মতই বর্ষাকে মানুষ করেছে রতন। বর্ষার মনেও সেই স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছ রতন। বর্ষা অনেক পড়াশোনা করে,বড় চাকরি করবে।তারা বস্তি ছেড়ে নিজেদের বাড়ি করবে,সমাজের সম্মানীয় মানুষদের মত বাঁচবে। অনেকদিনের পরিশ্রম করে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে  রতনের তারই স্ত্রী মেয়েকে ভর্তি করেছে নাম স্কুলে।সমস্ত বইপত্র কিনেছে রতন নিজের হাতে। হঠাৎ করেই,প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন সমস্ত দেশ লকডাউন।বন্ধ হয়ে গেল রতনের কাজ। হাতে যেটুকু টাকা ছিল  সমস্তই খরচা করে খরচা হয়ে গেছে বর্ষার স্কুল আর বইপত্রের পেছনে।রতন আর তার স্ত্রী সমস্ত পরিকল্পনায় মাটি হয়ে গেল।তারা দুজনে মিলে কাজ করে সমস্ত দিক সামলে নেবে এমন পরিকল্পনা করেছিল। রতনের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে  সাথে তার স্ত্রীকেও ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা কাজে আসতে বারণ করে দিয়েছে করোনার ভয়ে।কিভাবে তিনটে পেট চলবে সেটাই ভেবে পায়না রতন।মাঝে মধ্যে নানা সংস্থা থেকে এবং সরকারের দিক থেকে  কিছু চাল আলু সবজি সাহায্য দেওয়া হয় বস্তিবাসীদের।একটু নিশ্চিন্ত হয়ে ছিল রতন। কিন্তু এর মাঝেই এল আমফান।উড়ে গেল তাদের ঘরের চাল ভেঙে গেল ঘরের দেওয়াল।বর্ষার এমন তান্ডব আগে কখনো দেখেনি রতন।বহু পুরনো বটগাছ গোড়া থেকে উপড়ে দিয়েছে,সমস্ত ইলেকট্রিক তার গুলো ছিড়ে গেছে,আর এই বর্ষার জলে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে রতনের মেয়ের জন্য কেনা নতুন বই পত্র। এই বর্ষাকেই ভালোবেসে একদিন রতন নিজের মেয়ের নাম রেখেছিল বর্ষা।আর আজ এই বর্ষাই ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাদের দুচোখ ভরা স্বপ্ন গুলোকে।।

হাড়গিলের দিনলিপি 

সুদীপ পাঠক 


সেদিনের মহানগর 
বদলে গেছে আজ, 
এখন যে তার অন্য রূপ 
ঘটেছে কতো উন্নয়ন, 
ইস্ট ওয়েস্ট উড়ালপুল 
ঝুপ ঝুপাঝুপ  
মেলা মোচ্ছব পার্বণ 
আর উৎসব রকমারি 
চোখ ধাঁধানো রোশনাই 
আহা বলিহারি!    
জ্বলছে কতো আলো! 
তবে নজর যদি যায় 
প্রদীপের ঠিক নীচ তলাটায় 
আজও তেমন কালো! 
বদলে গেছে শাসকের মুখ 
বদলে গেছে হোর্ডিং! 
কিম্ভুত ঐ প্রাণী গুলো 
ধুঁকছে তবু আজও,
মানুষ নয়তো ওরা যেনো তেলোপোকা ফড়িং ! 
জি এস টি, এন আর সি , 
ভিভি প্যাড আর নোটা 
যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা 
ভায়ের কপালে ফোঁটা! 
বুদ্ধিজীবী, আমরা-ওরা, ঘণ্টাখানেক, পেজ ওয়ান
সীমান্তের ওপার এপার 
ঝরছে রক্ত মরছে যোয়ান! 
নোট বাতিল, পে টিএম, 
রামমন্দির, ইমাম ভাতা 
বিচিত্র এই নগর রাষ্ট্র  
চিত্রগুপ্তের খোলা খাতা! 
ফোর-জি ফাইভ-জি 
সুইগি আর জোম্যাটো
কুড়িয়ে পাওয়া উচ্ছে পটল 
কাঁচকলা আর টমেটো! 
লকডাউন কোয়ারিন্টিন 
রেডজোন গ্রীনজোন 
খায় না মাথায় দেয়? 
বোঝে না ওরা অভাজন!
পাল্টে গেছে খোল নোলচে
পাল্টে গেছে সাজ 
ওরা সেদিন যেমনি ছিল
তেমনি আছে আজ! 
মানবাত্মার লাঞ্ছনা
গরল করে টলমল! 
তারই মাঝে ডুবিয়ে প্রাণ
জীবন আছে অবিচল ।।

১.
বাবুদের পায়ের দিকে তাকিয়ে দিন কেটে যায় ছেলেটার। সামনে এসে দাঁড়ায় মাথা হেঁট করে। তারপর আঁতিপাতি করে সন্ধানী চোখ খুঁজে বেড়ায় এক জোড়া চামড়ার জুতো। নজরে পড়লেই বুরুশ দিয়ে বাক্সের গায়ে ঠক্ করে শব্দ করে তুলে বলে 'পালিশ লাগবে পালিশ'। রক্তবর্ণ কোঠরাগত দু'টি চোখ, শরীর অস্থিচর্ম সার। একমাথা চুল যেন নারকোল ছোবড়া, তেল পড়ে না কস্মিনকালে। সেগুলো লাল হয়ে জট ধরেছে আর তাইতে উকুনের বাসা। যখন খুব কিলবিলিয়ে ওঠে তখন জোরে জোরে চুলকোয়। মাঝে মধ্যে ফাঁকায় বসে থাকলে একটা দু'টো বাছে, নখের ওপর রেখে পটাপট মারে। 

এখন তার বারো বছর। হিসাবটা অবশ্য সে নিজে জানে না। বাপ মা জানে কি? জানে হয়তো! মনে আছে কি? খোদায় মালুম! অনেক দিন হলো সে আর হাফপ্যান্ট পরে না। এখন লুঙ্গি আর গায়ে শুধু একটা গামছা। ছেলেটার নাম কি? কে জানে! সব লোক তো ওকে হাড়গিলে বলেই ডাকে। 

২.
বর্ষা চলছে, স্যানডাক্ ডাকব্যাক্ আর প্লাস্টিকের চপ্পল। 'ধান্দার হাল বহুত বিলা'। বিশ্বব্যাপী মন্দা ফণা তুলছে আর তার ছোবল আছড়ে পড়ছে চুনোপুটির ঘাড়ে। হাতে টান, পেটে টান ঘরে গেলে 'খিচাইন'। সকাল সোয়া আটটা, ছেলেটা এখন কে জি স্কুলের সামনে। মেন গেটের উল্টো ফুটপাতের ওপর বসেছে। ফুটফুটে বাচ্ছাগুলো আসে মায়েদের হাত ধরে। ইস্তিরি করা জামা প্যান্ট। অথবা ছোট্ট স্কার্ট, গলায় টাই ঝুলছে আবার। ওহ্ মাথায় টুপিও আছে! হাতে জলের বোতল, পিঠে ব্যাগ আর পায়ে ছোট ছোট কালো জুতো। এখানে কাজ করতে তার দারুন লাগে। মেহনত্ কম ঝটপট মাল। অল্প একটু পালিশ দিলেই বাচ্ছাগুলোর মুখে হাসি ফোটে। মায়েদেরও দিল খুশ। মেয়েছেলেগুলো একেবারেই দরমলাই করে না। ব্যাগ খুলে টাকা দিয়ে দেয়, যা হাতে ওঠে তাই। ওরা বড়লোক। বাচ্ছাগুলো একসঙ্গে কিচিরমিচির করে; ঠিক যেনো মুনিয়া পাখি! ছেলেটা দেখে আর হাসে। 

সকাল সাড়ে ন'টা। ছেলেটা এখন গঙ্গার ধারে। স্টিমার জেটির পাশে বসেছে। পনেরো মিনিট অন্তর হাওড়া যাওয়ার ফেরী ছাড়ছে। এখানে তাকে দ্রুত কাজ করতে হয়। ঠোঁটে সিগারেট, হাতে খবরের কাগজ, কাঁধে ব্যাগ, চোখে চশমা; অফিসবাবুরা মুখে কিছু বলে না। চুপচাপ পা তুলে দেয় পাদানির ওপর। ছেলেটার হাত চলছে মেশিনের মতো। বুরুশের কাজ শেষ। এবার কাপড়ের টুকরো দিয়ে ফাইনাল টাচ্। এইতো মুখ দেখা যাচ্ছে! তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। পরিতৃপ্তির হাসি। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের ওপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝেড়ে ফেলল। সে এবার হাত বাড়িয়েছে। মূল্য চায়, পারিশ্রমিক। লোকটা একটা দশ টাকার নোট হাতে গুঁজে দিয়ে সুড়ুৎ করে ভিড়ে মিশে গেলো। সে নোটটা খুলে দেখলো ফাটাচটা। মুখটা তেতো হয়ে গেলো। মাথা ঝাঁঝাঁ করে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল ' শালা হারামির বাচ্চা '। 

৩.
সকাল সাড়ে দশটা, হাওড়া স্টেশন। ফুটপাথে তেলেভাজার দোকান। এখানে এলেই সে মুশকিলে পড়ে। কখন যে নিজের অজান্তে এই দিকে পা বাড়ায় তা টের পায় না। ঢাউস কড়াইতে টগবগ করে ফুটতে থাকা তেলের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে যেতেই তার পেটের ভেতর 'কুত্তা' নাচতে শুরু করে দেয়। কচুরি তরকারি চার টাকা পিস। কলকাতা হাওড়া কোথাও এই রেটে পাওয়া যাবে না। তরকারিটা তো 'হেব্বি' করে, মটর কড়াই দেওয়া। সবাই চেয়ে চেয়ে খায়। ছেলেটা প্রথম দফায় দুটো খেলো, তারপর আরো একটা। মালিকের নজর এড়িয়ে সে কাজের ছেলেটার হাতে পচা দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিল। চোখ মেরে কেটে পড়লো সেখান থেকে। জানতে পারলেই 'উদোম খিস্তি' দেবে। দোকানের ঐ ছেলেটাকে তার নিজের মতন মনে হয়। লম্বা পাতলা চেহারা, চোখের চাউনি আর হাসিতে অনেক মিল আছে। তার সঙ্গে খুব দোস্তি। 

ছেলেটা স্টেশনের ভেতর চক্কর কাটছে। এক একদিন সে চলে যায় বালি উত্তরপাড়া বেলুড়। কোনো দিন বা ব্যান্ডেল বর্ধমান। আবার চন্দননগর বা তারকেশ্বরের ট্রেনে উঠে পড়ে ইচ্ছে হলে। 

গাড়ীতে খদ্দের মেলে। চলন পথে ঝুপ করে বসে টপাটপ কাজ সারে। কিন্তু আজকাল গাড়িতেও ধান্দা কমে গেছে। 
- পালিশ লাগবে বাবু পালিশ? 
- নাহ্ 
- লিন না বাবু, পেসাল কিড়িম পালিশ।
- আহ্ বলছি তো না! কানের কাছে খটখট করিস না তো। দেখছিস রবারের জুতো তবুও? 
- রবাটেও ভালো চকচক করবে বাবু! দেবো? 
- আহ্ আচ্ছা জ্বালাতনের ভোগ হলো দেখছি! যা সরে যা, ঘ্যান ঘ্যান করিস না। 
- ধুর ঢেমনা। 
নেমে পড়লো গাড়ী থেকে। আজ আর যেতে ইচ্ছে করছে না। সে আবার বিড়বিড় করলো 'শালা ঘাটের মড়া, বাঞ্চোত মক্ষ্মীচুষ '। 

৪. 
বেলা সাড়ে এগারোটা। বিষন্ন আউট্রাম। মেঘ করেছে। জমাট কালো। গুমোট গরম। গাছের পাতাটা পর্যন্ত নড়ছে না। দুটো কুকুর ধুলো শুঁকে ঘুরছে এদিক ওদিক। আর একটা জিভ বের করে হাঁফাচ্ছে। 

ভাঁটা চলছে। পাড়ের ওপর জেলে মাঝিরা নৌকা সারাচ্ছে। পেরেক ঠোকার একটানা ঠকাঠক ক্লান্তিকর শব্দ। কানে ভোঁ লাগে। একটা বাচ্চা পাড়ে বসে পায়খানা করছে। হুইসেল শোনা যায়। চক্ররেল আসছে। এলো থামলো। লোক নামলো দু' চারটে। লোক উঠলো দু' চারটে। চলে গেলো বিকট শব্দ করে। চরাচর খান খান হয়ে যায় যেন। অবিরত গাড়ী চলছে দ্রুতবেগে। পোড়া তেলের গন্ধ, রেল লাইন আর চাকার ঘর্ষনের গন্ধ। কালো ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে। সিমেন্ট বাঁধানো লাল চেয়ার। ছেলেটা গামছা পেতে শুয়ে পড়ল। মাথার ধারে পালিশের বাক্স। বাক্সের ভেতর বুরুশ, বিল্লি ক্রিম, শ্যু পলিশ। চেরিব্লজম, ব্ল্যাক আর ডার্কট্যান্ট। ঢাকনার ওপর চ্যাপলিন হাসছে। 

ছেলেটা শুয়ে শুয়ে ভাবছে। কি ভাবছে? ভাবছে মানুষ আর জুতো। জুতো আর মানুষ। জুতোর সঙ্গে তার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। যাকে বলে নাড়ি কাটা ধন। না না সে কখনো জুতো পরেনি। শুধু পালিশ করেছে। লোকে জুতো পায় দেয়, কিন্তু সে জুতোর অন্য রকম ব্যবহারও জানে। পায়ের জুতো মাথায় উঠতে দেখেছে সে। হ্যাঁ এখনো তার স্পষ্ট মনে পড়ে। সে তখন খুব ছোট। বাপের বাপ ঋণ কর্জ করেছিল মহাজনের কাছে। বুড়ো মরলো দেনা শোধ না করেই। বাপের মাথায় এলো সে দায়। বাপ তার অপারগ। রোগাভোগা দেহ। কাজেই বেরোতে পারে না রোজ তো ধার দেনা শুধবে কোত্থেকে? সে ধার বেড়েই চলে। সুদে আসলে অনেক টাকা হলো। একদিন মহাজন এলো, সঙ্গে পুলিশ। হাতে আইনের কাগজ। ওরা ঘরের জিনিস টেনে বাইরে ফেলতে লাগলো। মা ঘরের দোর আগলে দাঁড়ালো। ওরা মাকে ঠেকে ফেলে দিলো মাটিতে। বাপের মাথায় রক্ত চড়ল। লাঠি হাতে তেড়ে যেতেই দু'জন লোক পিছন থেকে দু' হাত চেপে ধরলো। তারপর জুতোর বাড়ি পড়তে লাগলো তার মাথায়। মুখে ঘাড়ে পিঠে। মাথা ফেটে রক্ত পড়তে লাগলো। জুতোর তলায় লোহার নাল আটকানো যে! বাপ তার লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। 

ঘর গেলো, উঠোন গেলো, এক চিলতে জমি গেলো। ভিটে মাটি চাটি হলো। তারপর ... ? 
তারপর কলকাতা। 

প্ল্যাটফর্মে কিছু দিন। পুলিশের তাড়া। ওরা তিনটি প্রাণী পালালো। চলে এলো শহরের অন্য প্রান্তে। ফুটপাতে ঝুপড়ি বানালো। পলিথিন, চট, পিচ বোর্ড দিয়ে তৈরী। ইঁট পেতে রান্না। কাগজ, চ্যালাকাঠ, কুটোকাটি এটাওটা দিয়ে হয় জ্বালানি। ভাত আর ঝোল। মুরগীর ঠ্যাংয়ের ফেলে দেওয়া শেষটুকু আর যত ছাঁটকাট্ দিয়ে। মাছের কানকো, তেল পটকা আর যত নাড়িভুড়ি দিয়ে বানানো। ওহ্ সে যেনো অমৃত। তবে রোজ নয়, হপ্তায় দু'দিন কি বড়জোর তিনদিন। তারপর এলাকার দাদারা এলো। ওদের হপ্তা চাই। ওরা আগেও তুলেছে, পরেও তুলবে। দিলে রেহাই না দিলে ধোলাই। ওরা পালাল। আবার বসলো। আবার পালালো আবার বসলো। আবার ... আবার ... আবার ...।

ঠিক 'দুপ্পুর' বারোটা। ছেলেটার দু'চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো। কপালের ওপর ডান হাতখানা রেখে সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো। 

৫. 
বিকেল তিনটে। আকাশ গুমরে ছিল অনেকক্ষণ। এবার ঝির ঝির বৃষ্টি শুরু হলো। দু' চার ফোঁটা গায়ে পড়তেই চমকে উঠলো। সম্বিত ফিরল। উঠে বসলো, আড়মোড়া ভাঙলো। গামছাটা কাঁধে ফেলল ।পালিশের বাক্সটা হাতে নিলো। এক ছুটে এসে দাঁড়াল সামনের বড় বটগাছের তলায়। এক জোড়া নারী পুরুষ এলো। দেখাদেখি একটা  'নেড়িকুত্তা' এলো। একটা বাচ্ছা ছেলেও এলো, 'উদোম ন্যাংটো'। ঐ 'বেটাছেলেটা' আর 'মেয়েছেলেটা' ঠিক 'সিনেমা আটিসের' মতন দেখতে। লোকটা বেশ লম্বা। ঘাড় পর্যন্ত কোঁকড়া চুল। চাপ দাড়ি আছে। বৌটা তো আরো সুন্দর। না না বৌ নয়! এখনো বিয়ে হয় নি বোধহয়! 'হেব্বি দেখতে মাইরি'। মাথার চুল হাল্কা ফোলা ফোলা। যেনো হাওয়াই মিঠাই। চোখ দুটো আঁকা। পাতার ওপর সবুজ রং। ঠোঁট দুটো আঁকা, ওখানে লাল রং। ছেলেটা এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে হাঁ করে। ওরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে। মেয়েছেলেটা পিছন ফিরলো। 'হাতকাটা বেলাউজ' পরেছে। এই 'এট্টুখানি' , এক 'ফালতি'। 'পিঠটাও' কতটা 'কাটা'! ফর্সা শরীরের অনেকখানি দৃশ্যমান। কাঁচা মাংস। ফিনফিনে ব্লাউজ ঘামে ভিজে জবজবে। 'ভেতরের  জামাটাও' দেখা যাচ্ছে। চেপে বসেছে। তার হাত নিসপিস করে গোটা শরীরময় পিন ফোটানোর জ্বালা। খুব ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে। 
'মাগীটা ছেনালি করছে'। হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে লোকটার গায়ে। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে শাড়ির আঁচল। গলায় সোনার হার। লকেটটা ঢুকে গেছে বুকের 'খাঁজে'। সুগন্ধে ভারী হয়ে যায় বাতাস। এতো দূর থেকেও নাকে আসে। ছেলেটা খুব জোরে লম্বা একটা শ্বাস নেয়। 

৬.
বিকেল পৌনে চারটে। ছেলেটা হাঁটছে। বাবুঘাট বাস স্ট্যান্ড। বঙ্কিম স্ট্যাচু। অসংখ্য খাবারের দোকান। ইডেন গার্ডেন। ছেলেটা হাঁটছে স্ট্যান্ড রোড ধরে। ডান হাতে বাঁক নেয়। নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়াম। আচ্ছা এই নেতাজী লোকটা কে? সে নাম শুনেছে, ছবি দেখেছে। নাকি খুব বড় 'লেতা' ছিল! 'সায়েবদের সঙ্গে যুদ্দু করেছিল'। শীতকালে লোকটার জন্মদিন। শ্যামবাজারের মোড়ে ঘোড়ায় চড়া বিশাল মূর্তি আছে। 'লেতারা' আসে। গলায় মালা দেয়, সঙ্গে 'নেকচার' দেয়। রাতে রঙিন আলো জ্বলে। ব্যাস এই পর্যন্ত সে জানে। তবে আরো একটা ব্যাপার তার জানা আছে। টিভিতে শুনেছে। এই স্টেডিয়ামে 'ইয়ারানার' শ্যুটিং হয়েছিল। অমিতাভ বচ্চনের 'বই'। সুপারহিট। 'সারা জামানা হাসিনো কা দিওয়ানা'। 'গুরু নাচ্ছে'। জ্যাকেটে টুনি বাল্ব, প্যান্টে টুনি বাল্ব। 'জিও গুরু জিও'। সে হেঁটেই চলেছে। রঞ্জি স্টেডিয়াম। এখানে 'কিরিকেট' খেলা হয়। উল্টো দিকে ক্ষুদিরাম বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে। সে অবশ্য চেনে না। সবাই যে বলে 'বাড় খেয়ে ক্ষুদিরাম'! এই কি তাহলে সেই লোক? পিছনে উচ্চ ন্যায়ালয়ের উচ্চতম চূড়ায় জাতীয় পতাকা উড়ছে। পতপত পতপত করে। গাছগাছালির ফাঁকফোঁকর  দিয়ে দেখতে বেশ লাগে। সে হাঁটছে। আকাশবাণী ভবন। ছেলেটা থমকে দাঁড়াল। এই গোলাপী রঙের বাড়ীতে কি হয়? প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে গোর্খা। সবুজ রঙা ইউনিফর্ম। মাথায় তেরছা টুপি। পায়ে ভারি বুট। হাতে বন্দুক। বেয়নেটের ফলা চকচক করছে। দ্বাররক্ষী হাঁক পাড়লো "এহ্ ভাগ ইঁহাসে"। সে পালালো । 

ছেলেটা হাঁটছে। রাজভবন। সে থামলো, মাথা তুলল। বিশাল দরজা। তার ওপর সিংহ। বলের ওপর থাবা বসিয়ে হাঁ করে আছে। সে দেখে অবাক হয়! গিলে খাবে নাকি? এখানে বড় মানুষেরা থাকে। 'পলিটিকের' ব্যাপার। সে হাঁটছে। কার্জন পার্ক। মার্ক্স এঙ্গেলস। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটছে। বিরামহীন। সে চেনে না। ওদের মাথার ওপর 'কাগে হেগেছে'। নাকের ওপর গড়িয়ে পড়েছে। এখানে অনেক লোক। ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বাদাম ভাজা বেছচ্ছে কেউ, চিবোচ্ছ কেউ। দুধ সাদা রানী রাসমণি। বসে আছে চুপ করে। গায়ে তার ছোপ ছোপ শ্যাওলা। সে চেনে না। 

বিকেল সাড়ে চারটে। হাঁটতে হাঁটতে সে ধর্মতলার মোড়ে এসে থামলো। সিধু কানু ডহর। এখানে হামেশাই মিটিং হয়। সে জানে। ট্রাম আসছে, বাস যাচ্ছে। একটু পরে নিয়ন লাইটটা জ্বলতে শুরু করবে। জ্বলবে আর নিভবে। চিড়িক চিড়িক, ঝিলিক ঝিলিক। জীবন মানে জী বাংলা। মোড়ের মাথায় বিশাল বড় পদ্মফুল আর তার ভেতরে ফোয়ারা।  সন্ধ্যে হলে ফোয়ারার জলে রঙিন আলো পড়বে। পিছনে লেনিন দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছু বলতে চায়। কিন্তু শুনছে কে ? সবাই তো ছুটছে, সবাই খুব ব্যস্ত। পাশেই মেট্রো স্টেশন। উল্টো দিকে মেট্রো সিনেমা। একটা ইংলিশ 'বই' চলছে। পোষ্টারে চুন মেরে ছবি চাপা। তার মানে 'সলিড সেক্সি সিন' আছে। এটা সে জানে। 

৭.
সন্ধ্যা ছ'টা। নৈশালোকে ঝলমল করছে মহানগরীর রাজপথ। আলো, শুধু আলো আর আলো জ্বলছে চতুর্দিকে। ল্যাম্প পোস্টের আলো। বড় বড় দোকানের আলো। হোটেল রেস্তোরাঁর আলো। হুস হুস করে ছুটে যাওয়া গাড়ীর জোরালো আলো। 

ছেলেটা ভিড় বাসের জানলা ধরে চলে এসেছে পার্ক স্ট্রীট। কন্ডাকটর তার টিকির নাগাল পায়নি। এখানে বেশ কিছু আমদানী হলো। কিছু অফিস ফেরৎ বাবু পালিশ করায়। সকালে তাদের সময় হয় না। শৌখিন ও বিত্তবান মানুষের সমাগমে পূর্ণ এই অঞ্চল। যার মুখ্য আকর্ষণ রেস্টুরেন্ট কাম ওয়াইন বার। ঐ সব হিমশীতল ঘরে মানুষজন যে সব সুখাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করে থাকে সে না জানে সেগুলোর নাম, না কোনো দিন দেখেছে চর্মচক্ষে। 

ছেলেটা হাঁটছে। ফিরে আসছে ধর্মতলায়। মনে হলো অনেকক্ষণ বিড়ি টানা হয়নি। বাক্স থেকে বের করে ধরালো একটা। ফুক ফুক করে দু'টো টান দিলো। ভুস ভুস করে একদলা ধোঁয়া বের হলো। গলা শুকিয়ে কাঠ। শুকনো কাশির দমক ওঠে খক খক করে। থুতু ফেলল পিচ্ করে। ছেলেটা হাঁটছে। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম। রাস্তা পার হলো। বাইবেল হাউস। রে-ব্যানের চশমার বাহার। বড় বড় ঝাঁকায় কোলাপুরি চপ্পল। সাইকেলের দোকান। ফোটো স্টুডিও। দোকান দোকান, লোকজন, বড় দোকান। ফুটপাথে উড়ছে ঢাউস বেলুন, লম্বা ও গোল। কাঁচ কাটা পাথর বিকোচ্ছে। টিভি ফ্রিজ কুলার ওয়াশিং মেশিন; ওহ্ কতো বড় দোকান! চাবির রিং লাইটার ট্রানজিস্টার সেন্ট পিস্তল; আরে ঘুপচি দোকান। আইস্ক্রীম পার্লার, ফলের রস। 

আবার রাস্তা পার হলো। গ্র্যান্ড হোটেল। শুরুতেই পর্নগ্রাফির বেশ জাঁকালো দোকান। গোটা চারেক স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলে গাঁদি মেরে আছে। এখানে 'ন্যাংটো মাগীর ছবির বই বিক্রী হয়' সে জানে। সে কাছে এগিয়ে এসে ঠেলেঠুলে ভিতরে ঢুকলো। উঁকি মেরে দেখছে। চোখের সামনেই একটা বই ঝুলছে। প্রচ্ছদে এক নারীমূর্তি। সম্পূর্ণ বিবসনা ও জলসিক্তা। জলের ফোঁটা গড়িয়ে নেমেছে নীচে।  নাভিমূল ছাড়িয়ে প্রায় যোনি পথের কাছাকাছি এসে থমকে আছে। যেখানে ছোট ছোট রোম ঝিলিক দিচ্ছে ছবিটা সেখানে শেষ হয়েছে। যৌণ শীৎকারের স্ফুরণ সেই নারীর চোখে মুখে, সারা দেহে মাখামাখি হয়ে আছে। স্কুলবয়দের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল "উরে শ্লা কি ডাঁসা মাল ইয়ার ! একেবারে সলিড"! অন্যরা হাসছে। আরো কিছু বলছে ফিস ফিস করে। 'ওরা ফুল মস্তিতে আছে'। ছেলেটা 'ভ্যাবলাকান্ত' হয়ে ওদের দেখছে! হঠাৎ দোকানদারের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে চোখ মারলো। সঙ্গে ঠোঁট চুষে হাসি। ছেলেটা তৎক্ষণাৎ সরে এলো সেখান থেকে।

৮. 
সন্ধ্যা সওয়া ছ'টা। ছেলেটা হেঁটেই চলেছে। একটা বড় জুতোর দোকানের সামনে এসে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ায়। সাহেব কোম্পানি। শো উইন্ডো আলোয় ভেসে যাচ্ছে। হরেক কিসিমের জুতো। সে কাঁচের ওপর হাত রাখলো। ঠিক মাঝখানে ডিসপ্লে বোর্ড ঘুরছে ধীরে ধীরে। তার ওপর সেই জুতোটা! না ঠিক সেটা নয়, তবে সেই রকমই আর একটা জুতো। ছেলেটার দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ। চোখের পলক পড়ে না। হাত দু'টো যেন কাঁচের গায়ে আটকে গেছে। মনে পড়ে যায় সব, গত বছরের কথা। বোধ হয় এই সময়ই হবে। এই দোকানের সামনে, হ্যাঁ ঠিক এই দোকানটাই তো! 

সেদিন ব্রিগেডে মিটিং ছিল। প্রকাশ্য জনসভা, প্রচুর লোক সমাগম। গ্রামগঞ্জ থেকে বাস ম্যাটাডোর ট্রাক বোঝাই করে মানুষ এসেছিল। শহরের গেরস্ত পোষা মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে ইস্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা কেউ বাদ যায় নি। চারিদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড। মানুষের মুখে শুধু একটাই কথা "ম্যাডাম আসছে ম্যাডাম"। অগ্নীবর্ষী নেত্রী আসছেন ভাষণ দিতে। সরকারের মরণ ঘন্টা বাজানো হবে। পশ্চিম বাংলার হাল ফিরবে এবার। গরীব মানুষের নাকি আর কোনো 'দুখখু' থাকবে না। তাই! সত্যি?

সে জানে একে বলে 'পলিটিক'। আর 'পলিটিক' মানে অনেক লোক জমবে। আর অনেক লোক মানে 'ধান্দাপানির একটা চানাস্ আছে'। সে চলে এলো। ভাষণ শুনতে নয়, পেটের টানে। পায়ে পায়ে এসে বসলো এই দোকানের পাশে। কারণ এই জায়গাটা তার সব চাইতে নিরাপদ বলে মনে হলো। মাথার ওপর গাড়ী বারান্দার ছাদ। রোদ জল গায়ে লাগবে না, খদ্দেরও মিলবে।

চতুর্দিক তেরঙ্গা ঝান্ডা শোভিত মঞ্চ। বহুদূরের সভাস্থল থেকে লাইন টেনে এনে মাইকে মাইকে গোটা চত্বর ভরিয়ে তোলা হয়েছে। মানুষের স্বার্থে। যাতে কেউ অমূল্য বাণী থেকে বঞ্চিত না হয়। তিনি এলেন। সভা শুরু হলো। বক্তৃতা চলছে। সত্যি যেন আগুন ঝরে পড়ছে। মাঝে মধ্যেই হাত তালি আর হর্ষ ধ্বনি কানে ভেসে আসে। বেশ চলছিল। হঠাৎ কি হলো কে জানে, একটা গণ্ডগোল শুরু হলো। কারা যেন দমাদ্দম এলোপাথাড়ি ইঁট পাটকেল ছুঁড়তে লাগল। বাস ট্রাম ভাঙচুর হচ্ছে। ঝন ঝন ঝণাৎ! তারপর শুরু হলো অগ্নি সংযোগ। দাউ দাউ করে জ্বলছে যানবাহন। পুলিশ তৈরী হয়েই ছিল। প্রথমে লাঠি চার্জ, তারপর টিয়ার গ্যাস ফায়ারিং। চাপ চাপ ধোঁয়া, চোখ জ্বলে যায়। আতঙ্কে মানুষ ছুটে পালাচ্ছে, যে যেদিকে পারছে। দোকানের রোলিং শাটার গুলো নেমে আসছে দ্রুত। মুহূর্তে চতুর্দিক ফাঁকা। ছেলেটা পালিশের বাক্স হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হতভম্ব হয়ে গেছে সম্পূর্ণ। এমন সাংঘাতিক ঘটনা তার জীবনে প্রথম। এখন কি করবে ভেবে ঠিক করতে পারে না! হঠাৎ ঝাঁই করে একটা শব্দ, খুব কাছেই! ফিরে তাকাতেই দেখলো একটা লোক দোকানের কাঁচ ভেঙে জুতো বের করে নিচ্ছে। এক ঝটকায় তার দিকে তাকিয়ে বলল "চোপ শালা হারামখোর। একদম চিল্লাবি না। তালে পুরো গাঁড় মেরে দেবো"। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে দেখে রোগা কালো চিমড়ে চেহারার লোকটার ন্যাড়া মাথা। পরনে কালো হাফপ্যান্ট। দাঁত দিয়ে চেপে ধরে আছে ক্ষুর। একটা বড় চটের বস্তার মধ্যে যতটা সম্ভব পুরল। কাঁধে ফেলে এগোতেই স্পিন্টার এসে পায়ে বিঁধল। সেলটা খুব কাছেই বোধ হয় ফেটেছে। লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দলের অন্যরা এসে পাঁজাকোলা করে নিয়ে অটোরিক্সায় তুলল। মুহুর্তের মধ্যে গলি পথে মিলিয়ে গেলো চোখের আড়ালে। 

ওরা চলে যেতে ছেলেটার নজরে পড়লো ফুটপাতে পড়ে আছে দু' পাটি জুতো। চকচকে নতুন এক জোড়া জুতো। এরকম জুতো কোনো কোনো লোকের পায়ে দেখেছে বটে। পালিশ করেছে। সিনেমার হিরো পরে এরকম জুতো। কখনো কখনো ভিলেনও পরে। সে কোনদিন পরেনি। স্বপ্ন দেখে একদিন পরবে বলে। তার চোখ বিস্ফারিত। নিজের অজান্তে এগিয়ে গিয়ে তুলে নেয়। দু' হাতে বুকের মাঝে চেপে ধরে সে। তারপর কিছু বোঝবার আগেই তার মাথার চুলে টান পড়লো। শক্ত হাতে কে যেন পাশবিক ভাবে খামচে ধরেছে! সে কোনো মতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করলো। একি পুলিশ! শুরু হলো কিল চড় লাথি, অগুন্তি। দোকানের মালিক বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। বলল "হাঁ হাঁ এ শালা শুয়ার কা অওলাদ হি শিসা ভাঙছে । বহুত টাইম সে ই মতলবে বসেছিল। দেখেন হাতে শ্যু ভি আছে। চোর বাজারে বেচাকেনার লেনদেন চলে হারামিদের। সব মালুম আছে"। ছেলেটা প্রতিবাদ করলো "না না আমি ভঙ্গিনি, একটা ন্যাড়া মাথা লোক ...."। তার কথা শেষ হলো না, আঁক করে একটা অস্ফুট শব্দ বের হলো মুখ থেকে। পেটে সজোরে রুলের গুঁতো পড়তেই সে ককিয়ে উঠলো। "চল শালা চল, থানায় গিয়ে তোর সব গল্প শুনছি"। তাকে টেনে হিচড়ে তোলা হলো প্রিজন ভ্যানে। 

৯.
থানায় এসে পুলিশ কথা শোনা বা বলার কোনো ধার ধরলো না। শুধু হাতের কাজ করে দেখলো  'বেধড়ক ক্যালানি'। সারা রাত কাটলো লক্ আপে। মাগহ্ নরক কাকে বলে! আলো আঁধারিতে মাখা ভোরে মানুষের ঘুম ভাঙার আগে ছেলেটার অর্ধচেতন সম্পন্ন দেহটা ওরা জিপ্ থেকে ছুঁড়ে দিলো নির্জন বাইপাসের প্রান্তরে। পুলিশ তার ভুল বুঝতে পারে। নাহ্ এ ছোঁড়া কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী হতে পারে না। এমনকি তাদের পোষা গুণ্ডাও নয়। সমাজ বিরোধী? মস্তান? নাহ্ তাও নয়। তবে কি সন্ত্রাসবাদী? ফ্যুঃ ভাবলে হাসি পায়! তাহলে মালটা আদপে কি? চোর ছ্যাঁচোড় বলেও তো মনে হচ্ছে না। ওসব করতে গেলেও ধক্ লাগে। ইটস আ ব্লাডি মিসটেক। পুলিশ ভেবেছিল ছেলেটা বোধ হয় টেশে গেছে। যাক গে যাক, কো ল্যাটারাল ড্যামেজ। কিন্তু না ছেলেটা মরেনি। পালিশের বাক্সটা বুকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিল। নির্মল প্রভাত তার হৃদঘাতের শব্দে জেগে ওঠে। 

সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা। ট্র্যাফিক জ্যাম। বাসের হর্ন। ছেলেটার চমক ভাঙ্গে। সে কাঁচের ওপর থেকে হাত দুটো সরায়। জুতোটা এখনো ঘুরছে ঠিক আগের মতো। গোড়ালি পর্যন্ত চেন টানা ব্রাউন হান্টিং শ্যু। একটা দামী জুতো তার বাপের কপাল ফাটিয়েছিল। এই রকম একটা জুতোর জন্য সে বিনা দোষে চোরের মার খেয়েছে। এই রকম একটা জুতো সে নিজে পরতে চায়। পুরো দোকানটাই যদি সে কিনে নিতে পারতো? ঠিক যেমন হয়েছিল 'দিওয়ারে'। অমিতাভের বই। যে বাড়ীটা তৈরী হওয়ার সময় অমিতাভের মা সেখানে মাথায় করে ইঁট তুলেছিল; বড় হয়ে গুরু সেই গোটা বাড়ীটাই কিনে নিলো। কথাটা মনে মনে ভেবে সে এবার নিজেই হেসে ফেলল ফিক করে। 'ধুর শালা এসব তো সিনেমায় হয়'। গুরু পারে, সে পারবে না। সে তো গুরুর মতো লম্বাই নয়। আরো একবার কাছে এগিয়ে এসে জুতো জোড়া দেখলো সে। জিপ্ থেকে প্রাইজ ট্যাগটা ঝুলছে। লাল রং দিয়ে দাম লেখা। জ্বলজ্বল করছে। আট হাজার সাতশো পঁচাত্তর টাকা মাত্র। নাহ্ অতো টাকা সে একসঙ্গে কোনো দিন দেখেনি। 

১০.
ছেলেটা আবার হাঁটছে। বাড়ীর দেওয়ালের গায়ে সেঁটে থাকা  অনেকগুলো গুমটি দোকান। হরেক রকমের রং বাহারি কন্ডোম সাজানো। সব স্খলনের আয়োজন পার হয়ে "রোগীর পথ্যের মতো" ধর্মতলার মোড়ে এসে থামলো সে। তারও বোধ হয় ইচ্ছে করে এইখানে দাঁড়িয়ে "হিসি" করতে। দূর থেকে নজরে পড়ে ইসকনের ভ্যান গাড়ী। চালের ওপর 'চোঙা ফিট' করা। নামগান সংকীর্তন বেজে চলেছে। 
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম 
রাম রাম হরে হরে । 
একজন ন্যাড়া মাথা সায়েব খিচুড়ি বিলোচ্ছে। ভিখিরির দল মাছির মতন ভিন ভিন করছে। ছেলেটা ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। হাত বাড়িয়ে একটা শালপাতা নিলো। গরমাগরম, আহ্ কি স্বাদ! অপূর্ব! ফিরে গিয়ে আবার লাইনে দাঁড়ালো। আবার একপাতা চেয়ে নিলো। চেটেপুটে খেলো সবটা। পেট ভরলো কিন্তু মন ভরল না। বাপ মায়ের কথা ভাবতেই চোখ ছলছল করে ওঠে। নিয়ে যাবার তো উপায় নেই। কি আর করা যাবে! 

আজ আবার এখানে মিটিং, মেট্রো চ্যানেলে। পথসভা বলে নাকি? এদের ঝান্ডার রং লাল। একজন লোক মাইকের সামনে খুব চেঁচাচ্ছে। মেহনতী শ্রমজীবী, বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী; এই সব বলে চলেছে এক নাগাড়ে। এসব কথার অর্থ কি তা সে জানে না। ভিড় করে লোকে শুনছে। সে এখন বুঝে গেছে যেখানে 'পলিটিক' সেখানেই 'ক্যাওড়া'। তাই সে এখন 'পলিটিক' এড়িয়ে চলে। 

বাসের জানলা ধরে আবার ঝুলে পড়লো। আবার ফেয়ারলি প্লেস। আবার স্টিমার। ছেলেটা রেলিঙের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। জোলো হওয়ায় ফরফর করে উড়ছে তার গামছা। সে ঘরে ফিরছে। পেটে অন্ন বুকে আনন্দ মুখে হাসি গলায় গান। সে এখন গান গাইছে। প্রথমে গুনগুন করে, তারপর গলা ছেড়ে। স্টিমারের ভোঁ-এর সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে তার কণ্ঠস্বর। ছেলেটা গান গেয়েই চলেছে "মেরা জুতা হ্যায় জাপানী, এ পাতলুন ইংলিশতানি, শর পে লাল টোপি রুশি, ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি"।
 

উইকেন্ড

সুমন দে


আজ ইলেকট্রিক বিল জমা দেয়ার শেষদিন। এখন সব কিছুই অনলাইনে। পিঙ্কু বাবার কাছ থেকে ডেবিটকার্ড নিয়ে মোবাইল থেকে ইলেকট্রিক বিল জমা দিয়ে দিল। নতুন প্রজন্মের জন্য অনলাইন পেমেন্ট খুব সহজ। পিঙ্কুর পুরো নাম প্রকৃতি ভৌমিক দত্ত, আদর করে পিঙ্কু বলে ডাকে। পিঙ্কুর বাবা তন্ময় ভৌমিক একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন।আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছল পরিবার। একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুবাদে সব রকম সুযোগ সুবিধে পেয়েছে। কলকাতার ভালো কলেজ থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে স্নাতক। তাই বাবা-মায়ের সব সময় একটু নাক উঁচু ব্যাপার ছিলো পাড়ায়। বর্তমানে ভৌমিক বাবু অবসরপ্রাপ্ত। পিঙ্কু নিজের সখ-আল্লাদ পূরনের জন্য একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে। সেদিন সন্ধ্যায় টিভিতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে ভৌমিকবাবু স্ত্রীর সাথে মেয়ের বিয়ের জন্য আলোচনা করছিলেন। আজকাল ভালো ছেলে পাওয়া খুব মুশকিল। বাজারে যাওয়ার সময় ওনার বন্ধু বটব্যালবাবুর সঙ্গে দেখা। কথায় কথায় বললেন একটা সুপাত্রের সন্ধান করছেন মেয়ের জন্য। পাস দিয়ে নিতাই কাকা যাচ্ছিলেন কথাটা কানে ভেসে আসতেই ওমনি থমকে দাঁড়িয়ে বলে উঠল — আরে ভৌমিকদা কিসের এত আলোচনা, না ঐ আর কি মেয়েটার জন্য ভালো ছেলের সন্ধান করছি। তা বেশতো আজকাল শুনেছি কম্পিউটারে পাত্রপাত্রীর জন্য বিজ্ঞাপন দেয় সকলে, আপনিও দেখতে পারেন। দেখি তোমার বৌদি কি বলে। পিঙ্কুর মা একজন আধুনিক মহিলা। মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে। যদিও বাবাও তাই, বাড়িতে মাঝে মধ্যেই পার্টি হতো।বাবার বন্ধুরা প্রায়শই আসতো জমিয়ে আড্ডা খাওয়া-দাওয়া সাথে দামি হুইস্কী। কর্মসূত্রে এই অভ্যেস। পিঙ্কু চুটিয়ে চাকরি করছে শনি, রবি অফিস ছুটি। তাই মাঝে মাঝে সেও অফিস কলিগদের সাথে উইকেন্ড পার্টিতে যায়। তার ওপরে পিঙ্কু দেখতে শুনতে যথেষ্ট সুন্দরী। ফলে অফিসের পুরুষ কলিগরা ওর সঙ্গে পার্টিতে যেতে একটু আগ্রহী। জ্যৈষ্ঠে ছেলের বাড়ির লোকেরা পাকা কথা করে গেছে। আগামী অঘ্রানে বিয়ে ঠিক হয়েছে পিঙ্কুর। কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে কোন পিতা না চায়। ছেলে বহুজাতিক কোম্পানিতে সফটওয়ার ইন্জিনিয়ার এবং বেতন বেশ ভালো। প্রায়শই বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ থাকে। ফলে ভৌমিকবাবুর পরিবার এই সম্পর্কে আর দেরি করেনি। তবে মেয়ে খুব একটা খুশি নয়, তার কোথাও যেন অবাধ স্বাধীনতাতে হস্তক্ষেপ মনে হচ্ছে। বিয়ে বেশ ধুমধাম করে শেষ হল। জানুয়ারিতে হানিমুন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। দুচোখে রঙ্গীন স্বপ্ন নিয়ে নানান খুনসুটিতে সাতদিন সময় কিভাবে অতিবাহিত হল বোঝাই গেল না। কন্যা বিদায়ের দিন মা বলে দিয়েছিল শ্বশুর বাড়ির সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলবি। ফিরে এসে প্রত্যুশ আর পিঙ্কু তাদের নিজের নিজের কাজে যোগ দিল।শ্বশুর শাশুড়ি আর এক ননদকে নিয়ে পিঙ্কুর সাংসারিক জীবনের চাকা গড়াতে লাগল। কিন্তু পুরোনো অভ্যেস কি আর সহজে ছাড়া সম্ভব। অফিস কলিগদের সাথে প্রায়শই  উইকেন্ড পার্টি চলতে থাকলো। এই ধরনের নারী স্বাধীনতা দত্ত পরিবারের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।কিন্তু মুখফুটে বলার জো নেই, আইনের চোখ রাঙানি আছে যে। নইলে প্রতিবেশীরাই আবার সমাজসেবী হয়ে বধূনির্যাতনের অপবাদ দেবে। হঠাৎ পিঙ্কুর বাবার ফোন মেয়েকে, তোর মা খুব সিরিয়াস বেলভিউতে ভর্তি। সময় নষ্ট না করে সোজা হাসপাতালে। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে মায়ের মেজর হার্ট অ্যাটাক। প্রত্যুশ খবর পেয়ে পৌঁছে গেছে। তিনদিন ছিল আইসিউতে, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। পিঙ্কু তাঁর মাকে হারালো আর ভৌমিকবাবু তার জীবন সঙ্গীনিকে। কালের নিয়মে ধীরে ধীরে জীবন থেকে সবকিছুই মুছে গেল। পিঙ্কু তার স্বভাবসিদ্ধ পুরোনো জীবনে ব্যস্ত। কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ী, বৌমার এই জীবন ধারনের পদ্ধতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।অবশেষে বাঙালি পারিবারিক সমাজ ব্যবস্থার অভিশপ্ত দিন এলো, প্রত্যুশ আর পিঙ্কুর বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। অগত্যা বাবার হোটেলে ফিরে যাওয়া। এখনও স্ত্রীকে হারানোর ব্যাথা ভুলতে পারেনি তার ওপর মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ। যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। এদিকে করোনা নামক ভাইরাসের আবির্ভাবে দেশে আতঙ্কের পরিবেশ। পিঙ্কুও এখন ঘরে বসা কারণ যে কোম্পানিতে কাজ করতো তারা সব হিসাবপত্র ফাইনাল করে দিয়েছে। কাজ করার সূত্রে রাজা নামে একটা ছেলের সঙ্গে তাঁর নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রথমে বাবা বুঝতে পারেনি। পরে রাজা বাড়িতে যাওয়া আসা শুরু করে।ভৌমিক বাবুর ছেলেটিকে না পসন্দ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুজনের মেলামেশা আরো গভীর হতে থাকে।একদিন বাবা জিজ্ঞেস করলো, ছেলে করে কি। রাজার এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের ব্যবসা। এখন বাইরে বেরোলেই বাবার থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে যায় বন্ধুদের সঙ্গে ডিস্কো, দামি রেস্তোরাঁ যাওয়ার জন্য। বেশীদিন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলেন না ভৌমিকবাবু। একদিন বেশ বাকবিতন্ডা হয় বাবা মেয়ের মধ্যে, এমনকি পাশের ফ্ল্যাটের কীর্তনিয়া বাবু ছুটে আসে। তাছাড়া এই দুর্মূল্যের বাজারে কোন বাবা মা একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াবে। ধীরে ধীরে বাবা মেয়ের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বাড়তে থাকে। এত চাপের ফলে একটা কাজ জোগাড় হয়েছে। রাজাই সাহায্য করেছে। সামনেই দোল উৎসব, পিঙ্কুর ছুটি আছে তিনদিন। তাই বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে রাজি করিয়েছে উইকেন্ডে কাছে পিঠে ঘুরে আসার জন্য। শনিবার ভোরে দিঘার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সেখানে পৌঁছে নিউ দিঘায় একটি হোটেলে ওঠে। সোমবার ভোরে স্থানীয় জেলেরা তাদের নৌকা নিয়ে সমুদ্রের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় ঝাউ বনের ভেতর থেকে পোড়া চামড়ার গন্ধ পাচ্ছিল। সামনে গিয়ে দেখে জ্বলে যাওয়া মানুষের দেহ। আসলে ছোট নৌকাগুলো জেলেরা ঐ ঝাউ গাছের গোড়ার সঙ্গেই বেঁধে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ বডি নিয়ে চলে যায় এবং এটা কোনও খুন না আত্মহত্যা তা নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় হোটেল গুলোর সিসি ক্যামেরা এবং বুকিং রেজিস্টার ক্ষতিয়ে দেখে। সিসি ক্যামেরা যাচাই করার সময় দেখা যায় একটি হোটেল থেকে দুজন ব্যক্তি রাত্রি সাড়ে দশটার সময় বাইরে যায়। রাত দেড়টার সময় একজন ব্যক্তি ফিরে আসে। পুলিশ হোটেলের সিকিউরিটি গার্ডদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ফুটেজ দেখে পুলিশ পিঙ্কুকে শনাক্ত করে। সাথে সাথে কলকাতার রিজেন্ট পার্ক থানায় যোগাযোগ করা হয়। কারণ বুকিং রেজিস্টারে ঐ থানা এলাকার ঠিকানা দেওয়াছিল। পুলিশ পিঙ্কুকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। এই খুনের পেছনে যে তার হাত আছে স্বীকার করে। জেরায় সে পুলিশকে জানায় রবিবার রাতে যে হোটেলে তারা ছিল তাদের রেস্তোরাঁ কাম বারে রাতের খাওয়া দাওয়া সারে। যেহেতু ভৌমিকবাবুর আগে থেকেই মদ্যপানের অভ্যেস ছিল তাই সেদিন কথার ছলে বাবাকে মাত্রাতিরিক্ত মদ্য পান করায়। তারপর নেশার ঘোরে বাবাকে নিয়ে সি-বিচের ধারে গিয়ে বসে। সমুদ্রের স্নিগ্দ্ধ বাতাসে ভৌমিকবাবুর ঘুম পেয়ে যায়। তারপর প্রকৃতি সেই অপ্রাকৃতিক কর্মটা করে, কেরাসিন তেল ঢেলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ জানায় বরিবার সকালে স্থানীয় একটি দোকান থেকে সে আগেই কেরোসিন ও দেশলাই জোগাড় করে ঐ ঝাউ বনে লুকিয়ে রেখেছিল। তদন্তে জানা যায়, বাবার কাছ থেকে সমস্ত সম্পত্তির অধিকার নিজের হাতে চাইছিল কিন্তু ভৌমিক বাবু রাজি হয়নি। পুলিশ পিঙ্কুকে আদালতে তোলে বিচারের জন্য। এদিকে পাড়ার লোকরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে, এমনকি পিঙ্কুর মৃত্যু দন্ডের দাবি জানায়। আদালত সরকারপক্ষ এবং ডিফেন্স উকিলবাবুদের দলিল যাচাই করার পর পিঙ্কু উরফে প্রকৃতিকে যাবজ্জীবন স্বশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেয়। ভৌমিকবাবু কি ভেবেছিলেন একদিন তাকে প্রকৃতির হাত ধরে আর এক প্রকৃতির কোলে চির নিদ্রায় চলে যেতে হবে! 

দ্রষ্টব্য - উপরোক্ত গল্পের সমস্ত চরিত্র, স্থান, কাল, পাত্র কাল্পনিক। সম্প্রতি কলকাতায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার ওপর নির্ভর করে আমার লেখা।   

ইলশেগুঁড়ি-র সাপ্তাহিক অনলাইন পত্রিকা 

ই-পত্রিকায় লেখা পাঠাবার নিয়মাবলী


  • সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক অপ্রকাশিত মৌলিক লেখা পাঠাতে পারেন।
  • কোন লেখার ক্ষেত্রে শব্দসংখ্যার বাঁধন নেই তবে মহাভারত পাঠাবেন না।
  • লেখা শুধুমাত্র বাংলা ইউনিকোড ফন্টে টাইপ করে পাঠাতে হবে।
  • নিজের একটা ছবি দেবেন অ্যাটাচ ফাইল হিসাবে।
  • ঠিকানা ও যোগাযোগের নম্বর থাকা জরুরি।
  • বইয়ের আলোচনা পাঠানো যাবে তবে সঙ্গে দিতে হবে বইটির প্রচ্ছদের ছবি।
  • প্রত্যেকের লেখার আলাদা করে প্রাপ্তি স্বীকার করা হয় না। 
  • লেখা যে কোন সংখ্যায় প্রকাশিত হতে পারে।
  • আমাদের ফেসবুক পেজে বা ওয়েবসাইটে প্রতি সপ্তাহে সম্পূর্ণ সূচিপত্র দেওয়া হবে।
  • প্রত্যেককে তাঁর নিজের লেখার লিংক আলাদা আলাদা ভাবে পাঠানো সম্ভব হয় না।
  • পত্রিকা প্রকাশের অব্যবহিত পরেই প্রত্যেক লেখককে পত্রিকার লিঙ্ক পাঠানো হয়।
 প্রয়োজনে ৯৩৩১২৭১৮২৫ম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ করুন বা
ই-মেইল করুন ilseguripatrika@gmail.com
আমাদের ওয়েবসাইট অনুসরণ করুন:- https://ilseguripatrika. blogspot.com/
আমাদের ফেসবুক পেজ :- https:://www.facebook.com//ilseguripatrika

ইলশেগুঁড়ি থেকে প্রথম কবিতা সঙ্কলন সাজির সাফল্যের মুকুটে 
আরো একটি পালক যুক্ত করল আনন্দবাজার পত্রিকার এই রিভিউ

ইলশেগুঁড়ি প্রকাশনের প্রথম কবিতা 
সংকলন সাজি এখন পাওয়া যাচ্ছে।






প্রকাশের পথে গোয়েন্দা উপন্যাস 

ইলশেগুঁড়ি-র একরাশ শুভেচ্ছা বসিরহাট থেকে প্রকাশিত

বিবস্বান পত্রিকার ২৫ বছরে পদার্পনে।








প্রিয় পাঠক, আপনার মতামত আমাদের কাছে মূল্যবান।

ilseguripatrika@gmail.com




No comments

Theme images by luoman. Powered by Blogger.